
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রায় ৩০০ আসনে প্রাথমিক মনোনয়ন দিয়েছে জামায়াত। এসব আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীরা বেশ কিছুদিন থেকেই নির্বাচনী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে নির্বাচনে নির্ধারিত আসনে বেশি জোর দেবে দলটি। ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচনী জোট হলে একশ’ আসন ছেড়ে দেয়ার পরিকল্পনা করছে জামায়াত। এর বাইরে দেড় শতাধিক আসনে জোরালো অবস্থান নেয়ার পরিকল্পনা করছে দলটি।
রাজধানীর কাফরুল-মিরপুর এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকা-১৫ আসনে আগামী নির্বাচনে লড়বেন জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান। ইতিমধ্যে এ আসনে একাধিকবার নির্বাচনী জনসংযোগ করেছেন জামায়াতের এই শীর্ষ নেতা। বাইপাস সার্জারির কারণে প্রায় ৩৩ দিন চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় তার পক্ষে নির্বচনী প্রচার কাজ চালিয়েছেন ঢাকা মহানগর উত্তরের আমীর মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিনসহ মহানগরের অন্য নেতারা। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও তিনি এ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এবারের নির্বাচনে জামায়াতের সর্বোচ্চ নেতার এই আসনের প্রতি নজর থাকবে দলসহ সারা দেশের।
দলটির নায়েবে আমীর অধ্যাপক মুজিবুর রহমান রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসন থেকে ১৯৮৬ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এবারও ওই আসনে তার প্রার্থিতা প্রায় নিশ্চিত। দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে এই আসনের প্রতি দৃষ্টি দেবেন দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী সমর্থকরা। কুমিল্লা-১১ (চৌদ্দগ্রাম) আসনে ২০০১ সালে নির্বাচনে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জামায়াতের নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। আসন্ন নির্বাচনেও তিনি এই আসনে জামায়াতের সম্ভাব্য প্রার্থী। ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বর্তমান জামায়াতের অন্যতম নীতি-নির্ধারক। একজন হেভিওয়েট প্রার্থী হিসেবে আগামী নির্বাচনে এই আসনে দৃষ্টি নিবন্ধিত থাকবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের।
খুলনার ফুলতলা-ডুমুরিয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত খুলনা-৫ আসন। ২০০১ সালের নির্বাচনে এই আসন থেকে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার। আগামী নির্বাচনেও তিনি এই আসনে দাঁড়িপাল্লা মার্কা নিয়ে লড়বেন। নির্বচনী প্রচার কাজে প্রতি সপ্তাহে এলাকায় ব্যস্ত সময় পার করেন তিনি। জামায়াতের দায়িত্বশীল নেতা হিসেবে আগামী নির্বাচনে এই আসন নিয়ে কৌতূহল থাকবে জাতীয় রাজনীতিতে।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড. এএইচএম হামিদুর রহমান আযাদ ২০০৮ সালে কক্সবাজার-২ (কুতুবদিয়া- মহেশখালী) আসন থেকে নির্বাচিত হন। আগামী নির্বাচনে এ আসনে তার প্রার্থিতা প্রায় নিশ্চিত। ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি হামিদুর রহমান আযাদ একজন হেভিওয়েট প্রার্থী। বর্তমান জামায়াতের প্রথম সারির অন্যতম নীতি-নির্ধারক। নির্বাচনী তৎপরতায় প্রতি সপ্তাহে এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন তিনি। তার এই আসন নিয়েও আগামী নির্বাচনে যথেষ্ট কৌতূহল থাকবে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
অবিভক্ত ঢাকা মহানগর জামায়াতের সাবেক আমীর মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বর্তমান জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল। সিরাজগঞ্জ-৪ (উল্লাপাড়া) আসনে তিনি দাঁড়িপাল্লা প্রতীকে লড়বেন বলে দলের পক্ষ থেকে জানা যায়। তিনিও গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থী হিসেবে দৃষ্টিতে থাকবেন পর্যবেক্ষক মহলের। ফাঁসির মঞ্চ থেকে রাজনৈতিক ময়দানে ফিরে আসা জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের সিনিয়র সদস্য এটিএম আজহারুল ইসলাম রংপুর-২ (তারাগঞ্জ-বদরগঞ্জ) আসনে দলটির সম্ভাব্য প্রার্থী। প্রায় সাড়ে ১৪ বছর কারাবন্দি থাকার পর সম্প্রতি তিনি ফাঁসির দণ্ডাদেশ থেকে খালাস পান। এরপর থেকেই নির্বাচনী এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন জামায়াতের বর্ষীয়ান এই নেতা। নানা কারণে আগামী নির্বাচনে রংপুর-২ আসনেও দৃষ্টি থাকবে পর্যবেক্ষক মহলের। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের আমীর নুরুল ইসলাম বুলবুল চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ (চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর) আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী। ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি বুলবুলও নির্বাচনী মাঠে শক্ত প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া তরুণ এবং আলোচিত প্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠে কোমরকষে লড়বেন সিলেট-৬ (বিয়ানীবাজার- গোলাপগঞ্জ) আসনে ঢাকা মহানগর উত্তরের আমীর মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, সুনামগঞ্জ-২ (দিরাই-শাল্লা) আসনে এডভোকেট শিশির মনির, পটুয়াখালী-২ (বাউফল) আসনে ঢাকা মহানগর দক্ষিনের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ, ঢাকা-১৩ আসনে মুহাম্মদ মোবারক হোসাইন, বরিশাল-৫ আসনে মোয়াযযম হোসাইন হেলাল, বগুড়া-১ আসনে অধ্যক্ষ সাহাবুদ্দিন, কুষ্টিয়া-৩ (কুষ্টিয়া সদর) আসনে মুফতি আমির হামযা, ময়মনসিংহ-৫ আসনে জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ।
এ ছাড়া আসন্ন নির্বাচনে ৩৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সী তরুণ নেতৃত্বকে সামনে আনার চেষ্টা করছে দলটি। সে হিসেবে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলায় দণ্ডিত নেতাদের সন্তানদের মধ্য থেকেও এবার প্রার্থী করা হচ্ছে। যেমন- জামায়াতের সাবেক আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর পুত্র নাজিবুর রহমান মোমিন (পাবনা-১), মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছোট ছেলে মাসুদ সাঈদী (পিরোজপুর-১) ও বড় ছেলে শামীম সাঈদী (পিরোজপুর-২) এবং মীর কাসেম আলীর ছেলে আইনজীবী মীর আহমদ বিন আরমান (ঢাকা-১৪) আসনে প্রার্থী হবেন। এসব আসনের প্রতিও মনোযোগ থাকবে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী সমর্থকদের। ইতিমধ্যে তারা নির্বাচনী এলাকায় সাংগঠনিক কার্যক্রমসহ প্রচারণা চালাচ্ছেন। তাদের মধ্যে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছোট ছেলে মাসুদ সাঈদী ২০১৪ সালে পিরোজপুরের জিয়ানগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, দলের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী পর্ষদ কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের ২০ সদস্যের মধ্যে এবার পাঁচজন ছাড়া সবাই নির্বাচন করছেন। নির্বাচন না করলেও নির্বাচনী গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকবেন আ ন ম শামসুল ইসলাম, আবদুর রব, মাওলানা এটিএম মা’ছুম, মাওলানা আবদুল হালিম ও এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জোবায়ের।
জামায়াতের নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্টরা জানান, গত কয়েক মাসের তৎপরতায় তৃণমূল থেকে যে আওয়াজ পাচ্ছেন, তাতে তারা বেশ আশাবাদী। বিশেষ করে ডাকসু ও জাকসু নির্বাচন তাদের আত্মবিশ্বাস কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এই নির্বাচনের প্রভাব আগামী জাতীয় নির্বাচনেও পড়বে এমন মন্তব্য করেছেন স্বয়ং জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান। সম্প্রতি এক সভায় তিনি বলেছেন, আল্লাহ্র খাস রহমতে ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবির বিজয় লাভ করেছে। এ বিজয়ে অনেকেই অভিভূত হয়েছেন। এ নির্বাচনের প্রভাব আগামী জাতীয় নির্বাচনেও পড়বে ইনশাআল্লাহ্।
এছাড়া জামায়াতের নিজস্ব জরিপসহ বিভিন্ন সংস্থার জনমত জরিপও তাদের আশাবাদী করছে। দলের নিজস্ব জরিপে, রংপুর বিভাগের ৩৩ আসনের সবক’টি, খুলনার ৩৫ আসনের সব, রাজশাহীর ১১টি, বরিশালের ৩টি, চট্টগ্রামের ১২টি, সিলেটের ৬টি, ময়মনসিংহের ২টি এবং ঢাকার বেশ কয়েকটি আসনে জামায়াত শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলবে।