
মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
আমাকে যারা চেনেন, ভালো করেই জানেন, আমি জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি পছন্দ করি না। এ নিয়ে আমি কখনও রাখঢাক-গোপন করিনি। আমার এই বোধোদয় ঘটেছে খুবই অল্প বয়সে, যখন দিন-দুনিয়া সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের শুরু।
ক্লাস নাইনে পড়ি তখন। প্রচুর গান শুনি, আর শুনতে শুনতেই ইচ্ছে জাগল গান-বাজনা করব। সেই সময় প্রায় প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় কমপক্ষে একটি করে ব্যান্ড ছিল, আমাদের পাড়ায় ছিল সুপারহিট নোভা ব্যান্ড।
মহল্লার এক বাল্যবন্ধুর সঙ্গে দিনমান আড্ডা দিই পাড়ার রকে বসে, আমরা সেটাকে ‘ম্যার’ বলতাম। আমাদের সামনে দিয়ে জগন্নাথ কলেজের এক ছাত্র সাইকেল চালিয়ে প্রতিদিন কাজী বাড়ির মসজিদের পাশে মেসে যেতেন। একদিন সেই ছাত্রটি আমাদের সঙ্গে ভাব করার চেষ্টা করলেন, কী করি, কোথায় পড়ি, এসব। এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই সেই লোক সাইকেল থামিয়ে আমাদের সঙ্গে কয়েক মিনিট কথা বলতেন। খুবই ভদ্র আর সজ্জন ব্যক্তি, এবং ক্লিন শেভড।
আলাপ থেকে সেই লোক জানতে পারলেন আমি বই পড়ি। একদিন তার মেসে নিয়ে গিয়ে নসীম হিজাজীর শেষ প্রান্তর শিরোনামের বই ধরিয়ে দিলেন। ততদিনে আমি সুনীল-মানিক-শরৎ-হুমায়ুন-ছফা-ডয়েল আর ক্রিস্টিসহ অনেকের নাম জানলেও এই লেখকের নাম জানতাম না। বই খুলে জানতে পারলাম লেখক পাকিস্তানি। তখন হাতের কাছে ঠোঙা পেলেও পড়ি। যতদূর মনে আছে, ক্রুসেডের কাহিনি ছিল বইটাতে। মাত্র দুদিনে বইটা পড়ে জমা দিয়ে দিলে সেই লোক মুগ্ধ হয়ে হিজাজীর আরেকটা বই ধরিয়ে দিলেন।
তখন রোজা চলছে। একদিন ইফতারের দাওয়াত দিলেন সেই লোক, আমি আর আমার বন্ধু গেলাম তার মেসে, সেখানে আরো দশ-বারোজন মেহমানও ছিলেন। ইফতার শেষে আবারও শুরু হলো ‘আলাপ’। আলাপ মানে নির্দিষ্ট একটি রাজনৈতিক দলের গুণগান। সংক্ষেপে বলতে গেলে, ক্রুসেডের বীর সালাদিনের যোগ্য উত্তরসূরী এই দেশে আছে! এবার আরেকটু খুল্লাম-খুল্লা। আমরা দুই ছোট্ট প্রাণ শুনে গেলাম তাদের কথা—গণতন্ত্র হলো কাফেরদের তন্ত্র! মুক্তিযুদ্ধ ছিল মারাত্মক ভুল! ভারত ষড়যন্ত্র করে পাকিস্তান ভেঙে মুসলমানদের দুর্বল করে ফেলেছে! পাকিস্তান মিলিটারি যা করেছে ইসলাম রক্ষার জন্যই করেছে! ১৪ ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যা আসলে ‘র’ এবং আওয়ামী লীগ করেছে! শহীদ মিনারে ফুল দেওয়াটা শিরক! রবীন্দ্রনাথ মুসলমানবিদ্বেষী ছিলেন। কোনো মুসলমানের উচিত না তার গান শোনা।
‘অন্য গান শোনা যাবে?’
‘না। ইসলাম গান-বাজনা হারাম করেছে।’
আমি আমার বন্ধুর দিকে তাকালাম। মাত্র কদিন আগে টাকা জমিয়ে গিটার কিনেছি, রোজার পর বাড়ির পাশে নোভা ব্যান্ডের ফজল ভাইয়ের কাছে যাব শিখতে। সেই শিবির নেতা আরো অনেক কথা বললেন, সবটাই মারাত্মক বিষাক্ত। ততদিনে আমি বই পড়ে একটু পেকে গেছি, ইত্তেফাক পত্রিকা পড়ি সকাল সকাল। ধর্মের মোড়কে বলা বিষাক্ত কথাবার্তাগুলো বুঝতে কষ্ট হয়নি। আর পত্রিকা পড়ে এ-ও জানতাম, শিবির তখন রগকাটা নিয়ে ভীষণ সমালোচিত। এবার শুরু হলো তর্ক। তর্কে আরো বেশি বিষাক্ত কথাবার্তা উঠে এলো। সেগুলো অন্য একদিন বলব।
সেই লোক প্রথমে যুক্তি দিয়ে যুক্তি খণ্ডাতে লাগলেন, কোনঠাসা হওয়ার পর শুরু হলো কেবল ধর্ম আর ধর্মের দোহাই! এসব বিষাক্ত কথাবার্তা জামায়াত-শিবির কখনও স্বীকার করবে না, জানি। তারা যখন নতুন কাউকে দলে টানে তখন এগুলোই বলে; এভাবেই ব্যাপ্টাইজ করে কর্মীদেরকে। গলদটা সেখানেই। ফলে যত ভালো আর বুদ্ধিমান ছেলেই হোক না কেন, শিবিরের ছেলেপেলেদের বেসিকে মারাত্মক সমস্যা রয়েছে। নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে সেটার প্রকাশও ঘটে হরহামেশা। ভবিষ্যতেও ঘটবে। আর যদি কখনও ক্ষমতায় চলে যায়, তখন দেখবেন এই ব্যাপ্টাইজ করার ফলাফল কী হতে পারে!
সত্যি বলতে, আমি মনে করি শিবিরের ছেলেপেলেরা আসলে ‘ভিকটিম’! তাদের মধ্যে খুব কম সদস্যই পারে এই গোলকধাঁধা থেকে বের হয়ে আসতে, কেননা স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতাটাকেই শেষ করে দেওয়া হয় প্রথমে। আদতে তারা বিষাক্ত মতাদর্শে ব্যাপ্টাইজ হওয়া জম্বি।
মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন: কথাসাহিত্যিক ও প্রকাশক