
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশ নিতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের যুক্তরাষ্ট্র সফরকে কেন্দ্র করে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বসবাসরত জুলাই বিপ্লবের সমর্থক বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ বিভিন্ন দল এবং কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মুখোমুখি অবস্থানে। বিএনপির তরফ থেকে প্রধান উপদেষ্টাসহ তার সফরসঙ্গীদের জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানানো হয়েছে। অপরদিকে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা প্রধান উপদেষ্টাকে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে বিমানবন্দরের সামনে অবস্থান নেয়। দুই পক্ষকে নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থানে রয়েছে পুলিশ। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির কারণে নিউইয়র্কের বাংলাদেশ কমিউনিটিতে এক ধরনের থমথমে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
এদিকে ড. ইউনূস নিউইয়র্ক পৌঁছানোর আগেই স্থানীয় সময় রোববার রাতে জ্যাকসন হাইটস এলাকায় জড়ো হয়ে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা নজিরবিহীন উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করেন। তাদের হামলায় বিএনপির তিন কর্মী গুরুতর আহত হন। তারা এক বাংলাদেশির দোকানে ভাঙচুর করেন। হামলা থেকে বাঁচতে ওই এলাকার দোকানপাটসহ আশপাশের বাড়িঘরের বৈদ্যুতিক বাতি বন্ধ করে দেন স্থানীয়রা। খবর পেয়ে পুলিশ আসার পরপর হামলাকারীরা পালিয়ে যায়।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীরা জানান, জ্যাকসন হাইটস প্রবাসী বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকা। এখানকার ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে প্রায় সবকিছুই বাংলাদেশিদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়ে থাকে। সেখানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের এমন মারমুখী আচরণে ক্ষোভ ও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন স্থানীয় অধিবাসীরা। ড. ইউনূসের নিউইয়র্ক সফরকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতারা এমন উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করেছেন। এদের সঙ্গে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া দোসররাও যোগ দিয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রধান উপদেষ্টা, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ রাজনৈতিক দলের নেতারা নিউইয়র্কের পথে রয়েছেন—এমন সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিএনপির বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী জড়ো হন জ্যাকসন হাইটসে। তাদের পদচারণায় দিনভর মুখরিত হতে থাকে জ্যাকসন হাইটস। তারা বাংলাদেশ প্লাজার সামনে সমবেত হয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নামে স্লোগান দিতে থাকেন। রাত ৮টার দিকে হঠাৎ আওয়ামী লীগের কয়েকশ নেতাকর্মী বাংলাদেশ প্লাজার সামনের সড়কের বিপরীত পাশে দাঁড়িয়ে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার নামে স্লোগান দিতে থাকে। প্রধান উপদেষ্টাকে প্রতিহত করার ঘোষণাও দেয় তারা। রাত সাড়ে ৮টার দিকে আওয়ামী লীগের কয়েকশ নেতাকর্মী মিছিল নিয়ে বিএনপির সমাবেশের ভেতর দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এতে উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এ সময় আওয়ামী লীগের হামলায় বিএনপির তিনজন কর্মী আহত হয়েছেন। খবর পেয়ে পুলিশ আসার পরপরই এলাকা থেকে সটকে পড়েন আওয়ামী লীগের নেতারা।
ঘটনার বিষয়ে বিএনপি নেতা দেওয়ান কাওসার আহমেদ আমার দেশকে জানান, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ভাষণ দেবেন। তিনি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সফরসঙ্গী করেছেন। আমাদের দলের মহাসচিবও আসছেন। এটি আমাদের জন্য গর্বের ও আনন্দের। আমরা তাদের সফর উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছি। এগুলো সফল করার জন্য বিভিন্ন রাজ্য থেকে আমাদের কয়েক হাজার নেতাকর্মী নিউইয়র্কে এসেছেন। হঠাৎ আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা আমাদের ওপর হামলা করেছে। আমাদের একজন কর্মীর দোকান ভেঙে দিয়েছে। আমাদের একজন কেন্দ্রীয় নেতাসহ কয়েকজন আহত হয়েছেন।
কাওসার আহমেদ আরো বলেন, আমরা এ দেশের আইনের প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধাশীল। ফলে আমরা আইন হাতে তুলে নিইনি। আমরা পাল্টা জবাব দিলে আওয়ামী লীগের একটি সন্ত্রাসীও পালাতে পারত না। এতে অন্তর্বর্তী সরকার এবং আমাদের দলের দুর্নাম হতো। আমরা এ কারণে শান্তিপূর্ণ অবস্থান বজায় রেখেছি।
জয়ের ইন্ধনে আওয়ামী সন্ত্রাস
বিএনপি নেতা মনিরুল ইসলাম দাবি করেন, এসব সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও তাণ্ডবের মূল হোতা পলাতক শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। তার অর্থায়ন ও ইন্ধনে আওয়ামী লীগ এ ধরনের বেপরোয়া আচরণ করছে। তিনি আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে গোপন বৈঠকও করেন। এ বৈঠকে ড. ইউনূসকে প্রতিরোধের নীলনকশা প্রণয়ন করা হয়।
তিনি বলেন, জয় এখন বাংলাদেশের কেউ নন। শেখ হাসিনার পতনের পর জয় তার বাংলাদেশি নাগরিকত্ব পায়ে ঠেলে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নিয়েছেন। ফলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তিনি এখন সব ধরনের চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগের আমলে দেশ থেকে পাচার করে আনা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার এখন দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কাজে ব্যবহার করছেন তিনি।
বিএনপি নেতারা বলেন, আওয়ামী লীগ নেতা সিদ্দিকুর রহমান, আব্দুস সামাদ আজাদ, জয়নাল আবেদীন, মহিউদ্দিন দেওয়ান, হাজী এনাম, আব্দুল মালেক, রফিকুর রহমান, ইমদাদ চৌধুরী, নূরুল আমীন বাবু, সাইফুল ইসলাম এ হামলার সঙ্গে জড়িত।
হতবাক প্রবাসী বাংলাদেশিরা
ঘটনাস্থলের অদূরে বসবাস করেন বাংলাদেশি চিকিৎসক ডা. আবুল হাসেম। আমার দেশকে তিনি বলেন, অনেক বছর দেশে যাইনি। সন্ত্রাস, ফ্যাসিবাদ কায়েম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে আওয়ামী লীগের অনেক দুর্নামের খবর সংবাদমাধমে পড়েছি। এখন নিজের চোখে দেখলাম। যুক্তরাষ্ট্রের মতো জায়গায় এটা কল্পনাতীত। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা যেটা করেছে, এটা আমাদের হতবাক করেছে। এখন আমার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না যে, আওয়ামী লীগ কী কারণে দেশছাড়া হলো।
আওয়ামী সন্ত্রাস আইনিভাবে মোকাবিলা করবে বিএনপি
যুক্তরাষ্ট্রে প্রধান উপদেষ্টার আগমনের সময় জন এফ কেনেডি বিমানবন্দর, জাতিসংঘে সদর দপ্তর এবং তিনি যে হোটেলে থাকবেন, সেখানেও বিক্ষোভ করবে বলে আগেই ঘোষণা দিয়েছে আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাকর্মীরাসহ দলটির যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত নেতাকর্মীরা। তবে এসব কর্মসূচিকে আইনসম্মতভাবে মোকাবিলার ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপির নেতাকর্মীরাও।
জ্যাকসন হাইটসে স্থানীয় সময় রোববার এক সভায় বিএনপি নেতারা বলেন, নিউইয়র্ক সফরের সময় ফ্যাসিস্ট ও পতিত আওয়ামী লীগের যে কোনো অন্যায় কর্মকাণ্ড আইনিভাবে প্রতিহত করা হবে। যে কোনো অশুভ শক্তির অন্যায় প্রতিবাদ রুখে দিতে বিএনপি পাশে থাকবে।
জাতিসংঘের ৮০তম সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রের পথে রয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। এ সফরে তার সঙ্গে ৬ জন রাজনীতিবিদও রয়েছেন।
নিউইয়র্ক সিটির জ্যাকসন হাইটসে প্রস্তুতি সভায় বিএনপি নেতারা দলের নেতাকর্মীদের বিমানবন্দর, জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সামনে উপস্থিত থাকার আহ্বান জানান। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বিএনপি নির্বাহী কমিটির অন্যতম সদস্য জিল্লুর রহমান। অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন বিএনপির নির্বাহী কমিটির আরেক সদস্য গিয়াস আহমেদ, যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক সভাপতি এবং জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আব্দুল লতিফ সম্রাট।
নেতাকর্মীদের প্রতিটি সমাবেশে থাকার আহ্বান জানান যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক কোষাধ্যক্ষ জসিম ভূইয়া। এ সময় বক্তব্য দেন স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা হারুনুর রশিদসহ বিভিন্ন রাজ্যের নেতারা। অনুষ্ঠানে আরো ছিলেন— যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মোশরাফ সবুজ, নিউইয়র্ক স্টেট বিএনপির সভাপতি অলিউল্লা আতিকুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান সাইদ, সাবেক যুগ্ম আহবায়ক দেওয়ান কাওসার আহমেদ, যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি আনোয়ার হোসেন, বিএনপি নেতা এবাদুর রহমান, যুবদল নেতা আবু সাইদ আহমেদ প্রমুখ।
কিছুদিন আগে কনসাল জেনারেল কার্যালয় ভাঙচুর করেছিল আওয়ামী লীগ
বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ না করার আহ্বান জানিয়েছেন নিউইয়র্কে অবস্থিত বাংলাদেশ কনসাল জেনারেলের কর্মকর্তারা। একজন কর্মকর্তা আমার দেশকে জানান, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান দিবসের প্রথমবার্ষিকী উপলক্ষে গত ২৪ আগস্ট বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলে একটি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। মতবিনিময় সভাটি পণ্ড করার উদ্দেশ্যে এবং অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথিকে সরাসরি আক্রমণ করার হিংস্র মনোভাব নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলের সামনে অবস্থান নেয়। তারা বাংলাদেশ সরকারবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দেয় এবং অশ্লীল-অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে।
একপর্যায়ে তারা আগত আমন্ত্রিত অতিথিদের ধাওয়া করে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণে বাধা দেয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা আরো নানাবিধ অপকৌশল অবলম্বন করে, যার অংশ হিসেবে তারা অতিথিদের উদ্দেশে ডিম নিক্ষেপ করে। অত্যন্ত ন্যক্কারজনকভাবে বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলে ভাঙচুর চালায়। পুলিশ দুষ্কৃতকারীদের এ ধরনের ধ্বংসাত্মক কাজে বাধা দেয় এবং কয়েকজনকে আটক করে। দুষ্কৃতকারীদের ন্যক্কারজনক এই ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের স্থিরচিত্র ও ভিডিও ফুটেজ প্রমাণ হিসেবে ইতোমধ্যে পুলিশের হস্তগত হয়েছে এবং তারা এ ব্যাপারে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে আশ্বস্ত করেছে।
কনসাল জেনারেল জানায়, পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসররা প্রধান অতিথিকে হেনস্তা করা ও জীবননাশের উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের দলীয় পতাকাসহ কনস্যুলেট জেনারেলের চারদিকে মধ্যরাত পর্যন্ত অবস্থান করে। তবে পুরো সময় নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশের উপস্থিতি লক্ষণীয় ছিল।