Image description

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ভোরে একজনকে এবং সকাল হতেই আরও একজনকে একই কায়দায় রাস্তায় পিটিয়ে হত্যা করা হয় । এরপর রটানো হয় , ছিনতাইকারী সন্দেহে গণপিটুনিতে দুই তরুণের মৃত্যু হয়েছে । পুলিশও একই সুরে গণপিটুনির তথ্য ছড়িয়ে দেয় গণমাধ্যমে । আজকের পত্রিকার অনুসন্ধানে দেখা গেছে , ছিনতাইয়ের সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ কেউ তোলেনি । দুই তরুণকে পূর্বপরিকল্পনা করে তাঁদের বাসার কাছে একই জায়গায় ২ ঘণ্টার ব্যবধানে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে । যাঁরা পিটিয়েছেন এবং যাঁরা নিহত হয়েছেন — সবাই পূর্বপরিচিত , একই এলাকার বাসিন্দা ।

গত ১০ সেপ্টেম্বর ভোররাত ও সকালে মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিংয়ের ১৬ নম্বর সড়কের মাথায় সাঁকোরপাড় এলাকায় দুই দফায় চার তরুণকে পেটানো হয় । ভোররাত সাড়ে ৪ টায় মারধরের শিকার হন মো . সুজন ওরফে বাবুল ও মো . শরীফ । পরে সকাল সাড়ে ৬ টায় একই স্থানে আবারও মারধর করা হয় মো . হানিফ ও মো . ফয়সালকে । এতে সুজন ও হানিফ নিহত হন । গুরুতর আহত শরীফ ও ফয়সালকে ছিনতাই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠায় পুলিশ । নিহত সুজনের গ্রামের বাড়ি ভোলার বোরহানউদ্দিনে । ঢাকার মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যানের বি- ব্লকের ৪ নম্বর সড়কের একটি ভাড়া বাসায় বাবা টাইলস মিস্ত্রি জাহাঙ্গীর আলম, মা শাহনাজ বেগমের সঙ্গে থাকতেন । মাঝেমধ্যে বাবার সঙ্গে টাইলসের কাজও করতেন তিনি । সুজন ৯ সেপ্টেম্বর রাতে নবীনগর হাউজিংয়ে চাচাতো বোনের বাসায় খাওয়ার পর বন্ধু শরীফের সঙ্গে স্থানীয় সাদিক অ্যাগ্রোর গরুর খামারে যান । খামারকর্মী মনিরুলের কক্ষে তাঁরা ঘুমান । ভোররাত ৪ টার পর নৈশপ্রহরী মালেক , হাবীবসহ ৭-৮ জন তাঁদের খামার থেকে তুলে নবীনগরের ১৪ নম্বর সড়কের মাথায় সাঁকোরপাড় এলাকায় নিয়ে যান ।

এই প্রতিবেদক ২৩ সেপ্টেম্বর ওই গরুর খামারে গেলে কর্মচারী মো . মিলন বলেন , খামারে থাকতে দেওয়ার কারণে মনিরুলকেও মারধর করা হয় । প্রত্যক্ষদর্শী সোনিয়া আক্তার সুমি জানান , নবীনগর ১৬ নম্বর সড়কে তাঁর বাসা । তিনি চিৎকার শুনে বাইরে এসে দেখেন , কয়েকজন লোক সুজন ও শরীফকে ১৪ নম্বর সড়কের মাথায় নিয়ে যাচ্ছে । সেখানে নৈশপ্রহরী হাবীব , মালেক , শাহাবুদ্দিন , আক্তার , নুরু , হাসনাইন , শাহীন , চা - দোকানি জহিরুল ওরফে জাহিদ ও আল আমিন মিলে তাঁদের মারধর করেন ।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনার পাশাপাশি সুজন ও শরীফকে মারধরের তিনটি ভিডিও আজকের পত্রিকার হাতে এসেছে । স্থানীয়দের নিয়ে ভিডিও বিশ্লেষণে দেখা গেছে , হামলাকারীদের মধ্যে রয়েছেন বাঁশ ব্যবসায়ী আক্তার হোসেন , নৈশপ্রহরী হাবীবুর রহমান হাবীব ও মালেক , মুরগি ব্যবসায়ী আল আমিন ও তাঁর কর্মচারী শাহীন , মকবুল , চা - দোকানি জহিরুল ওরফে জাহিদ , কবির , নূরু মিয়া , শামসু ও তাঁর ছেলে শাহাবুদ্দিন । সেদিন খবর পেয়ে ভোররাতে মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক ( এসআই ) আক্তারুজ্জামান প্রথম ঘটনাস্থলে যান । তিনিই হামলাকারীদের গণপিটুনির কথা শিখিয়ে দেন বলে অভিযোগ করেছেন আহত শরীফের ভাই ।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে এসআই আক্তারুজ্জামান বলেন , ভোররাতে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান । সেখানে থাকা কেউ মারধরের কথা স্বীকার করেননি । পরে তিনি দুজনকে হাসপাতালে নিয়ে যান । সকাল সাড়ে ৬ টার দিকে মো . ফয়সাল ও মো . হানিফ নামের আরও দুজনকে একই জায়গায় মারধর করা হয় । তাঁরা দুজনে একটি হোটেলে নাশতা করতে যাচ্ছিলেন — এ সময় একই লোকজন আকবরের চায়ের দোকানের সামনে তাঁদের আটকায় ।

ভিডিওতে দেখা গেছে , ফয়সালকে পাঁচজন এবং হানিফকে তিনজন মিলে পেটাচ্ছে । কবির , নৈশপ্রহরী মালেক ও হাবীব মিলে হানিফকে পিটিয়ে ফুটপাতে অচেতন অবস্থায় ফেলে রাখেন । এ ঘটনার সময় পোশাকশ্রমিকেরা কারখানায় যাচ্ছিলেন । তাঁদের একজন শিউলী বেগম । তিনি বলেন , সেদিন তাঁরা কারখানায় যাওয়ার সময় দেখেন , দুই ব্যক্তিকে ৮-৯ জনে মিলে মারধর করছেন । ঠেকানোর চেষ্টা করেন ফয়সালের ভাই মো . রবিউল ও তাঁর স্ত্রী সোনিয়া আক্তার সুমি । সোনিয়া ঘটনার সময়ের একটি ভিডিওতে নিজেকে দেখিয়ে বলেন , পিটুনি ঠেকাতে গেলে তাঁর স্বামী রবিউলকেও মারধর করে আল আমিন , মালেক , নূরু , হাবীব , শাহাবুদ্দিন , শাহ আলম । নিহত হানিফ নবীনগর হাউজিংয়ের ১৪ নম্বর সড়কের শেষ মাথার একটি বাসায় মা - বাবা ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন । তিনি একটি পাম্পের কর্মচারী ছিলেন । তাঁকে হত্যার ১৭ দিন আগে গ্রামের বাড়ি বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে তাঁর স্ত্রী ঝুমু প্রথম কন্যাসন্তানের মা হন । হানিফ সেই সন্তানকেও দেখে যেতে পারেননি বলে স্ত্রী আফসোস করেন ।

হানিফের বাবা সাদেক হাওলাদার বলেন , প্রথম ঘটনার পর পুলিশ যদি হামলাকারীদের ধরত , জেরা করত , তাহলে দ্বিতীয় ঘটনা ঘটত না । তিনি বলেন , হানিফকে হত্যায় অভিযুক্ত আক্তার তাঁর ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী । সরকার পরিবর্তনের পর সে বিএনপির রাজনীতি শুরু করেছে , হাউজিংয়ের নিরাপত্তার দায়িত্ব পেয়েছে । চার - পাঁচ দিন আগে থেকে পরিকল্পনা করে তারা দুজনকে পিটিয়ে মারছে । নিহত ব্যক্তিদের পরিবার অভিযোগ করেছে , চারজনকে পিটুনির নেতৃত্বে ছিলেন আক্তার হোসেন । যাঁরা হামলায় অংশ নিয়েছেন , তাঁরা সবাই আক্তারের লোক হিসেবেই পরিচিত । মূল অভিযুক্ত আক্তার হোসেনকে নবীনগর হাউজিংয়ের ১২ নম্বর সড়কের বাসায় গিয়ে পাওয়া যায়নি । তাঁর স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন , ঘটনার দিন ভোরে নৈশপ্রহরীরা ফোন দিয়ে তাঁর স্বামীকে ( আক্তার ) বাসা থেকে ডেকে নেন । এরপর থেকে তিনি আর বাসায় নেই ।

নিহত হানিফের বড় ভাই আক্তার হোসেন বলেন , যারা মেরেছে , তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে চাইলে পুলিশ মামলা নেয়নি । ২০-২৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে পুলিশ তাঁর স্বাক্ষর নিয়েছে । মোহাম্মদপুর থানার ভরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ( ওসি ) কাজী রফিক বলেন , গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে তথ্য ছিল । নিহত একজনের ভাই অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করেছেন । তদন্তে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে , তাদের আইনের আওতায় আনা হবে । তিনি আরও বলেন , নিহত দুজনের বিরুদ্ধে চারটি করে মাদক ও ছিনতাইয়ের মামলা ছিল । আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ( আসক ) তথ্যানুযায়ী , চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে ১২৪ জনকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়েছে । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড . মো . তৌহিদুল হক আজকের পত্রিকাকে বলেন , “ খুঁজলে দেখা যাবে প্রতিটি গণপিটুনির ঘটনাই পরিকল্পিত । ব্যক্তিগত শত্রুতা , রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও বিভিন্ন মতবিরোধকে ঘিরে গণপিটুনির নামে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে । শুরুতে যদি জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনা হতো , তাহলে এ রকম ঘটনা বারবার ঘটত না । ’