Image description

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ইতিহাসে প্রথমবার জয় পেয়েছে ইসলামি ছাত্রশিবির। পরাজিত হয়েছে আলোচিত আরেক ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল।

শোচনীয় অবস্থা বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর। দুয়েকজন ব্যতীত বহু প্রার্থীর ভোট সংখ্যা শূন্য। বাম দলগুলোর নেতারা মনে করছেন ঐক্যবদ্ধ প্যানেল দিতে না পারা, সাংগঠনিক দুর্বলতাসহ বেশ কিছু কারণে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রার্থীরা ডাকসুতে কম ভোট পেয়েছে। বামপন্থী সৎ, সাহিত্যসংশ্লিষ্ট সংগঠন মিলে একটি ঐক্যবদ্ধ প্যানেল দিতে পারলে প্রার্থীরা হয়ত শক্ত লড়াই করতে পারতেন।  

২০১৯ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পর চলতি বছর ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয় ডাকসুর ভোট। ২০২৪ সালের জুলাই গণ অভ্যুত্থানের পর ফ্যাসিস্ট দল আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য নিষিদ্ধ) ব্যতীত ছাত্রদল, শিবির, বাম ও স্বতন্ত্রদের নিয়ে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এবারের নির্বাচনে শতকরা ৭৮ ভাগ ভোট কাস্টিং হয়েছে। এত ভোট পড়লেও অতীতে ডাকসুতে ব্যাপক প্রভাব রাখা বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর ফলাফল কার্যত শূন্য।

এসব সংগঠনের দুটি প্যানেলের মধ্যে একটিতে শুধুমাত্র সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদপ্রার্থী মেঘমল্লার বসু উল্লেখযোগ্য ভোট পেয়েছেন। বাকিরা কোনো সুবিধা করতে পারেননি। এর কারণ হিসেবে অনৈক্য, বিভক্ত হয়ে পড়া ও সাংগঠনিক দুর্বলতাকে কারণ হিসেবে দেখছেন ডাকসুর বামপন্থী অগ্রজরাও।  

অতীত ইতিহাস
বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে ও পরে অনুষ্ঠিত ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে বামপন্থিদের ভালো দাপট ছিল। তখন ছাত্র ইউনিয়ন আর ছাত্রলীগ ছিল ছাত্ররাজনীতির সবচেয়ে বড় দুই শক্তি। স্বাধীনতার পর ছাত্রলীগ ভেঙে গড়ে ওঠে আওয়ামী লীগের বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) জাসদ ছাত্রলীগ। তবে জাসদ ছাত্রলীগ রাজনৈতিক চাপে থাকায় অনেক সময় নির্বাচনে অংশ নেয়নি।

১৯৬৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত ডাকসু ও হল সংসদের নির্বাচন হয়েছে মোট ১৩ বার। এর মধ্যে ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থী ৪ বার ভিপি ও ৪ বার জিএস পদে জয়ী হয়েছেন। জাসদ ছাত্রলীগের প্রার্থী ২ বার ভিপি ও ১ বার জিএস হয়েছেন। আবার জাসদ ছাত্রলীগ ভেঙে তৈরি হওয়া বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) ছাত্রলীগ (যার এখন আর কোনো সংগঠন নেই) একবার ভিপি ও দুবার জিএস পদে জিতেছিল। সব মিলিয়ে দেখা যায়, ডাকসুতে সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী ছিল বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোই।

বর্তমান চিত্র
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এখন সক্রিয় আছে মোট ১০টি বামপন্থী ছাত্র সংগঠন। এর মধ্যে সাতটি সংগঠন মিলে গঠন করে ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’। সংগঠনগুলো হলো— ছাত্র ইউনিয়ন (তামজিদ-শিমুল), সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (মার্ক্সবাদী), বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (ইউপিডিএফ), ছাত্র ফেডারেশন (জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল) এবং বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলন।

অন্যদিকে বাকি তিনটি সংগঠন— ছাত্র ইউনিয়ন (মাহির-বাহাউদ্দিন), সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (বাসদ) ও বিসিএল (বাংলাদেশ জাসদ)—নিজেদের উদ্যোগে ‘অপরাজেয় ৭১’ ও ‘অদম্য ২৪’ নামে আরেকটি প্যানেল দেয়। ভোটের ফলাফলে দেখা যায়, সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমর্থন তারা তেমনভাবে পায়নি।

প্রতিরোধ পর্ষদের ভিপি প্রার্থী তাসনিম আফরোজ ইমি পেয়েছেন মাত্র ৬৮ ভোট। জিএস পদে প্রতিরোধ পর্ষদের প্রার্থী মেঘমল্লার বসু পেয়েছেন ৪ হাজার ৯৪৯ ভোট। এজিএস পদে প্রতিরোধ পর্ষদের জাবির আহমেদ জুবেল পেয়েছেন ১ হাজার ৫১১ ভোট। অন্য পদগুলোতেও বাম সংগঠনগুলোর প্রার্থীরা খুবই সামান্য ভোট পেয়েছেন। অর্থাৎ সংগঠনগুলো একত্রিত থাকলেও ভোটের ফলাফলে তাদের প্রভাব কমই ছিল।

বামপন্থী রাজনৈতিক নেতাদের মতে, এই ব্যর্থতার অন্যতম কারণ হলো— ঐক্যবদ্ধ একটি প্যানেল না থাকা। তারা মনে করেন, যদি সব সংগঠন একত্র হয়ে একক প্যানেল দিত, তবে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলা সম্ভব হতো এবং ফলও ভালো আসতে পারতো।

তাদের আরেকটি মত হলো, দীর্ঘদিন ধরে সাংগঠনিক দুর্বলতা বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দুর্বলতার কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীরাও ভোট দেওয়ার সময় তাদের প্যানেলের দিকে ঝুঁকেনি। নেতাদের দাবি, গত ১৫ বছর ধরে ছাত্রলীগের দমন-পীড়নের কারণে তারা ক্যাম্পাসে স্বাভাবিক রাজনৈতিক তৎপরতা চালাতে পারেনি। এর ফলে তাদের সংগঠনের কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে, আর সেই দুর্বল সংগঠন নিয়েই নির্বাচন করতে হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডাকসুর সাবেক জিএস মুশতাক হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। দুইটি পৃথক প্যানেল গঠন করা হয়েছিল। অথচ যদি ঐক্যবদ্ধ প্যানেল থাকত, তবে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কাছেও তা ইতিবাচক প্রভাব ফেলত। ঐক্যবদ্ধ থাকলে ১০+১০ কখনোই শুধু ২০ থাকে না, তা অনেক সময় একশর সমান শক্তি তৈরি করে। কিন্তু বিভক্ত থাকলে ১০+১০ মিলেও ১০-এই থেকে যায়।

তিনি আরও বলেন, শুধু তাই নয়, যখন প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রয়োজন হয়, তখনও ঐক্যবদ্ধতার অভাব ভিন্নভাবে প্রভাব ফেলে এবং ভোটের ফলাফলেও তার প্রতিফলন দেখা যায়। সাধারণ ছাত্রসমাজ সেটি অনুভব করে।

মুশতাক হোসেন মনে করেন, এ ছাড়াও প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো বর্তমানে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। তার ভাষায়, এক সময় ডাকসুতে ছিল বামপন্থীদেরই প্রাধান্য। কিন্তু ১৯৯০-এর পর থেকে তাদের সেই শক্তি ক্রমেই ক্ষয় হতে থাকে।

বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ বাংলানিউজকে বলেন, প্রথমত, বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো সাংগঠনিকভাবে দুর্বল। দ্বিতীয়ত, যদি তারা ঐক্যবদ্ধ প্যানেল দিতে পারত, তাহলে বড় একটা শক্তি সৃষ্টি করা যেত। তৃতীয়ত, গত ১৫ বছর ধরে অন্য কোনো ছাত্র সংগঠনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংগঠনিক তৎপরতা চালাতে দেওয়া হয়নি।

তিনি আরও জানান, অন্যদিকে শিবির ঠিকই ভেতরে ভেতরে সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়েছে। ছাত্রলীগের মধ্যে তাদের কার্যক্রম আছে, ছাত্রীদের মধ্যে ছাত্রী সংস্থার মাধ্যমে তারা তৎপর। ৫ আগস্টের পরও অনেকের পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে। এছাড়া এই নির্বাচনকে নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে কার ছবি নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহার হয়েছে। এই অভিযোগের যথাযথ খণ্ডন আমরা দেখতে পারছি না। তবে বলা যায়, যদি বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধ প্যানেল দিত, তাহলে তারা অনেক ভালো ফলাফল করতে পারত।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান বাংলানিউজকে বলেন, বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের মধ্যে বিভক্তি আছে। এই বিভক্তিই কম ভোটের মূল কারণ। যদি একটি ঐক্যবদ্ধ প্যানেল গঠন করা যেত, তাহলে ভালো ফলাফল সম্ভব হতো এবং এই সংকট সৃষ্টি হতো না।

তিনি আরও বলেন, বিগত ১৫ বছরে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে যথাযথ সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে পারেনি। বিভিন্ন ধরনের অত্যাচার ও প্রতিবন্ধকতা তাদের তৎপরতাকে সীমিত করেছে। ছাত্রলীগ নানা রকমের নির্যাতন চালিয়েছে। অন্যদিকে শিবির নিজেদের ভিতরে রেখে তা লালন-পালন করেছে। এ কারণেই সাংগঠনিক দুর্বলতা দেখা দিয়েছে।