Image description

কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক অরাজনৈতিক প্ল্যাটফরম হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। মুসলমানদের ঈমান-আকিদা রক্ষায় ২০১০ সালের ১৯শে জানুয়ারি গঠিত এই সংগঠনটি এরমধ্যে বিভিন্ন প্রতিকূলতা পার করেছে। শাপলা ট্র্যাজেডির মতো পরিস্থিতির মুখোমুখিও হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হেফাজতকে ভাঙার কয়েকবার চেষ্টা করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য কয়েকজন শীর্ষ নেতা সংগঠন থেকে বের হয়েও গেছেন। এত ঘাত-প্রতিঘাত পার করেও টিকে আছে হেফাজত। তবে এই অনুকূল সময়ে এসে আদর্শিক ও পলিসিগত বিভক্তি দেখা দিয়েছে সংগঠনটিতে। মূলত হেফাজত আমীর আল্লামা মহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর বৃহত্তর একটি  রাজনৈতিক দলের প্রতি অত্যধিক ঝুঁকে পড়া ও সংগঠনটির তরুণ নেতৃত্বের একটি অংশের আলাদা চিন্তাভাবনার কারণে এই বিভক্তি তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া হাটহাজারী মাদ্রাসা কেন্দ্রিক একটি অংশের সঙ্গে ঢাকার নেতাদের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে।

জানা যায়, অরাজনৈতিক হেফাজতের রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়াকে কেন্দ্র করে মূলত হেফাজতে বিভক্তি তৈরি হয়েছে। আমীর আল্লামা মহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর বিএনপি’র প্রতি বিশেষ টানকে ভালোভাবে দেখছেন না তরুণ একটি অংশ। বাবুনগরী কয়েকজন নেতার প্ররোচনায় আরেকটি ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দল জামায়াতের বিরুদ্ধে নিয়মিত বিষোদ্গার করছেন বলে অভিযোগ করছেন তারা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এটা নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। হেফাজতের একটি সূত্র জানিয়েছে, অরাজনৈতিক সংগঠন হলেও হেফাজতে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক অনেক ইসলামী দলের শীর্ষ নেতারা আছেন। এ ছাড়া জামায়াত ও চরমোনাই সমর্থক বেশ কয়েকজন আলেমও হেফাজতে আছেন। যদিও সেখানে তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর সুযোগ নেই।

গত বছরের ৫ই আগস্টের পর আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে  ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর একটা জোট হওয়ার কথাবার্তা শুরু হয়। মূলত এরপর থেকেই তৈরি হয় বিভাজন। আল্লামা মহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীসহ একটি অংশ বিএনপি’র সঙ্গে দলগুলোকে যাওয়ার পরামর্শ দেন। আরেকটা অংশ জামায়াত চরমোনাই তথা ইসলামী জোটের দিকে আগ্রহ দেখান। এরমধ্যে আল্লামা মহিব্বুল্লাহ বিভিন্ন প্রোগ্রামে গিয়ে জামায়াতকে কাদিয়ানী উপাধি দেয়াসহ বিভিন্ন বক্তব্য দেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১লা আগস্ট হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর সঙ্গে ফটিকছড়িতে এসে সাক্ষাৎ করেন বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও সালাহউদ্দিন আহমদ। তারা এসে তারেক রহমানের তরফ থেকে হেফাজতের আমীরকে সালাম পৌঁছে দেন এবং দোয়াও চান। এ ছাড়া ফটিকছড়ি থেকে বিএনপি’র এক মনোনয়প্রত্যাশী নেতা হেফাজত আমীরের সঙ্গে বিএনপি’র পক্ষ হয়ে নিয়মিত যোগাযোগ করছেন। সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিএনপিপন্থি জমিয়তে উলামা ইসলামের সভায় বাবুনগরী উপস্থিত থেকে নিজের অবস্থান অনেকটা স্পষ্ট করেন।

নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক হেফাজতের একজন সিনিয়র নেতা দৈনিক মানবজমিনকে বলেনে, হেফাজতে ইসলাম একটি অরাজনৈতিক প্ল্যাটফরম। তবে বর্তমানে কিছু নেতা নিজের সুবিধার জন্য হেফাজতকে ব্যবহার করছেন। তারা হেফাজতের মূল স্পিরিট নষ্ট করছে। আগে আওয়ামী লীগ থেকে সুবিধা নিয়ে কিছু ব্যক্তি আমাদের রাহবার আল্লামা শফি সাহেবকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। এখন আবার গুটিকয়েক ব্যক্তি বিএনপি থেকে সুবিধা নিয়ে আল্লামা মহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, আল্লামা বাবুনগরী ‘খালেস’ মানুষ। তিনি আমাদের মুরব্বি। তবে উনি বায়োবৃদ্ধ অসুস্থ। উনাকে মাঠের পরিস্থিতি বুঝতে দেয়া হচ্ছে না। কয়েকজন ব্যক্তি উনাকে ঘিরে রেখেছে। আল্লামা শফি সাহেবকে যেভাবে ছেলে মাওলানা আনাসসহ কিছু ব্যক্তি কব্জা করে রেখেছিল, বাবুনগরী হুজুরের সঙ্গেও এমনটি হচ্ছে। তবে এর কারণে সংগঠন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

হেফাজতের আরেক জন শীর্ষ নেতা জানান, মূলত ইসলামী জোট গঠনের চেষ্টার কথা শুরুর পর থেকে বিভক্তি তৈরি হয়েছে। হেফাজতে থাকা জমিয়য়তসহ কয়েকটি দল বিএনপি’র সঙ্গে জোট করে নির্বাচনে যেতে চায়। তারা এক্ষেত্রে বিএনপি’র প্রতি আমাদের আমীরের সফট কর্নারকে ব্যবহার করছে। আর খেলাফত মজলিসসহ আরেকটা অংশ চাচ্ছে জামায়াত-চরমোনাইয়ের নেতৃত্বে গঠিত জোটে যেতে। এটা নিয়ে মূলত তৈরি ঝামেলা। আল্লাহ না করুক, এই টানাটানিতে এবার হেফাজতে সর্বনাশ ডাকতে পারে। এখন হেফাজতকে বাঁচাতে হলে একে আগের মতো অরাজনৈতিক প্ল্যাটফরমে ফিরতে হবে।

গত ১১ই সেপ্টেম্বর হাটহাজারীর ডাক বাংলো চত্বরে ‘আল্লামা জোনায়েদ বাবুনগরী:  জীবন কর্ম ও অবদান’ শীর্ষক একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় হেফাজত আমীর আল্লামা মহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীও উপস্থিত ছিলেন। সেখানে ঢাকা থেকে আসা বিশিষ্ট ওয়ায়েজ মুফতি নুর হোসেন নুরানী বলেন, আমাদের লাখো নেতাকর্মী, বিশেষ করে কওমি মাদ্রাসার ছাত্রসমাজ যেভাবে আওয়ামী লীগের হেফাজত চাই না, তারা খালেদা জিয়ার হেফাজতও চাই না। হেফাজত নিয়ে ব্যবসা বাণিজ্য করবেন, রাজনীতির বেচাকেনা করবেন। আমীরে হেফাজত, আল্লাহর ওয়াস্তে এটার খোঁজখবর নিয়ে ইনসাফের সঙ্গে বিচার করুন। সেসময় উপস্থিত ছাত্রজনতা সমস্বরে তার বক্তব্যকে সমর্থন করেন।

এদিকে, হেফাজত আমীরের বর্তমান অবস্থান ও জামায়াত নিয়ে নিয়মিত সমালোচনাকে তার ব্যক্তিগত মতামত বলে জানিয়েছেন কয়েকজন নেতা। আবার কয়েকজন বলছেন, জামায়াতের সঙ্গে আকিদাগত কিছু বিরোধ অবশ্যই আছে। তবে জামায়াত এখনো এটার সমাধান করছে না। যে কারণে হেফাজত আমীর তার নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। তাদের একজন মাওলানা আশরাফ বিন ইয়াকুব। জামায়াতকে নিয়ে হেফাজত আমীরের নিয়মিত সমালোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসন থেকে খেলাফত মজলিসের এমপি প্রার্থী এ হেফাজত নেতা বলেন, আল্লামা বাবুনগরী আমাদের মুরব্বি। ঈমান-আকিদার বিষয়ে উনি উনার ব্যক্তিগত মতামত দিতেই তো পারেন। বিএনপি নাকি জামায়াত চরমোনাই জোট, কোনটাকে আপনি ব্যক্তিগতভাবে প্রাধান্য দিবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি একটি ইসলামী দল করি। আমার দলের নেতা আল্লামা মামুনুল হক। এক্ষেত্রে উনার মতামতই আমার মতামত।