
প্রত্যাশা অনুযায়ী সেপ্টেম্বর মাসে দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারলেও অক্টোবরে লক্ষ্য অর্জন করতে মরিয়া স্বার্থান্বেষী কুচক্রী মহল। প্রতিবিপ্লব করে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বানচাল করা এবং ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে পুরোনো চেহারায় ফিরিয়ে আনতে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তি দেশি-বিদেশি দোসরদের সহায়তায় অনেকটা মরণ কামড় দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে অক্টোবরে। প্রধান লক্ষ্য-যে কোনো মূল্যে অন্তর্বর্তী সরকারকে হটানো।
পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্র যুগান্তরকে জানায়, সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের টার্গেট করে গুপ্ত হামলা, চিহ্নিত ছিনতাইকারী ও ডাকাতদের সংঘটিত করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটানো, ঝটিকা মিছিলে বাধা দিলে সফলভাবে পালটা হামলা চালিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনোবল ভেঙে দেওয়া এবং এক ঘণ্টার ব্যবধানে হঠাৎ ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে লাখো লোক জড়ো করা প্রভৃতি পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
ইতোমধ্যে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা সরকারের উচ্চপর্যায়ে এ বিষয়ে বিভিন্ন ধারণাপত্র ও সতর্কবার্তা দিয়ে রেখেছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে হালনাগাদ সঠিক গোয়েন্দা তথ্য প্রদান এবং সে অনুযায়ী আগাম প্রতিরোধ ব্যবস্থা কার্যকর করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
একটি সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে গোপনীয় তথ্য আদান-প্রদানে পুলিশের সিক্রেট অ্যাপস গ্রুপে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিজেদের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা আওয়ামী কানেকশনধারী সদস্যদের নিয়ে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এজন্য সন্দেহভাজন এসব সদস্যের সার্বিক গতিবিধি অনুসরণ করতে অলিখিত কাউন্টার ইন্টিলিজেন্স টিম সেট করা হয়েছে।
এদিকে অক্টোবর ঘিরে আওয়ামী লীগের মাস্টারপ্ল্যান সম্পর্কে ইতোমধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও লাইন অব অ্যাকশান প্ল্যান জানতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
সূত্র বলছে, মূলত পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে ভারতে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের একটি কোর গ্রুপ থেকে। তাদের মিশন বাস্তবায়নে সারা দেশে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের হাজার হাজার নেতাকর্মী আত্মগোপনে থেকে নাশকতার ছক কষছে। এদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় প্রতিদিন ঝটিকা মিছিল বের করা হয়। ইতোমধ্যে এ চক্রের অনেককে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। বাকিদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে। তবে বিপদের বিষয় হলো—অভিযানের অনেক তথ্য নিজেদের মধ্য থেকে ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। এজন্য কিছু অভিযান ব্যর্থও হয়েছে।
জানতে চাইলে অতিরিক্ত আইজিপি (অপরাধ ও অপস) খোন্দকার রফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘পরাজিত শক্তি নানাভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্ন করার অপচেষ্টা করছে। দুর্গাপূজার মধ্যে ধর্মীয় সেনসিটিভিটি কাজে লাগিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের চক্রান্ত করা হচ্ছে। এ কাজে দেশের বাইরে থেকেও নানাভাবে ইন্ধন দেওয়া হচ্ছে বলেও আশঙ্কা করছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।’
পুলিশের মধ্যে আওয়ামী মতাদর্শের লোক তথ্য পাচার করছে—এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা পুলিশের পুরোনো ব্যাধি। অধিকাংশ লোক পেশাদার। এর ভেতর দু-চারটা লোক থাকে-যারা ষড়যন্ত্র করে। এছাড়া দীর্ঘদিন একটা গোষ্ঠী ক্ষমতায় ছিল-তাদের আস্থাভাজন কিছু লোক ঘাপটি মেরে থাকতেই পারে। তবে এটা ক্রমান্বয়ে কমে আসবে। কিন্তু এরা যাতে কোনো প্রকার নেগেটিভ রোল প্লে করতে না পারে সে বিষয়েও খেয়াল রাখতে হবে।’
সূত্র বলছে, যদি নির্বাচনমুখী প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সত্যিকারার্থে ঐক্য না হয় তাহলে ফ্যাসিস্টদের ষড়যন্ত্র আরও ঘনীভূত হবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও জুলাই বিপ্লবের পক্ষে থাকা কয়েকটি দল ইতোমধ্যে আন্দোলন কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নেমেছে। ফলে এটি মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। এছাড়া পুলিশে আওয়ামীপ্রীতি এখনো রয়ে গেছে। অনেকেই বর্ণচোরা হয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বও পালন করছেন। এদের মধ্যে যারা মাঠপর্যায়ে আছেন তারা অনেকটা নিষ্ক্রিয়। ভালো কাজে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। অভিযোগ রয়েছে, এরা উলটো পুলিশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মুভমেন্ট জানিয়ে দিচ্ছে আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাকর্মীদের চ্যানেলে। ফলে প্রভাবশালী অনেক আসামি এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে।
এদিকে নাশকতা ঠেকাতে আগাম বার্তা পেতে কাজ করছে পুলিশের সাইবার ইউনিটগুলো। সাইবার ইউনিটের একজন কর্মকর্তা জানান, সাইবার স্পেসেও শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তারা বড় ধরনের মিছিল আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রধান টার্গেট রাজধানী ঢাকা ঘেরাও করা। এজন্য প্রথমে রাজধানীর চারদিক থেকে হঠাৎ এক ঘণ্টার ব্যবধানে হাজার হাজার নেতাকর্মী ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জড়ো করা নিয়ে তারা বেশি সক্রিয়। পুলিশ এ সংক্রান্ত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর পালটা পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএমপির গুরুত্বপূর্ণ একটি বিভাগের একজন উপকমিশনার যুগান্তরকে বলেন, ‘গত ২৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে গণজমায়েতের চেষ্টা করলে ২৪৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এদিন আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের পরিকল্পনা ছিল গ্রিন রোডে জমায়েত হয়ে পান্থপথ দিয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে ঢোকার। বিশ থেকে পঁচিশ হাজার লোক শাপলা চত্বরের মতো সেখানে বড় ধরনের জমায়েত করে বসে পড়ে দখলে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু সঠিক সময়ে পুলিশি তৎপরতায় সেটি সফল হয়নি।
তিনি জানান, আমরা আগে থেকেই তথ্য পাই-২৮ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনার জন্মদিন ঘিরেও নাশকতার পরিকল্পনা করা হয়েছে। তবে পুলিশ সেটিও ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম হয়। এ কর্মকর্তা আরও জানান, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো- অক্টোবরে ফ্যাসিস্ট গোষ্ঠী অনেক কিছু ঘটাতে চায়। ২৪ সেপ্টেম্বর গ্রেফতারকৃতদের জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে জিজ্ঞাসাবাদ করে এ বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। এখন সেটি নিয়ে কাজ চলছে। এজন্য বলতে পারেন, অক্টোবর মাস নিয়ে কিছুটা চাপে আছে পুলিশ।
পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, ‘কোনো ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসবিরোধী কাজ করলে কাউকেই রেহাই দেব না। আমার রেঞ্জের মধ্যে যদি কেউ এমন অপতৎপরতা ও ষড়যন্ত্র চালায় তাহলে সবাইকে আইনের আওতায় আনব।’
পরিস্থিতি সামাল দিতে ডিএমপির ক্রাইম ডিভিশনের ডিসি, এডিসি, এসি, ওসিদের নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে প্রতিনিয়ত নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। জরুরি জুম মিটিংয়েও সতর্ক করছেন ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। মাঠপর্যায়ে যারা কাজ করছেন তাদের সার্বক্ষণিক সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। এসি, এডিসি ও ডিসিসহ সিনিয়রদের মাঠে থেকে প্রত্যক্ষভাবে তদারকির জন্যও বলা হচ্ছে। এছাড়া বিশ্বস্ত অফিসারদের সমন্বয়ে একটি কোর গ্রুপ সময়মতো সঠিক গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, তথ্য বিশ্লেষণ এবং অ্যাকশন প্ল্যান প্রণয়ন নিয়ে কাজ করছেন।