Image description
 

চলতি বছর একাদশ শ্রেণির ভর্তিতে শিক্ষা ও মুক্তিযোদ্ধা কোটা চালু রেখেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু এসব কোটায় ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চাকরিজীবীর সন্তান থেকে শুরু করে প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের সন্তানরা নির্বাচিত হয়েছেন। এই দুই কোটা ব্যবহার করে সুযোগ নিয়েছেন ব্যবসায়ীর ছেলে-মেয়েরাও। ন্যূনতম সংশ্লিষ্ট না থাকার পরও কোটার যথেচ্ছ ব্যবহার শিক্ষার্থী নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। 
ঢাকা শিক্ষা বোর্ড বলছে, বর্তমান সময়ে মুক্তিযোদ্ধার সর্বনি¤œ বয়স ৬৭ বছর। এই বয়সে তার সন্তান থাকার সম্ভাবনা খুব কম। অন্যদিকে শিক্ষা মন্ত্রণলায় নিজেদের স্বার্থে শিক্ষা কোটা কুক্ষিগত করে রেখেছে। আর এই দুই কোটার অপব্যবহার প্রকৃত মেধাবীরা ভালো কলেজে পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। 
ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের দেওয়া তথ্য মতে, চলতি শিক্ষাবর্ষে একাদশ শ্রেণিতে চূড়ান্ত ভর্তির কার্যক্রম শেষ। রবিবার শেষ হয়েছে ভর্তি প্রক্রিয়া। সোমবার থেকে ক্লাসও শুরু হয়েছে। কিন্তু এই দুই কোটার কারণে হাজারো শিক্ষার্থী ভর্তি বঞ্চিত হবেন। যে কারণে আবারও একধাপে ভর্তির সুযোগ দেওয়া হচ্ছে বলেও জানা গেছে।
অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. জিয়াউল কবির দুলু জনকণ্ঠকে বলেন, কোটা নিয়ে ঐতিহাসিক আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের পর আর কোন কোটা ব্যবস্থা রাখা উচিত না। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা সম্মান প্রদর্শনের জন্য রাখতে পারে। কিন্তু সীমিত। অন্যদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চাকরি করলেই তার সন্তান পছন্দের কলেজের পড়বেন? এটা কোনো নিয়মে হয় না! এখন সব কোটা বাতিল করা হবে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। 
একাদশে ভর্তির কেন্দ্রীয় কমিটির তথ্যমতে, এ বছর তিন ধাপে আবেদন নেওয়া হয়। এতে বিভিন্ন কলেজে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হয়েছেন ১০ লাখ ৬৬ হাজার ১৬৩ জন। তাদের মধ্যেই শিক্ষা কোটা ও মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন ৪ হাজার ৮৭৭ জন। মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নির্বাচিত হয়েছেন ১ হাজার ৫০৬ জন। অন্যদিকে শিক্ষা কোটায় ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন ৩ হাজার ৩৭১ জন। তাদের মধ্যে শিক্ষা কোটা-১-এ সুযোগ পেয়েছেন ২ হাজার ৭৭ জন এবং শিক্ষা কোটা-২-এ ১ হাজার ২৯৪ জন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী- মুক্তিযোদ্ধার সর্বনি¤œ বয়স ১২ বছর ৬ মাস। সেই হিসাবে ২০২৫ সালে এসে ১৯৭১ সালের সবচেয়ে কম বয়সী মুক্তিযোদ্ধার বয়সও এখন ৬৭ বছর। এ বয়সী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যাও কম। অথচ তাদের দেড় হাজারের বেশি সন্তান এবার মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ভর্তির সুযোগ পেয়েছে, যাদের বয়স এখন ১৬-১৭ বছর। এ নিয়ে সন্দেহ-সংশয়ে পড়েছেন খোদ শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। স্পষ্টত অনিয়ম হয়েছে জেনেও তারা নিশ্চুপ।
এ বছর ভর্তি নীতিমালায় বলা হয়েছে, শিক্ষা কোটা-১ (ইকিউ-১) এ শুধুমাত্র শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সরাসরি কর্মরত সচিব, অতিরিক্ত সচিব, উপসচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব, সহকারী সচিব ও অন্যান্য বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তানরা ভর্তির সুযোগ পাবেন। সেই হিসাবে মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগে সবমিলিয়ে তিনশ’-চারশ’ কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। আবার সবার সন্তান এবারই কলেজে ভর্তি হবে এমন কারণও নেই। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এই কোটা ব্যবহার করে কলেজে সুযোগ পেয়েছেন ২ হাজার ৭৭ জন।

 

অর্থাৎ প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারী তিনজন সন্তানও এসএসসি পাস করে একাদশে ভর্তি হন, তাতেও এ সংখ্যা পূরণ হয় না। ফলে এখানে স্পষ্টত অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন খোদ ভর্তি কমিটির সদস্যরা। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, এ বছরের নীতিমালায় মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোটা বন্ধে সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয় নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় এটি বহাল রেখেছে। যার ফলেই ভর্তি কার্যক্রমে নতুন জটিলতা তৈরি হয়েছে। যেহেতু এখন মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনি কোটা নেই সে কারণে এসব কোটার যৌক্তিকতাও এখন নেই।
অন্যদিকে শিক্ষার জন্য আরেকটি কোটা হলো ইকিউ-২। এর আওতায় বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি), বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল, মাউশি অধিদপ্তর, এনটিআরসিএ, ব্যানবেইস, প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট, এনসিটিবি, নায়েম, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ জাতীয় ইউনেস্কো কমিশন (বিএনসিইউ), ১১টি শিক্ষা বোর্ড, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট, কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর, মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর, জাতীয় কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ও গবেষণা একাডেমির (নেকটার) কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সন্তানদের জন্য নির্ধারিত কোটা।
একাদশে ভর্তির কেন্দ্রীয় কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক অধ্যাপক রিজাউল হক জনকণ্ঠকে বলেন, এ সব শিক্ষার্থীরা কলেজে নির্বাচিত হলেও ভর্তি হতে পারবে না। কারণ যে কোটায় তিনি সুযোগ পেয়েছেন তার কাগজপত্র দেখাতে হবে। সেটি দেখাতে ব্যর্থ হলে কলেজ ওই শিক্ষার্থীকে ভর্তি করবে না। এখন প্রশ্ন উঠে এসব শিক্ষার্থী কোথায় ভর্তি হবে? যেটি নিয়ে আমরা ভাবছি। একইসঙ্গে আরেক ধাপ ভর্তির আবেদনের সুযোগ তৈরি করছি। তবে কোটার অনিয়মের কারণে অনেক মেধাবী পছন্দের কলেজ থেকে বঞ্চিত হয়েছে বলেও তিনি স্বীকার করেন। সেই সঙ্গে আগামী বছর এটি নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তির ব্যবহারসহ একাধিক পরিকল্পনা বোর্ডের রয়েছে বলেও তিনি জানিয়েছেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব জনকণ্ঠকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর ও শিক্ষাবোর্ডের চিন্তুা করা উচিত। ভর্তির দায়িত্ব বোর্ডের। যে কারণে এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের কিছু বলার নেই। তবে ইকিউ ১ কোটার বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরও একাদশ শ্রেণিতে ভর্তিতে তিন ধাপে আবেদন নেওয়া হয়। এতে আবেদন করে নির্বাচিত হওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১০ লাখ ৬৬ হাজার ১৬৩ জন। তারা গত ৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নির্বাচিত হওয়া কলেজে সশরীরে গিয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন।