Image description

বিশ্বের নানা প্রান্তে চরমপন্থী, সহিংস বা স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ডের কারণে বহু রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়েছিল। তবে ইতিহাস বলছে, এসব দল পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। নতুন নাম, নতুন চেহারা ও নরম ভাষা নিয়ে তারা বারবার ফিরে এসেছে এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভেতরেই প্রভাব বিস্তার করেছে। এখানে সেই দলগুলোর বিলুপ্তি, পুনরাগমন এবং রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা দেখানো হয়েছে, যা গণতন্ত্রের স্থিতিশীলতার জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ।

ইতালি: মুসোলিনির ফ্যাসিবাদ থেকে মেলোনির সরকার

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতালির পরাজয়ের পর বেনিতো মুসোলিনির ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টি (পিএনএফ) ভেঙে দেওয়া হয়। যুদ্ধাপরাধ, স্বৈরশাসন, নাৎসি জার্মানির সঙ্গে জোট, এবং বিরোধীদের ওপর নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞ—এসবই এর নিষিদ্ধ হওয়ার প্রধান কারণ ছিল।

তবুও ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ রয়ে যায়। মুসোলিনির অনুগতরা ১৯৪৬ সালে ইতালিয়ান সোশ্যাল মুভমেন্ট (এমএসআই) গঠন করে, যা গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভেতরে চলার চেষ্টা করে। ১৯৯৫ সালে ইতালিয়ান সোশ্যাল মুভমেন্ট (এমএসআই) নিজেদের নাম বদলে ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স (এএন) রাখে, যাতে তারা আরও রক্ষণশীল-প্রথাগত চেহারা পায়। পরবর্তীতে আবার ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স (এএন) ভেঙে গিয়ে কিছু সদস্য ২০১২ সালে ব্রাদার্স অব ইতালি (এফডিআই) গঠন করে।

ব্রাদার্স অব ইতালি (এফডিআই), জর্জিয়া মেলোনির নেতৃত্বে, অভিবাসন ইস্যু ও অর্থনৈতিক স্থবিরতার ওপর জনঅসন্তোষকে কাজে লাগায়। ২০২২ সালের নির্বাচনে ২৬% ভোট পেয়ে তারা সরকার গঠন করে। ফলে মেলোনি ২০২৫ সালেও ক্ষমতায় রয়েছেন।

ইসরায়েল: কাচ থেকে ওতজমা ইহুদিত পর্যন্ত

রাব্বি মেইর কাহানার কাচ দল ১৯৮৮ সালে নির্বাচনে অংশগ্রহণে, ১৯৯৪ সালে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ হয়। আরবদের বহিষ্কার ও সহিংসতার আহ্বান দেয়ায় তাদের কর্মকাণ্ড নিন্দিত হয়। এরপর সম্পদ বাজেয়াপ্ত, নেতাদের গ্রেপ্তার এবং কাচকে সন্ত্রাসী ঘোষণা করা হয়।

তবুও তাদের এ মতাদর্শ ফিরে আসে। ২০১২ সালে প্রাক্তন সদস্যরা ওতজমা ইহুদিত (ইহুদি শক্তি) গঠন করে। তারা সামান্য নরম সুরে আরববিরোধী অবস্থান নেয়, নেতানিয়াহুর সঙ্গে জোট বাঁধে এবং ২০২২ সালে কনেসেটে প্রবেশ করে। ২০২৫ সালে সরকার ছাড়লেও বিরোধী শক্তি হিসেবে তাদের প্রভাব এখনও প্রবল।

জার্মানি: নাৎসি থেকে আফডি পর্যন্ত

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৫ সালে নাৎসি পার্টি (এনএসডিএপি) ও তাদের সংগঠনগুলো নিষিদ্ধ হয়। পরে ১৯৬৪ সালে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনপিডি) গঠিত হয়, কিন্তু নিষিদ্ধ করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

২০১৩ সালে অলটারনেটিভ ফর জার্মানি (এএফডি) গঠিত হয়। প্রথমে ইউরো-বিরোধী হলেও দ্রুত চরম দক্ষিণপন্থায় চলে আসে। তারা অভিবাসনবিরোধী ও জাতীয়তাবাদী অবস্থান নেয়। ২০২৪ সালে প্রথমবার কোনো রাজ্য নির্বাচন জেতে এবং ২০২৫ সালের জাতীয় নির্বাচনে ২০–২৫% ভোট পেয়ে প্রধান বিরোধী দল হয়। যদিও সম্ভাব্য জোটসঙ্গীরা তাদের এড়িয়ে চলে, তবুও তাদের প্রভাব বাড়ছে।

মলডোভা: নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট থেকে সরকারের ক্ষমতায়

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে মলডোভা স্বাধীন হলে দেশটির কমিউনিস্ট পার্টি (পিসিএম) নিষিদ্ধ করা হয়। সোভিয়েত সময়ের স্বৈরশাসন ও দমননীতির কারণে সরকার পার্টি ভেঙে ফেলে, তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে এবং কমিউনিস্ট প্রতীক নিষিদ্ধ করে।

দুই বছরের মধ্যে প্রাক্তন কমিউনিস্টরা ভ্লাদিমির ভোরোনিনের নেতৃত্বে নতুন পার্টি গঠন করে—পার্টি অব কমিউনিস্টস অব দ্য রিপাবলিক অব মলডোভা (পিসিআরএম)। ২০০১ সালে তারা নির্বাচনে বড় জয় পেয়ে সরকার গঠন করে এবং ২০০৯ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকে। মলডোভা তখন প্রথম পোস্ট-সোভিয়েত দেশ যেখানে কমিউনিস্টরা আবার ক্ষমতায় আসে।

২০২৫ সালে পার্টি অব কমিউনিস্টস অব দ্য রিপাবলিক অব মলডোভা (পিসিআরএম) এখন ছোট বিরোধী শক্তি হলেও এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব এখনও আছে।

নেপাল: নিষিদ্ধ বিপ্লবীদের থেকে জোট সরকারের পথে

রাজতন্ত্রকালে নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিএন) নিষিদ্ধ ছিল। পঞ্চায়েত যুগে তাদের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড ও মাওবাদী আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে দমননীতি চালানো হয়।

তবুও দলটির বিভিন্ন অংশ বেড়ে ওঠে। ১৯৯৬ সালের মাওবাদী বিদ্রোহ এক দশকব্যাপী গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। পরবর্তীতে বিদ্রোহীরা রাজনীতিতে প্রবেশ করে এবং ২০১৮ সালে মাওবাদী কেন্দ্র ও ইউএমএল একত্র হয়ে নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (এনসিপি) গঠন করে।

২০১৮ সালে তারা বিপুল জয় পেয়ে সরকার গঠন করে, তবে ২০২১ সালে দল ভেঙে যায়। তবুও কমিউনিস্টরা নেপালের রাজনীতিতে প্রধান শক্তি। ২০২৪ সালেই উএমএল নেতা কে.পি. শর্মা ওলি পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হন।

চিলি: নাৎসি থেকে রিপাবলিকান পার্টি

১৯৩৮ সালে চিলির ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট মুভমেন্ট (এমএনএসসিএইচ) এক অভ্যুত্থানের চেষ্টা করলে সেনারা গুলি চালায়—যা সেগুরো ওব্রেরো গণহত্যা নামে পরিচিত, এবং ৬০ জনেরও বেশি নিহত হয়। সহিংসতা, চরমপন্থা ও নাৎসি-জার্মান সংযোগের কারণে দলটি দ্রুত ভেঙে দেওয়া হয়।

তবে অন্য অংশ নতুন নামে দল গঠন করে। এক পর্যায়ে এগুলো অগুস্তো পিনোশের স্বৈরশাসনকে সমর্থন করে। গণতন্ত্র ফেরার পর তারা ইউডিআই ও ন্যাশনাল রিনিউয়াল (আরএন) নামে রূপান্তরিত হয়।

২০১৯ সালে হোসে আন্তোনিও কাস্ত ইউডিআই ছেড়ে রিপাবলিকান পার্টি গঠন করেন। ২০২১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৪৪% ভোট পান এবং রানঅফে যান। ২০২৫ সালেও তারা সংসদে শক্তিশালী বিরোধী, যদিও নির্বাহী ক্ষমতা পায়নি। তাদের ক্ষমতাও প্রবল। 

কেন নিষিদ্ধ দলগুলো ফিরে আসে?

নিষিদ্ধ দলগুলো অনেক সময় নতুনভাবে ফিরে আসে। তাদের মতাদর্শ সমর্থকদের মধ্যে বাঁচে, আর নতুন অসন্তোষ ও সমস্যা তাদের ফেরাতেও সাহায্য করে। সরাসরি নিষেধাজ্ঞা সব সময় কাজ করে না—দলগুলো নাম বদলাতে পারে, ভাষা মৃদু করে, এবং গণতান্ত্রিক অধিকার ব্যবহার করে রাজনীতিতে আসে।

এই ফিরে আসা আরও সহজ হয় যখন দেশে বিভাজন, সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব, অভিবাসন নিয়ে আতঙ্ক বা অর্থনৈতিক সংকট থাকে। জনপ্রিয় নেতারা এই অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে পুরনো মতাদর্শকে নতুনভাবে উপস্থাপন করে। অতএব, অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি, ভালো শিক্ষা, এবং শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ছাড়া, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা বারবার একই সমস্যার মুখোমুখি হবে।