Image description
 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) আসন্ন নির্বাচনে লড়াইয়ের মাঠে নেমেছেন জুলাই যোদ্ধারা। বিশেষ করে ভিপি ও জিএস পদে যারা প্রার্থী হয়েছেন, তাদের অধিকাংশই জুলাই আন্দোলনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজপথে ছিলেন; ছিলেন সামাজিক মাধ্যমেও প্রতিবাদমুখর। ইতোমধ্যে ৯টি প্যানেল ঘোষণা করা হয়েছে এবং সব প্যানেলের প্রার্থীরাই নির্বাচনী মাঠে বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। প্রত্যেক প্যানেল থেকে বলা হচ্ছে, তারা সবচেয়ে সেরা প্রার্থীদের নিয়ে লড়াইয়ে নেমেছেন। কেউ আবার অন্য প্যানেল থেকে তাদের প্যানেল কেন ব্যতিক্রম, সেই ব্যাখ্যাও দিচ্ছেন। অনেকে নিজের রাজনৈতিক পরিচয় আড়ালে রেখে নেমেছেন স্বতন্ত্র পরিচয়ে। যারা বিজয়ী হয়ে আসবেন, তারা সবাই যেন জুলাই আন্দোলনের চেতনা ধারণ করে এগিয়ে যানÑ এমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন দেশের বিশিষ্টজনরা।

ডাকসুর সাবেক ভিপি এবং নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না আমাদের সময়কে বলেন, একটা ভালো দেশ চাই, বৈষম্যহীন দেশ চাইÑ এমন চিন্তা যারা করবে, তাদেরই ডাকসুতে আসা উচিত। তবে রাজনৈতিক পরিচয় গোপন করলে কার কী পরিচয়, কী কমিটমেন্ট, তা অস্পষ্ট থেকে যায়। আমি চাই, আগামী দিনের প্রত্যাশা পূরণের নেতৃত্ব আসুক ডাকসুতে। 

শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আল মাসুদ হাসানুজ্জামান বলেন, প্রায় ৬ বছর পর ডাকসু নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এটা ভালো খবর, স্বাগত জানাই। নিশ্চয়ই সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা, ডাকসুতে যারা নির্বাচিত হয়ে আসবে, তারা যেন শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজ করে এবং দলীয় লেজুড়বৃত্তি থেকে দূরে থাকে।

উল্লেখ্য, ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা এখনও শুরু হয়নি। ২৬ আগস্ট বিকাল ৪টায় চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হবে। এরপর শুরু হবে আনুষ্ঠানিক প্রচার। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করা যাবে ২৫ আগস্টের 

মধ্যে। ভোটানুষ্ঠান ৯ সেপ্টেম্বর। এর ২৪ ঘণ্টা আগ পর্যন্ত প্রচার করা যাবে। ডাকসু নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন জানান, ডাকসুর কেন্দ্রীয় সংসদের ২৮ পদে মোট ৫০৯টি মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ১৮টি হল সংসদে ২৩৪টি পদের জন্য ১ হাজার ৪২৭টি মনোনয়নপত্র বিক্রি হয়েছিল। এর মধ্যে ১ হাজার ১০৯টি মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। আবিদুল পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষকতা করেন। তিনি জুলাই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। জিএস প্রার্থী তানভীর বারী হামিম উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী এবং কবি জসীমউদ্দীন হল ছাত্রদলের আহ্বায়ক। নিজেদের প্যানেল সম্পর্কে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে আবিদুল ইসলাম বলেন, কেন্দ্রীয় ছাত্রদল এবং ছাত্রদলের ঢাবি শাখা সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক। ভোটাভুটির মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের প্যানেল নির্বাচিত করেছি। 

উমামা ফাতেমার প্যানেলে ভিপি পদে লড়বেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র এবং বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনের এই শিক্ষার্থী নিজে। জিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন নৃবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৬-১৭ সেশনের শিক্ষার্থী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সাবেক সভাপতি আল সাদী ভূঁইয়া। তাদের ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্যানেল থেকে দাবি করা হয়েছে, তারা সর্বোচ্চ ক্লিন ইমেজের শিক্ষার্থীদের প্রার্থী করেছেন। গতকাল বিকালে অপরাজেয় বাংলার সামনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ প্যানেল ঘোষণা করা হয়। 

‘বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আব্দুল কাদের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী। তিনি বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের (বাগছাসের) ঢাবি শাখার আহ্বায়ক। এর আগে তিনি গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি ও ছাত্র অধিকার পরিষদের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। জিএস আবু বাকের মজুমদার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী। তিনি বাগছাসের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন আবু বাকের। 

‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের’ ভিপি প্রার্থী সাদিক কায়েম রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৬-১৭ সেশনের শিক্ষার্থী। বর্তমানে তিনি শিবিরের কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক। জিএস প্রার্থী এস এম ফরহাদ সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ২০১৭-১৮ সেশন এবং কবি জসীমউদ্দীন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি তিনি। সাদিক কায়েমের ভাষ্য, তারা ইনক্লুসিভ প্যানেল ঘোষণা করেছেন। 

‘প্রতিরোধ পর্ষদের’ ভিপি প্রার্থী শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষার্থী। তিনি ২০১৯ সালের হল সংসদে শামসুন নাহার হলের ভিপি ছিলেন। জিএস প্রার্থী মেঘমল্লার বসু শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী। তিনি ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি। শিক্ষার্থীদের সব অধিকার আন্দোলনে ছিলেন এবং থাকবেন বলে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন মেঘমল্লার বসু।

অন্যান্য প্যানেলের প্রার্থীরাও শিক্ষার্থীদের কাছে সবচাইতে বেশি গ্রহণযোগ্য বলে দাবি করছেন। ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী সংসদের’ ভিপি প্রার্থী জামাল উদ্দীন খালিদ আরবি বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংসদের আহ্বায়ক। জিএস প্রার্থী মাহিন সরকার বাংলা বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী। তিনি জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সাবেক যুগ্ম সদস্য সচিব। এ ছাড়া তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও সাবেক কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য।

‘ছাত্র অধিকার পরিষদের’ ভিপি প্রার্থী বিন ইয়ামিন মোল্লা লোকপ্রশাসন বিভাগে ২০১৪-১৫ সেশনের শিক্ষার্থী। তিনি ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি। এ ছাড়া তিনি পরিষদের ঢাবি শাখার সভাপতি ছিলেন। জিএস প্রার্থী সাবিনা ইয়াসমিন শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী। তিনি ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি। 

‘অপরাজেয় ৭১-অদম্য ২৪’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী নাইম হাসান হৃদয় যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগের ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ-বিসিএলের ঢাবি শাখার সভাপতি। জিএস প্রার্থী এনামুল হাসান অনয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০২১-২২ সেশনের শিক্ষার্থী। তিনি ছাত্র ইউনিয়নের (একাংশ) শিক্ষা ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক। 

‘ইসলামী ছাত্র আন্দোলন’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী ইয়াসিন আরাফাত ইসলামিক স্টাডিজের ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী। তিনি ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের ঢাবি শাখার সাবেক সভাপতি। বর্তমানে তিনি কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য। জিএস প্রার্থী খায়রুল আহসান মারজান আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী। তিনি সংগঠনের ঢাবি শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক। বর্তমানের কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। 

এদিকে গতকাল বিকালে মধুর ক্যান্টিনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল মনোনীতি ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান বলেন, সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটাভুটির মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের প্যানেল নির্বাচন করেছি। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো ছাত্রসংসদ নির্বাচনে এই ইতিহাস বিরল যে, কোনো সংগঠনের অভ্যন্তরে নেতাকর্মীরা ভোটাভুটির মধ্য দিয়ে তাদের প্রার্থী নির্ধারণ করেছেন। 

আবিদুল বলেন, আশা করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সেটাকে হৃদয় থেকে স্বাগত জানাবে এবং সেই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে আমাদের পাশে থেকে উৎসাহ দেবে। সব সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আমাদের উৎসাহ দিয়েছে বলেই আমাদের সংগঠন এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি বলেন, আমরা আমাদের প্যানেল যথেষ্ট অন্তর্ভুক্তিমূলক করার চেষ্টা করেছি। 

আচরণবিধি জারি

ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আচরণ বিধিমালা জারি করা হয়েছে। এ বিধিমালা অমান্য করলে আচরণবিধি লঙ্ঘন বলে বিবেচিত হবে এবং ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। গতকাল চিফ রিটার্নিং অফিসার এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানান। এতে বলা হয়Ñ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী কোনো প্রার্থী/পক্ষ আজ থেকে আগামী ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত স্বপ্রণোদিত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক কোনো ধরনের সেবামূলক কাজে অংশ নিতে পারবেন না, কোনো ধরনের উপঢৌকন বিলি-বণ্টন করতে পারবেন না, এমনকি আপ্যায়ন করানো, অর্থ সহযোগিতা করা কিংবা অনুরন এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি বলেন, আমরা আমাদের প্যানেল যথেষ্ট অন্তর্ভুক্তিমূলক করার চেষ্টা করেছি।