জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের অপরিহার্য উপাদান করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর)। দেশের সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশের একটি অংশ সামাজিক কাজে ব্যয়ের মাধ্যমে দায়িত্ব পালনকে ব্যবসার নিয়মের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ব্যাংকগুলো প্রতি বছর এ খাতে হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় করে। অথচ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এই অর্থের বেশিরভাগই গেছে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে। ব্যাংকের সামাজিক দায়বদ্ধতার কার্যক্রমের সবটাই চলেছে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল ঘিরে। আর সিএসআরের অর্থ ত্রাণ তহবিলে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। এরই মধ্যে বিএবির তখনকার আয়-ব্যয় ও এই সংগঠনের মাধ্যমে কত অর্থ ত্রাণ তহবিলে গেছে, তা নির্ধারণে অডিট কার্যক্রম শুরু করেছে বিএবি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে বিভিন্ন সময় অর্থ দিয়ে ব্যাংক কোম্পানি আইনের বিভিন্ন ধারা পরিবর্তন করার অভিযোগ রয়েছে নজরুল ইসলাম মজুমদারের বিরুদ্ধে। বিশেষ করে ব্যাংকের সুদের হার ৯ শতাংশ করার ক্ষেত্রে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এই সুযোগ নিতে প্রতিবারই প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে বড় অঙ্কের অর্থ জমা দিতেন তিনি। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যাংক ও সরকারি দপ্তরের নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে অর্থ বের করে নেওয়ার ক্ষেত্রেও সরকারের পক্ষ থেকে সুবিধা নিয়েছেন নজরুল ইসলাম মজুমদার।
তথ্য বলছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ত্রাণ তহবিলে সিএসআর হিসেবে জমা পড়েছে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। আওয়ামী লীগের প্রথম ৫ বছর ব্যাংকগুলো ত্রাণ তহবিলের পাশাপাশি অন্যান্য খাতে অর্থ ব্যয় করলেও ২০১৪ সালের পর তা কমে যায়। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো সিএসআর ব্যয়ের সিংহভাগই যেতে থাকে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে। আর ত্রাণ তহবিলে টাকা নিয়ে যেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তৎকালীন বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। এর মাধ্যমেই ব্যাংক থেকে অবৈধ সুবিধা নিতে সরকারের সম্মতি নিয়েছেন তিনি।
এ বিষয়ে একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালবেলাকে বলেন, বিভিন্ন উপলক্ষে (অকেশন) প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে অর্থ পাঠানোর জন্য বিএবির পক্ষ থেকে চিঠি পাঠানো হতো। প্রথম দিকে টাকার পরিমাণ নির্ধারণ করত ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ধীরে ধীরে বিএবি চিঠিতেই উল্লেখ করে দিতে এই খাতে এত টাকা পাঠাতে হবে। আমরা সে সময় নিরুপায় ছিলাম। চিঠি অনুযায়ী তাই ত্রাণ তহবিলে অর্থ পাঠানো হতো। শুধু তা-ই নয়, সিএসআরের বাইরের বিভিন্ন সময় তারা সরকারের বিভিন্ন তহবিলে অর্থ দিতে বাধ্য করত।
সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগের আমলে বিএবি কী পরিমাণ আয় করেছে এবং এসব আয়ের অর্থ কোন কোন খাতে ব্যয় হয়েছে, সে তথ্য বের করতে অডিট পরিচালনার চিন্তা করছে সংগঠনটি। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে বিএবির মাধ্যমে কী পরিমাণ অর্থ জমা পড়েছে এবং কোন কোন ব্যাংক থেকে কত টাকা নেওয়া হয়েছে, সেগুলোও তদন্ত করে দেখা হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো অর্থ তছরুপ হয়েছে কি না বা কারা অর্থ তছরুপে জড়িত, তাদের তথ্য বের করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
১৭ বছরে এক চেয়ারম্যান: ২০০৮ সাল থেকে টানা ১৭ বছর বিএবির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন এক্সিম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। এ সময় তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অতি ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি পান। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নজরুল ইসলাম মজুমদারকে এক্সিম ব্যাংকের পরিচালক ও চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে বিএবির চেয়ারম্যান পদও হারান তিনি। সরকার বদলের পর নজরুল ইসলাম মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বিএবির দুই ভাইস চেয়ারম্যানও ব্যাংকের পরিচালক পদ হারান। তারা হলেন আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুস সামাদ ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) ভাইস চেয়ারম্যান আনিসুজ্জামান চৌধুরী।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগে সর্বশেষ ‘শেখ হাসিনা আন্তঃব্যাংক ফুটবল টুর্নামেন্ট’ আয়োজন করে বিএবি। এজন্যও ব্যাংকগুলো থেকে চাঁদা তোলা হয়। নজরুল ইসলাম মজুমদারের নেতৃত্বে বিএবি গত ১৫ বছরে বিভিন্ন ইস্যুতে ব্যাংকগুলো থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা তুলেছে বলে জানান ব্যাংকাররা। এজন্য সরকার বদলের পর এসব টাকার ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, দাবি উঠে নিরীক্ষার।
২০২২ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক নির্দেশনায় জানায়, ব্যাংকগুলোর সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলের ৫ শতাংশ অর্থ প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষাসহায়তা ট্রাস্ট তহবিলে অনুদান হিসেবে জমা দিতে হবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এই নির্দেশনা মেনে চলতে বলা হয়।