
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকে ফের ক্ষমতায় আনতে আন্তর্জাতিক পরিসরে সক্রিয় হয়েছে একটি সংঘবদ্ধ অপরাধচক্র। এই প্রচেষ্টায় অর্থ জোগাচ্ছে আলোচিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ—এমন অভিযোগ উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি সংস্থার গোয়েন্দা নথিতে।
বিষয়টি প্রথম প্রকাশ্যে আনেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল—বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত ২৭ আগস্ট ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে। তিনি দাবি করেন, দেশে নির্বাচন চান না এমন ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে এস আলম গ্রুপ দণ্ডিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা দিয়েছে। যদিও এ সংক্রান্ত কোনো সরকারি দলিল বা প্রমাণ এখনো প্রকাশ্যে আসেনি।
বিদেশি গণমাধ্যম, বিশেষ করে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো দ্রুত খবরটি প্রচার করলেও তারাও জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত এস আলমের ওই ধরনের অর্থ প্রদানের প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি সংস্থার গোপন গোয়েন্দা নথিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সাবেক কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত একদল ব্যক্তি সম্প্রতি অনিবন্ধিত লবিং কার্যক্রম শুরু করেছেন। এসব কার্যক্রমে গোপন বৈঠক, আর্থিক লেনদেন, রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা অন্তর্ভুক্ত রয়ে
নথিতে অভিযোগ করা হয়েছে, এই লবিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে একটি সংঘবদ্ধ দল—যার মধ্যে রয়েছেন ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য, শেখ হাসিনা নিজে এবং তার ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা। তাদের লক্ষ্য হলো আন্তর্জাতিক পরিসরে হাসিনার ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার, ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা বা সম্পদ জব্দের পদক্ষেপ দুর্বল করা এবং বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ‘ইসলামী মৌলবাদী’ হিসেবে চিত্রিত করা। এছাড়া ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে উৎখাতের প্রচেষ্টাও এই পরিকল্পনার অংশ।
নথিতে আরও বলা হয়েছে, এই চক্র ড. ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে ইরানের সঙ্গে গোপন অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ার অভিযোগ সাজানোর চেষ্টা করছে, যাতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয় এবং হাসিনার প্রত্যাবর্তনের কূটনৈতিক ভিত্তি তৈরি হয়
গোয়েন্দা নথিতে মাল্টার সাবেক প্রধানমন্ত্রী জোসেফ মুসকাট এবং ব্রিটিশ-বসনিয়ান ব্যবসায়ী দামির ফাজলিচ—এই দুইজনকে এই আন্তর্জাতিক লবিং তৎপরতার নেতৃত্বে থাকার কথা বলা হয়েছে।
মুসকাট ২০১৩ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মাল্টার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সাংবাদিক ড্যাফনি কারুয়ানা গালিজিয়া হত্যাকাণ্ড কেলেঙ্কারির জেরে তিনি পদত্যাগ করেন। ২০২৪ সালের মে মাসে তাকে ঘুষ, অর্থপাচার ও বিতর্কিত হাসপাতাল ছাড় চুক্তির মামলায় অভিযুক্ত করা হয়। মাল্টার অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যম দ্য শিফট জানিয়েছে, মুসকাটের ঘনিষ্ঠ ইয়োরগেন ফেনেক ২০১৫ সালে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী ও হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়েন এবং কক্সবাজারে এলএনজি প্রকল্পের পরিকল্পনায় যুক্ত ছিলেন। তবে প্রকল্পটি শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি।
দ্য শিফট আরও জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে মুসকাট ফরাসি মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে হাসিনার ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন এবং তাদের স্বার্থে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন।
অন্যদিকে দামির ফাজলিচ বলকান অঞ্চলজুড়ে জ্বালানি ও গণমাধ্যম খাতে কাজ করে আসছেন এবং মার্কিন রিপাবলিকান তহবিল সংগ্রহ মহলে পরিচিত। তার বিরুদ্ধে অতীতে তেল খাতে আর্থিক অসদাচরণ, কর ফাঁকি ও জালিয়াতির একাধিক অভিযোগ থাকলেও প্রমাণের অভাবে মামলাগুলো স্থগিত হয়। ফাজলিচের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ যোগসূত্র না মিললেও তার পরিচিত অপরাধচক্রের সঙ্গে বাংলাদেশের এক নাগরিক গ্রেপ্তার হয়েছিলেন বলে সোশ্যাল সায়েন্স রিসার্চ নেটওয়ার্কের (এসএসআরএন) এক গবেষণায় উল্লেখ রয়েছে।
গোয়েন্দা নথি অনুযায়ী, হাসিনাকে ক্ষমতায় ফেরাতে ইতোমধ্যে ২০ লাখ ডলারের এক বছরের চুক্তি হয়েছে। এর সঙ্গে অতিরিক্ত ২ কোটি ডলারের ‘সাকসেস ফি’ ধরা হয়েছে, যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার উৎখাতের শর্তে পরিশোধযোগ্য। ইতোমধ্যে ইউরোপের অফশোর অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে অন্তত ৬ লাখ ডলার অগ্রিম পরিশোধ হয়েছে বলেও নথিতে দাবি করা হয়েছে।
চুক্তিতে বিদেশে জব্দ হওয়া সম্পদ মুক্ত করা এবং স্বাস্থ্যসেবা খাতে লাভজনক ব্যবসায়িক সুযোগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। নথিতে এই তৎপরতায় এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান এম সাইফুল আলমের নামও উঠে এসেছে।
এছাড়া বলা হয়েছে, হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সহযোগিতায় এম সাইফুল আলম প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছিলেন।
গোয়েন্দা নথিতে সতর্ক করা হয়েছে, ফৌজদারি অপরাধের তদন্তাধীন বা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের এই ধরনের লবিং কার্যক্রমে জড়ানো আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, বাজারের স্বচ্ছতা ও নাগরিক শান্তির জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে। অভ্যুত্থানের মতো রাজনৈতিক অস্থিরতা যুক্ত হলে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পার্শ্ববর্তী দেশ ও মিত্র রাষ্ট্রগুলোতেও পড়বে।
ঢাকাটাইমস