Image description

শেখ হাসিনার প্রভাবে বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র হন সাদিক আবদুল্লাহ। মেয়র হয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথি পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়র হওয়ার পর সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ নগরভবনের অধিকাংশ নথিপত্র সেরনিয়াবাত ভবনে নিয়ে যান। ভবনটি আবার ছিল অঘোষিত এক ক্যান্টনমেন্ট। দিন-রাত ভবনটি ঘিরে রাখত সাদিকের নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী।

একই সঙ্গে ডজনখানেক সিসি ক্যামেরার তীক্ষ্ন নজরদারি থাকত। ভবনটিতে বসেই সাদিক সিটি করপোরেশনের সব কাজকর্ম করতেন। কালে-ভদ্রে দু-একবার তিনি নগরভবনে যেতেন। হাজার চেষ্টা করেও কেউ সাবেক মেয়র সাদিকের সঙ্গে দেখা করতে পারত না। কেবল তিনি নিজে চাইলেই মিলত দেখা। দায়িত্ব ছাড়ার আগে অবশ্য নথিপত্রগুলো আবার ফেরত পাঠান তিনি। কিন্তু ততদিনে গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাগজপত্র খোয়া যায়। তবে খোয়া গেছে নাকি সাদিক নিজেই সেগুলো সরিয়েছেন তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এর খেসারত দিচ্ছেন নগরভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। চরম বিপদে পড়েছেন অনেক বাসিন্দা।

২০১৮ সালের ৩০ জুলাই প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র হন সাদিক। শেখ হাসিনার ফুপাতো ভাই ও প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা সাবেকমন্ত্রী আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর বড় ছেলে সাদিক। দায়িত্ব নেওয়ার পর নগরীর কালীবাড়ি রোডের পৈতৃক বাড়ি ‘সেরনিয়াবাত ভবন’কে তিনি সিটি করপোরেশনের অঘোষিত প্রধান কার্যালয় বানান। এরপর গাড়ি বোঝাই করে নগরভবনের সব নথিপত্র ওই ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। বাড়ির পশ্চিম পাশে নির্মিত দোতলা ভবনে নথিপত্র রাখা হয়।

ভবনের দরজায় ফিঙ্গারপ্রিট সেন্সর বসানো হয়। যা খুলত কেবল সাদিক ও তার স্ত্রী লিপির আঙুলে। ৫ আগস্ট সেরনিয়াবাত ভবনে জনতা হামলা করে ও আগুন ধরিয়ে দেয়। সেখানে তখন ছিলেন প্যানেল মেয়র গাজী নইমুল ইসলাম লিটু ও আরও দুজন। দরজা খুলে না দিয়ে সাদিক পালিয়ে যান। ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে ওই তিনজন মারা যান। পরে দরজা ভেঙে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়।

২০২৩ সালের ১০ নভেম্বর পর্যন্ত বরিশালের মেয়র ছিলেন সাদিক। সেরনিয়াবাত ভবনে তিনি কাজকর্ম করতেন। সেখানে নগরভবনের দাপ্তরিক কাজকর্মও চলত। তবে মিডিয়া কভারেজ পেতে ‘জনতার মুখোমুখি’ নামে সাপ্তাহিক কর্মসূচি তিনি পালন করতেন। কিছুদিনের মধ্যেই তা আবার বন্ধ হয়ে যায়। নগরভবনের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ‘লোক দেখানো ওই আয়োজনেও কেবল তারাই যেতেন যাদের অনুমতি দিতেন সাদিক। সেখানে সবার যাওয়ার অনুমতি ছিল না।’ পাঁচ বছর বাসভবনেই তিনি দাপ্তরিক কাজকর্ম করেন। দিনের বেলা সময় দিতেন দলীয় নেতাকর্মী আর একান্ত অনুসারীদের। গভীর রাতে শুরু হতো নগরভবনের কাজ। সিটি করপোরেশনের কর্মীদের রাতের পর রাত সেরনিয়াবাত ভবনে বসিয়ে রাখা হতো। ডেকে নিয়ে দেখা না করে সারারাত দাঁড় করিয়ে রাখার ঘটনাও ঘটত প্রায়ই।

নগর পরিষদের আনুষ্ঠানিক কোনো সভা হতো না বললেই চলে। নিজের প্রয়োজনমতো সভার নোটিশ, রেজ্যুলেশন লিখে সই করিয়ে নিতেন কাউন্সিলরদের। পরিষদের সভা কাগজে-কলমে এভাবেই দেখানো হতো। সাদিকের সময়ে নগরভবনের ৩৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরি হারান। এভাবে ইচ্ছেমতো চাকরিচ্যুত করার ক্ষেত্রেও মূল হাতিয়ার ছিল ব্যক্তিগত নথি। এমন সব তথ্য চাওয়া হতো যা কেবল সাদিকের ব্যক্তিগত কক্ষে থাকত। প্রয়োজনীয় কাগজ না পাওয়ার অজুহাতে বরখাস্ত করা হতো। ঠিকাদারদের বিল প্রদানসহ অন্য অনেক ক্ষেত্রেও ঘৃণ্য এ কৌশল ব্যবহার করতেন তিনি। নগরভবনের একাধিক ঠিকাদার এসব তথ্য জানান। চাকরি হারানো বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীরও একই বক্তব্য।

২০২৩ সালের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পান সাদিকের চাচা খোকন আবদুল্লাহ। দায়িত্ব ছাড়ার মাত্র কয়েকদিন আগে সব নথি ফেরত পাঠান সাদিক। মিনি ট্রাক ভরে নথি সিটি করপোরেশন দপ্তরে নেওয়া হয়। তবে তাতে গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাগজপত্র ছিল না। বিশেষ করে ঠিকাদারি বিলসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ফাইলের অনেক কিছু নেই। দিন যত যাচ্ছে ততই বাড়ছে খোয়া যাওয়া নথিপত্রের সংখ্যা।

নগরভবনের প্রধান হিসাবরক্ষক মশিউর রহমান বলেন, সাদিকের সময়ে আমাকে অন্যায়ভাবে বরখাস্ত করা হয়। চাকরি ফেরত পেয়েছি। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত ফাইলে অনেক কাগজপত্র নেই। বহুকষ্টে মন্ত্রণালয় আর ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা কপি দিয়ে ফাইল সামলেছি। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে এক প্রকৌশলী বলেন, সাদিকের সময় অনেক আর্থিক অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। এ সংক্রান্ত কাগজপত্র ফেরত আসেনি। বিএনপির সময়ে যারা ঠিকাদারি করেছেন অথচ বিল পাননি। তাদের অনেক কাগজপত্রেরও সন্ধান মিলছে না।

খোকন আবদুল্লাহর দুর্নীতি অনুসন্ধানে কাজ করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। নগরভবনের ৩৪ কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছে চাওয়া হয়েছে ব্যক্তিগত ও দাপ্তরিক তথ্য। বহু কাগজ অফিস ফাইলে পাওয়া যাচ্ছে না। নগরভবনের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, যাদের প্রতিপক্ষ বা বিএনপি দলীয় মনে হতো তাদের ক্ষেত্রে মূলত কাগজপত্র উধাওয়ের ঘটনা ঘটেছে। এ কারণে তারা বিপাকে পড়েছেন।

সিটি করপোরেশনের প্রশাসক ও বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার রায়হান কাওসার বলেন, আমার দায়িত্ব পালনকালে নিয়মিত ফাইল ওয়ার্কে নথি মিসিংয়ের মতো পরিস্থিতির সম্মুখীন হইনি। এরপরও বিষয়টা সম্পর্কে খোঁজখবর নেব। তেমন কিছু পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।