
বিবিসি বাংলাকে দেওয়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাক্ষাৎকার সম্পর্কে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম মহিউদ্দিন গতকাল সোমবার কালের কণ্ঠকে বলেন, বিশেষ পরিস্থিতিতে দেশ ত্যাগ করার দীর্ঘ ১৭ বছর পর কোনো গণমাধ্যমে (বিবিসি বাংলা) মুখোমুখি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তার সাক্ষাৎকারে যেসব বিষয় এসেছে তার মধ্যে রয়েছে—১. বাকস্বাধীনতা ও গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ; ২. জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ও তাঁর ভূমিকা; ৩. দেশে ফেরা ও নির্বাচনের প্রস্তুতি; ৪. বিএনপির প্রার্থী মনোনয়ন কৌশল; ৫. নির্বাচনে দল কোন কোন বিষয়ে অগ্রাধিকার দেবে; ৬. তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে চান কি না; ৭. দুর্নীতি মোকাবেলার কৌশল; ৮. জামায়াতের সম্ভাব্য জোট গঠনের বিপরীতে বিএনপি কী কৌশল নেবে ইত্যাদি।
এসব প্রসঙ্গে তিনি কী বলেছেন পাঠকরা এরই মধ্যে তা জেনেছেন। আমি সেগুলোর বিস্তারিত উল্লেখ করতে চাই না, তবে তাঁর বক্তব্যের মূল বিষয়বস্তু তুলে ধরতে চাই।
এই সাক্ষাৎকারে তারেক রহমান নিজের অবস্থানকে তুলে ধরেছেন একজন নির্যাতিত কিন্তু দৃঢ় রাজনীতিক ও গণতন্ত্রকামী জনগণের সম্মিলিত আন্দোলনের অংশীদার হিসেবে।
দুর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি স্বীকার করেন যে দুর্নীতি বাংলাদেশের একটি সামাজিক ব্যাধি এবং এটি রাতারাতি দূর করা সম্ভব নয়। তিনি অতীতের অভিযোগ অস্বীকার না করে ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা করছেন, এটি প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক দেশের রাজনৈতিক নেতার বৈশিষ্ট্য।
জামায়াতে ইসলামী বা অন্য দলের সঙ্গে জোট গঠন প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, সংবিধান যদি কোনো দলকে বৈধতা দেয়, তবে তারা রাজনীতি করতে পারবে।
বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তারেক রহমানকে দেশের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভাবা হয়। বিশেষ করে বিএনপির বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান। কিন্তু দল বিজয়ী হলেও তিনি নিজেকে সরাসরি ‘প্রধানমন্ত্রী দাবি’ করবেন না—এমনটি জোরের সঙ্গে বলেছেন।
এই সাক্ষাৎকারের গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তারেক রহমান পাঠকের সঙ্গে কিভাবে যোগাযোগ স্থাপন করছেন, সেটা বুঝতে পারা জরুরি। দীর্ঘ ১৭ বছর প্রবাসে থাকার ফলে তাঁর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চিন্তার যে পরিবর্তন হয়েছে সেটা বোঝাও জরুরি। পুরো সাক্ষাৎকারে তাঁর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ধরন, ভাষার ধরন, শিষ্টাচার ও কমিটমেন্ট থেকে তাঁর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও কৌশলগত অবস্থান সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
২০০৮ সালের পর থেকে তারেক রহমান লন্ডনে স্বনির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। এই সময়কালটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং সেই সঙ্গে সংকটে আবর্তিত ছিল—তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করে দেওয়া; শেখ হাসিনার ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতায় থাকা এবং বিএনপির সাংগঠনিক ভাঙন ও সীমাবদ্ধতার সময়। দীর্ঘ ১৭ বছর তাঁর লন্ডনবাস শুধু ব্যক্তিগত আশ্রয় নয়, বরং নিজেকে আগামী দিনের জন্য প্রস্তুত করা রাজনীতির হালচাল পর্যবেক্ষণের সময়কাল।
পাঠকের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগভঙ্গি ও রাজনৈতিক বক্তব্যে পশ্চিমা প্রভাব লক্ষণীয়। বিশেষ করে সাক্ষাৎকারে দেখা যায় তাঁর ভাষা সংযত, পরিমিত ও যুক্তিসংগত, যা পশ্চিমা রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি বড় বৈশিষ্ট্য। পাঠক বিভ্রান্ত হবেন এমন শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করেননি, বরং অত্যন্ত স্পষ্ট ও নমনীয়ভাবে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। তিনি নিজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন না, জনগণের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দিচ্ছেন। যেমন তিনি বলেছেন, ‘আমি মনে করি, জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত’, ‘আমাদের কাজ হবে প্রমাণের মাধ্যমে বিশ্বাস অর্জন করা’—এই বাক্যগুলোতে পশ্চিমা রাজনৈতিক নেতাদের শিষ্টাচারের ছাপ স্পষ্ট, বাংলাদেশি রাজনীতির প্রচলিত কনফন্ট্রেশনাল টোন থেকে একেবারে আলাদা।
লন্ডনে দীর্ঘ সময় থাকা তাঁকে সরাসরি জনগণের সঙ্গে যোগাযোগহীন করে তুলেছে, তবে এর বদলে তিনি ‘মিডিয়া-সেন্ট্রিক পলিটিকস’-এর দক্ষতা অর্জন করেছেন। তিনি গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের মাধ্যমে বক্তব্য প্রকাশে দক্ষ হয়েছেন, প্রবাসে থেকেও জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে আছেন, নিজের দল পরিচালনা করছেন, যা তাঁর রাজনৈতিক যোগাযোগ দক্ষতার প্রমাণ দেয়। তারেক রহমান সাক্ষাৎকারে বারবার জনমত, নীতি, আইন ও প্রক্রিয়ার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি জোরের সঙ্গে বলেছেন, রাজনৈতিক দলের কাজ অবশ্যই পুলিশিং করা নয়, বরং তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, যাদের কাজ পুলিশিং করা তারা কেন তাদের কাজটি করছে না। তারা কেন তাদের কাজে ব্যর্থ?
লন্ডনের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে রাজনীতিকদের বক্তব্য সাধারণত সংযত ও প্রটোকলনির্ভর হয়ে থাকে। তারেক রহমানের শরীরী ভাষা (যেমন—ভিডিও সাক্ষাৎকারে হাত নাড়ার সীমিত ব্যবহার, স্থির দৃষ্টি, মৃদু স্বর) ও বাক্য গঠন—সবই উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রভাব।