Image description

বগুড়া-৬ আসনটি সদরের। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যাকে বলা হয় ‘ভিআইপি আসন’। এখান থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বারবার জয়, দলটির দৃঢ় উপস্থিতির পাশাপাশি প্রতিদ্বন্দ্বীদের তৎপরতা সবসময়ই লক্ষ্যণীয়। সবমিলিয়ে সবসময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু বগুড়া-৬ আসন। যেকোনো মূল্যে আসনটি ধরে রাখতে চায় বিএনপি। যদিও আসনটিতে জামায়াতে ইসলামী একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর।

ভিআইপি এই আসনে ভোটার সংখ্যা মোট চার লাখ ২৮ হাজার ৪২ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার দুই লাখ ১০ হাজার ৬৬৬ জন। আর নারী ভোটার দুই লাখ ১৭ হাজার ৩৭০ জন। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ৬ জন।

ভিআইপি আসনের কৌশল

বগুড়া-৬ আসন বিএনপির জন্য শুধু ভোটের লড়াই নয়, এটি দলের মর্যাদার প্রতীকও বটে। খালেদা জিয়ার আসনটি ধরে রাখা মানে বিএনপির স্থানীয় শক্তি, সাংগঠনিক প্রভাব এবং জনসমর্থনই নিশ্চিত করা। শহরের প্রতিটি পাড়া-মহল্লা, ব্যবসায়িক এলাকা পর্যন্ত দীর্ঘদিনের ত্রাণ, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রভাব রয়েছে বিএনপির।

তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। শারীরিক অবস্থার কারণে খালেদা জিয়ার সরাসরি নির্বাচনে অংশ নেওয়া অনিশ্চিত। এটি বিএনপির জন্য এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। কারণ নেত্রীর উপস্থিতি ও জনপ্রিয়তা ছাড়া আসন ধরে রাখা সহজ নয়। এ অবস্থায় এরইমধ্যে মনোনয়নের জন্য মাঠে নামতে শুরু করেছেন দলীয় নেতারা। এদের মধ্যে জনপ্রিয়তায় এগিয়ে রয়েছেন চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা একেএম মাহবুবুর রহমান। তিনি সদর উপজেলা বিএনপির পরিচিত মুখ। তার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, স্থানীয় স্তরে সাংগঠনিক শক্তি এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ তাকে একটি সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে দৃঢ় অবস্থানে রাখছে।

 

কেন্দ্রীয় হাইকমান্ডও এই বাস্তবতা মেনে নিচ্ছে। তাদের ধারণা, খালেদা জিয়া না দাঁড়ালে এমন একজন প্রার্থী দেওয়া উচিত, যিনি শুধু জনপ্রিয় নয়, তৃণমূলে দলের সংগঠন ও শক্তি বজায় রাখতে পারবেন। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শুধু ভোটে জেতা নয়, মহল্লা থেকে শহরের প্রতিটি ইউনিয়নে বিএনপির দীর্ঘমেয়াদি উপস্থিতি ধরে রাখা।

জানতে চাইলে একেএম মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমি দলের সিদ্ধান্তের বাইরে নই। দল যেটা চাইবে সেটাই হবে। এই আসনটি একটি প্রেস্টিজিয়াস আসন। আমরা বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের বাইরে ভাবি না। তারপরে না নিজে না দাঁড়ালে যাকে চাইবেন তিনি মাঠে লড়বেন। এই বাইরে নিজস্ব চাওয়া-পাওয়ার কোনো কিছু নেই।’

ভোটাররা বলছেন, ভিআইপি এই আসনে প্রার্থী যেই হোক না কেন, নির্বাচনের পর তিনি যেন নগরীর সমস্যাগুলো সমাধানে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। রাস্তা, জলাবদ্ধতা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাণিজ্য সবখানেই দৃশ্যমান কাজ দেখতে চান তারা।

 

জেলা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আরাফাতুর রহমান আপেলও নিজের ফেসবুক আইডিতে বগুড়া-৬ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন। তিনি লিখেছেন, দল চাইলে তিনি ভোটের মাঠে লড়াই করতে রাজি আছেন।

প্রতিদ্বন্দ্বিতার পথ সরল নয় জামায়াতের

বগুড়া-৬ আসনে এবার গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির প্রার্থী অধ্যক্ষ আবিদুর রহমান সোহেল। দীর্ঘ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, শিক্ষা ও সামাজিক সংগঠনে সক্রিয়তার কারণে শহরের জনসাধারণের কাছে পরিচিত তিনি। ভোটারদের কাছে শুধু রাজনৈতিক নেতা নন, বরং স্থানীয় সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট এক পরিচিত মুখ জামায়াতের এই প্রার্থী।

অধ্যক্ষ আবিদুর রহমান সোহেল বলেন, ‘আমি শুধু প্রতিদ্বন্দ্বী নই বরং একটি শক্তিশালী চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে চাই। ভোটারদের মনে জায়গা তৈরি করা এবং তাদের পাশে দাঁড়ানো আমার লক্ষ্য।’

তবে বাস্তবতা ভিন্ন। শহরে বিএনপি-আওয়ামী লীগের শক্তিশালী সাংগঠনিক উপস্থিতি তার জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে। মূল ভোটশক্তি তরুণ ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে আস্থায় আনতে পারলে একটা ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াতে পারেন এই প্রার্থী।

‘দল নয়, কাজের মানুষ চাই’

ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু দলীয় পরিচয় দেখে আর তারা ভোট দিতে চান না। চায়ের দোকান থেকে বাজারঘাট— সব জায়গায় একই প্রশ্ন, এই আসন থেকে আমাদের জন্য কাজ করবে কে?

শহরের ব্যবসায়ী আনোয়ারুল ইসলাম জাগো নিউজকে বললেন, ‘ভোটের সময় ভোট চাইতে আসে, তারপর আর দেখা যায় না। এবার এমন কাউকে চাই, যিনি বাস্তব কাজ করতে পারবেন। শুধু কথা নয়, ফলাফল দেখাতে হবে।’

নারী ভোটারদের প্রত্যাশাও স্পষ্ট। জাহানারা খাতুন নামের একজন বলেন, ‘আগে আমরা দল দেখে ভোট দিতাম, বিএনপি বা আওয়ামী লীগ। এবার সময় বদলেছে। আমরা চাই যোগ্য মানুষকে ভোট দিতে, যিনি আমাদের সমস্যা সমাধান করতে পারবেন। দলের নাম দেখে নয়, কাজের মানুষের জন্য ভোট দেবো। স্কুল, হাসপাতাল, রাস্তা সবখানেই কার্যকর পদক্ষেপ চাই।’

তবে শুধু নারী নয়, যুবকরা চান স্থানীয় বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি। প্রবীণরা স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চান। তাই যিনিই এই আসনে লড়বেন, এসব বিষয় মাথায় রাখতে হবে তাকে।

খালেদা জিয়ার ইঙ্গিত ও সম্ভাব্য চমক

বগুড়া-৬ আসনের রাজনৈতিক উত্তাপের কেন্দ্রে খালেদা জিয়া থাকায় বিএনপির নেতারা এখন পর্যন্ত বিক্ষিপ্ত হলেও সতর্ক। দলের ভেতরে বিভিন্ন সূত্রে খবর মিলেছে, শারীরিক অবস্থা বুঝে ভিআইপি এই আসনে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন বিএনপি চেয়ারপারসন।

শহরের রাজনৈতিক আড্ডা ও চায়ের দোকানে এই সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে। বিএনপির স্থানীয় নেতারা স্বীকার করেছেন, যদি খালেদা জিয়া নিজেই নামেন, পুরো ভোটের মানচিত্র বদলে যাবে। শুধু স্থানীয় নেতা নন, শহরের প্রতিটি মহল্লায় দলীয় শক্তি এক ধাপ এগিয়ে যাবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, খালেদা জিয়ার নামমাত্র অংশগ্রহণও প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্য মানসিক চাপ তৈরি করবে। দোটানা এই অবস্থায় ভোটারদের একাংশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন, আবার একাংশ অনিশ্চয়তায় রয়েছেন। শহরের বিভিন্ন এলাকায় চায়ের দোকান, বাজার এবং রাস্তাঘাট সবখানেই এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে—খালেদা জিয়া নামবেন কি-না?

দলের কেন্দ্রীয় হাইকমান্ডও সরাসরি ইঙ্গিত দিয়েছে, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রস্তুতি রাখা হবে। খালেদা জিয়ার অংশগ্রহণ শুধু ভোটের ফলাফলের বিষয় নয়, বরং এটি দলের রাজনৈতিক ভাবমূর্তি, মর্যাদা এবং তৃণমূল সংগঠনের শক্তি প্রদর্শনের ইঙ্গিত। স্থানীয় নেতা ও কর্মীরা বলছেন, যদি নেত্রী নামেন, আমরা আগের মতো আবারও পুরো জেলাজুড়ে মাঠে সক্রিয় হবো। নির্বাচনী প্রচারণা তখন এক নতুন মাত্রা পাবে।

কৌশল-চাপ-উত্তাপ

বগুড়া-৬ আসন এখন শুধু ভোটের স্থান নয়, বরং দুটি শক্তিশালী দলের কৌশল, পরিকল্পনা এবং রাজনৈতিক উত্তাপের মঞ্চে পরিণত হয়েছে। দল দুটি একযোগে শক্তি প্রয়োগ করছে কিন্তু ভিন্নভাবে। শহরের তরুণ ভোটার, প্রগতিশীল বাণিজ্যিক এলাকা এবং শহরের শিক্ষিত সম্প্রদায়কে টার্গেট করতে চাচ্ছে জামায়াত। তারা আশা করছেন, নতুন প্রজন্মের ভোটাররা দলীয় আনুগত্য নয়, উন্নয়ন ও কার্যকর নেতৃত্বের ওপর ভোট দেবেন। শহরের বিভিন্ন বাজার ও কলেজ এলাকায় তাদের প্রচারণা তুঙ্গে। কিন্তু বিএনপির দীর্ঘদিনের তৃণমূল সংগঠন ও পরিচিতি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে দলটির জন্য।

অন্যদিকে কোনোভাবেই এই ‘ভিআইপি আসন’ হাতছাড়া করতে চাইবে না বিএনপি। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, খালেদা জিয়ার শারীরিক পরিস্থিতি অনুযায়ী পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে। যদি তিনি দাঁড়ান তবে পুরো প্রচারণা পুনরায় সাজানো হবে। আর যদি না দাঁড়ান, একেএম মাহবুবুর রহমান বা অন্য জনপ্রিয় ও সাংগঠনিক শক্তিশালী নেতাকে মনোনয়ন দিয়ে দলের ঘাঁটি ধরে রাখার কৌশল নেওয়া হবে। এই আসনে বাকি অন্য রাজনৈতিক দলের প্রার্থীকে এখনো মাঠে দেখা যায়নি।