
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাজশাহীর রাজপথ কাঁপিয়েছে তৎকালীন সমন্বয়কেরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭ জন শিক্ষার্থীকে নিয়ে গঠিত হয় একটি সমন্বয়ক পরিষদ। ক্যাম্পাসের নানা যৌক্তিক আন্দোলনেও তাদের দেখা মিলত একসাথে। তবে আসন্ন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু), হল সংসদ ও সিনেট প্রতিনিধি নির্বাচনে এ সমন্বয়করাই কে কোন পদে, কোন প্যানেলে নির্বাচন করবেন, তা ছিল আলোচিত বিষয়। তারা কি এক প্যানেলে নির্বাচন করবে, নাকি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করবেন— এমন আলোচনা ছিল সবার মাঝে। তবে এ প্রশ্নের উত্তর সামনে এসেছে। একসাথে লড়ছেন না তারা। ইতোমধ্যে পাঁচ প্যানেলে বিভক্ত হয়েছেন সাবেক ৯ সমন্বয়ক।
ক্যাম্পাসে অনেকের ধারণা ছিল, এ সমন্বয়কদের উদ্যোগে একক কোনো প্যানেল আসতে পারে। তবে সমন্বয়কদের কয়েকজনের রাজনৈতিক পরিচয় প্রকাশ পাওয়ায় এবং নিজেদের মধ্যে ‘বনিবনা’ না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত সে ধারণা এক রকম ভেস্তে যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৭ সমন্বয়কদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ১০ জন মনোনয়নপত্র উত্তোলন করে প্রার্থিতা ঘোষণা করেছেন। এর মধ্যে একজন শুধু স্বতন্ত্রপ্রার্থী হয়েছেন। বাকি ৯ জনই বিভিন্ন প্যানেলে যুক্ত হয়ে নির্বাচন করছেন। এখন পর্যন্ত আত্মপ্রকাশ করা নয়টি প্যানেলের মধ্যে পাঁচটি প্যানেলে এ সমন্বয়কদের কেউ সহসভাপতি (ভিপি), কেউ সাধারণ সম্পাদক (জিএস), কেউবা সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদপ্রার্থী হয়েছেন। এদের আবার কেউ রাজনৈতিক পরিচয়ধারী প্যানেলেও যুক্ত হয়েছেন। সমন্বয়কের মধ্যে ছাত্রত্ব নেই বলে নির্বাচন করতে পারছেন না ৫ জন। ছাত্রত্ব থাকা স্বত্বেও নির্বাচন করছেন না দুই জন; এই দুই জনই নারী শিক্ষার্থী। তাদের দাবি, জুলাই আন্দোলনের পর থেকে সাইবার বুলিংয়ের শিকার তারা।
গত ২৮ জুলাই রাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। ২৪ আগস্ট থেকে নির্বাচনে প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র উত্তোলনের সুযোগ পান। এই ১০ সমন্বয়ক তখনই স্বতন্ত্রভাবে মনোনয়নপত্র উত্তোলন করেন। এ পর্যন্ত ৯টি প্যানেল আত্মপ্রকাশ করেছে। এর মধ্যে পাঁচটি প্যানেলে সাবেক সমন্বয়করা রয়েছে। গত ৭ সেপ্টেম্বর থেকে বিভিন্ন প্যানেলের ঘোষণা আসতে থাকে। ওই দিন ছাত্রদল দুপুরে প্যানেল ঘোষণা করে। বিকেলে করে ছাত্রশিবির। ছাত্রশিবিরে চমক ছিল সাবেক সমন্বয়ককে নিজেদের প্যানেলে এনে ঘোষণা করা। এই প্যানেলে জিএস পদে চমক হয়ে আসেন সাবেক সমন্বয়ক ফজলে রাব্বি মো. ফাহিম রেজা। ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলকে ছাত্রশিবির ‘ইনক্লুসিভ’ বলে আসছে।
তিন জন সমন্বয়কের উদ্যোগে গত ১০ সেপ্টেম্বর ‘আধিপত্যবিরোধী ঐক্য’ নামে আরেকটি প্যানেল এসেছে। এই প্যানেলের ভিপি হয়েছেন সাবেক সমন্বয়ক মেহেদী সজীব, জিএস পদে আছেন আরেক সমন্বয়ক সালাউদ্দিন আম্মার, এজিএস পদে আছেন সাবেক সমন্বয়ক আকিল বিন তালেব।
গত ১১ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার ‘সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদ’ নামে আরেকটি প্যানেলের আত্মপ্রকাশ হয়। এতে সাবেক দুই সমন্বয়ক রয়েছে। এই প্যানেলে রাকসুর ইতিহাসে প্রথম নারী ভিপি প্রার্থী হয়েছেন সাবেক সমন্বয়ক তাসিন খান। প্যানেলে সাবেক সমন্বয়ক মাহাইর ইসলাম হয়েছে এজিএস প্রার্থী।
‘রাকসু ফর রেডিক্যাল চেঞ্জ’ নামে গত সোমবার আরেকটি প্যানেল ঘোষিত হয়। এখানে সাবেক সমন্বয়ক মেহেদী মারুফ ভিপি প্রার্থী হয়েছে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র অধিকারের পরিষদেও বর্তমান সভাপতি। গত ৯ সেপ্টেম্বর আত্মপ্রকাশ ঘটে ‘গণতান্ত্রিক শিক্ষার্থী পর্ষদ’ নামে আরেকটি প্যানেলের। এখানে ভিপি পদে লড়বেন সাবেক সমন্বয়ক ফুয়াদ রাতুল। ফুয়াদ সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের বর্তমান আহ্বায়ক।
এদিকে মো. আতাউল্লাহ নামে সাবেক সমন্বয়ক পরিবেশ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক পদে স্বতন্ত্রপ্রার্থী হয়ে নির্বাচন করছেন। তিনি এখন পর্যন্ত কোনো প্যানেলে যুক্ত হননি। আরেক সাবেক সমন্বয়ক নুরুল ইসলাম (শহিদ) নবাব আব্দুল লতিফ হলে ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘নবাবীয়ান ঐক্যজোট’ প্যানেল থেকে জিএস পদে নির্বাচন করছেন।
এ ছাড়া ছাত্রত্ব না থাকায় নির্বাচনে অংশ নিতে পারছেন না সাবেক সমন্বয়ক মেহেদী হাসান (মুন্না), গোলাম কিবরিয়া মো. মিশকাত চৌধুরী, মাসুদ রানা, মো. নওসাজ্জামান, তানভীর আহমেদ রিদম।
এদিকে ছাত্রত্ব ও ক্যাম্পাসে পরিচিত থাকা স্বত্ত্বেও ‘সাইবার বুলিং’ আতঙ্কে নির্বাচনে অংশ নেয়নি সাবেক দুই সমন্বয়ক। তাদের একজন প্রার্থী হতে চেয়েও শেষ পর্যন্ত হননি। দুইজনই ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচনে প্রার্থী না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই দুই সাবেক সমন্বয়ক নারী শিক্ষার্থী।
জুলাই আন্দোলনের পর একাধিকবার সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন সাবেক সমন্বয়ক ফৌজিয়া নৌরিন। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও আবার সাইবার বুলিংয়ের শঙ্কায় তিনি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আমি এত বেশি সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছি যে নিজের মধ্যে মানসিক ভারসাম্য রাখতে পারিনি। বিভিন্ন ধরনের বাজে কথা বলেছে যা একজন মেয়ে হিসেবে সহ্য করা কষ্টকর। এখন নির্বাচনে অংশ নিলে আবার এই সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। প্রশাসন এক্ষেত্রে পরিবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। এজন্য নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি না।
রাকসু নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার ইচ্ছা ছিল সাবেক সমন্বয়ক অহনা মৃত্তিকার। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তার নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার পেছনের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নারী শিক্ষার্থীরা মিছিলের সামনের সারিতে ছিল। কিন্তু আন্দোলনের পর আর নারী শিক্ষার্থীদের কেউ পাশে রাখেনি বা মনে রাখেনি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে শুরু করে ছাত্র সমন্বয়করা আমাদের নারীদের অবদান সেভাবে তুলে ধরেননি। সেই সঙ্গে নারী শিক্ষার্থীদের নানাভাবে সাইবার বুলিং করা শুরু হলো। আন্দোলনের সময় এসব কথা কোথায় ছিল? এ জায়গায় আমি কাজ করার মনোভাব হারিয়ে ফেলেছি। এ ছাড়া নির্বাচনের পরিবেশ না থাকা ও সাইবার বুলিংয়ের শঙ্কায় নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি না।
রাকসু নির্বাচনে কেন এত বিভক্তি— এ প্রশ্নের উত্তরে সাবেক সমন্বয়ক মেহেদী সজীব বলেন, ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়কদের নিয়ে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কমিটি হয়েছে। ওই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংগঠনিকভাবে তারা এগিয়ে। তবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের কমিটি হয়নি। এই সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটিতে রাখা হলেও সমন্বয়করা সেখান থেকে পদত্যাগ করেছেন। ফলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বয়করা সাংগঠনিক বাউন্ডারির বাইরে গিয়ে কাজ করতে পেরেছেন।
তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় সংসদে শীর্ষ পদও কম। যারা সমন্বয়ক, তাদের সবার যোগ্যতা আছে ভিপি বা জিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার। তবে শেষ পর্যন্ত চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু একত্র করা যায়নি। তবে সবার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ভালো করার মনোভাব আছে।
সমন্বয়কদের পৃথক প্যানেলের বিষয়ে তাসিন খান বলেন, আমরা আলাদা প্যানেল দিয়েছি মানে এই না আমাদের মতাদর্শে অমিল রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে আমরা এখনো একত্রে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করব। কিন্তু বিষয়টা আসলে ভাঙ্গনের না। রাকসু নিয়ে আমাদের চিন্তা-ভাবনায় ভিন্নতা থাকায় আলাদাভাবে কাজ করছি। এখানে আমার ভাবনা যেমন সৎ, তেমনি আমার সহযোদ্ধা, বড়ভাইদেরও রাকসু নিয়ে ভাবনা সৎ। এখানে ফাটলের বিষয় নেই।
ছাত্রশিবিরের প্যানেলে যুক্ত হওয়ার বিষয়ে সাবেক সমন্বয়ক ফজলে রাব্বি মো. ফাহিম রেজা বলেন, ‘আমি স্বতন্ত্রভাবে জিএস পদে নির্বাচন করার আকাঙ্ক্ষা করছিলাম। পরবর্তীকালে ইসলামী ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে ইনক্লুসিভ প্যানেল করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে আমি ছাত্রশিবিরের প্যানেলে নির্বাচন করার সম্মতি জ্ঞাপন করি।’
সাবেক এ সমন্বয়ক আরও বলেন, ফ্যাসিবাদের ১৫ বছরে দীর্ঘ সংগ্রাম ও ত্যাগ পেরিয়ে এসে ইসলামী ছাত্রশিবির চব্বিশের আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছে। এরপর গত এক বছরে তারা ক্যাম্পাসে ছাত্রবান্ধব রাজনীতি করার চেষ্টা করেছে। সেই জায়গা থেকে আমি এ প্যানেলে যুক্ত হয়েছি।