
জুলাই জাতীয় সনদকে সংবিধানের ওপর প্রাধান্য দেওয়ার পক্ষপাতী নয় বিএনপি। সনদ সম্পর্কে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না– এ অঙ্গীকারেও একমত নয় দলটি। বিএনপি চায়, যেসব সাংবিধানিক সংস্কারে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো নির্বাচনের আগে নয়; আগামী সংসদে বাস্তবায়ন করা হবে।
জুলাই সনদের সমন্বিত খসড়া সম্পর্কে গতকাল বুধবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে এসব মতামত দিয়েছে দলটি। বিএনপিসহ পাঁচটি দল গতকাল মতামত জানিয়েছে। গতকাল ছিল মতামত দেওয়ার শেষ দিন।
তবে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ ২৬টি দল মতামত না দেওয়ায় আগামীকাল শুক্রবার বেলা ৩টা পর্যন্ত সময় বাড়িয়েছে কমিশন। কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সমকালকে বলেন, ‘কয়েকটি দল সময় বাড়ানোর অনুরোধ করেছে।’
সনদের আইনি ভিত্তি এবং নির্বাচনের আগে বাস্তবায়নের দাবিতে সোচ্চার জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন এবং এনসিপি জানিয়েছে, বর্ধিত সময়ের মধ্যে তারা মতামত জানাবে। গতকাল বিএনপি ছাড়াও এবি পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, এনডিএম, গণফ্রন্ট, আমজনতার দল মতামত জানিয়েছে কমিশনে।
দ্বিতীয় দফা সংলাপে অংশ নেওয়া ৩০ রাজনৈতিক দল ও জোটকে গত ১৬ আগস্ট জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়া দেয় প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন ঐকমত্য কমিশন। এতে সনদের পটভূমি এবং ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে কমিশনের দেওয়া সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থানসহ রয়েছে। শেষাংশে রয়েছে আট দফা অঙ্গীকার।
বিএনপি মতামতে যা বলেছে
অঙ্গীকারনামার দ্বিতীয় দফায় বলা হয়েছে, সংবিধান ও আইনের ওপর প্রাধান্য থাকবে সনদের। সনদ নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না আদালতে। বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কার কালক্ষেপণ না করে নির্বাচনের আগে বাস্তবায়ন করবে সরকার।
বিএনপি এই তিন অঙ্গীকারের বিরোধী। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেছেন, ৩৫ পৃষ্ঠার মতামত দিয়েছে বিএনপি। সংস্কার প্রস্তাব এবং অঙ্গীকারনামার বিষয়ে দলীয় মতামত জানিয়েছে। সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধানের ওপরে কোনো কিছুকে প্রাধান্য দেওয়া যায় না। জুলাই সনদ রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল। সমঝোতার দলিল সংবিধানের ওপর প্রাধান্য পেতে পারে না।
১৯৭৫ সালের ২০ আগস্ট জারি করা সামরিক আইনের সঙ্গে সংবিধানের যেসব অংশ অসামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল, তা স্থগিত করা হয়েছিল। এর ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ফরমানের মাধ্যমে সংসদের বাইরে সংবিধান সংশোধন করেন। সামরিক ফরমানকে সংবিধানের ওপর প্রাধান্য দেওয়ার সেই নজির দিয়ে জুলাই সনদকে একই মর্যাদা দেওয়ার দাবি তুলেছে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সালাহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেছেন, পঁচাত্তরে দেশে সাংবিধানিক সরকার ছিল না। সামরিক শাসনের অধীনে সংবিধান স্থগিত হয়েছিল। বর্তমানে সেই বাস্তবতা নেই। অন্তর্বর্তী সরকার আদালতের অনুমোদনে গঠিত এবং সাংবিধানিক। যে সংবিধানের অধীনে সরকার গঠিত, সেই সংবিধানের ওপরে কোনো কিছুকে প্রাধান্য দিতে পারে না।
অঙ্গীকারের চতুর্থ দফায় বলা হয়েছে, সনদের প্রতিটি বিধান, প্রস্তাব ও সুপারিশ সাংবিধানিক ও আইনগতভাবে বলবৎ গণ্য হবে। তাই সনদের বৈধতা, প্রয়োজনীয়তা কিংবা জারির কর্তৃত্ব সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। বিএনপি এতে আপত্তি জানিয়েছে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেছেন, কোন কোন বিষয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না, তা সংবিধানে বলা আছে। অনুচ্ছেদ ৭৯ অনুযায়ী সংসদের কার্যক্রম এবং ১২৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচনী আইন ও নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যায় না। এর বাইরে কোনো কিছু সম্পর্কে যদি আদালতে প্রশ্ন তোলার পথ বন্ধ হয়, তবে নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন হবে।
বিএনপি সরকার ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদে এবং ২০০৩ সালে অষ্টম সংসদে দায়মুক্তি অধ্যাদেশকে অনুমোদন দিয়েছিল। এ উদাহরণ দিয়ে জামায়াতসহ কয়েকটি দল বলেছে, একইভাবে জুলাই সনদকেও আদালতে প্রশ্ন তোলার ঊর্ধ্বে রাখা যায়।
সালাহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেছেন, ওই দুটি অধ্যাদেশে নির্দিষ্ট কিছু ঘটনাকে প্রশ্নাতীত বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সংসদ বলেনি, এ-সংক্রান্ত আইন সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা যাবে না। ২০০৩ সালের দায়মুক্তি অধ্যাদেশ পরে আদালতে চ্যালেঞ্জ হয়েছিল।
জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি এবং সনদের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে এরই মধ্যে মাঠে নেমেছে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন। একই দাবি জানাচ্ছে এনসিপিও। সনদ সম্পর্কে দেওয়া মতামতে বিএনপি বলেছে, সংবিধান-সংক্রান্ত সংস্কার-পরবর্তী সংসদে হতে হবে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেছেন, সংবিধান সংশোধন করতে হবে না, এমন সংস্কার প্রস্তাব রয়েছে। যেগুলোতে রাজনৈতিক ঐকমত্য রয়েছে, সেগুলো নির্বাহী আদেশ, অধ্যাদেশের মাধ্যমে সরকার কার্যকর করতে পারে। কিন্তু সাংবিধানিক সংস্কার নির্বাচিত সংসদে হতে হবে।
বিএনপি কীভাবে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে চায়– প্রশ্নে সালাহউদ্দিন বলেছেন, রাজনৈতিক ঐকমত্য এবং আলোচনায় নিশ্চয়ই একটি পথ বের হবে।
অন্যান্য দল যা বলছে
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ সমকালকে বলেছেন, কীভাবে সনদ নির্বাচনের আগে কার্যকর করা যায়, তা ঠিক করতে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। জামায়াত আগামী শুক্রবারের মধ্যে মতামত জানাবে।
জামায়াতের এই নেতার ভাষ্য, আগামী নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করতে জুলাই সনদ কার্যকর করতে হবে। তিনি বলেছেন, জিয়াউর রহমান যেভাবে সংসদের বাইরে সংবিধান সংশোধন করেছেন, একইভাবে এবারও জনগণের অভিপ্রায়ে করা যায়। সে কথাই জামায়াত কমিশনকে জানাবে।
যদিও এ বক্তব্য সালাউদ্দিন নাকচ করেছেন। তিনি বলেছেন, ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির ফরমানে সংবিধানের সেসব পরিবর্তন আনা হয়েছিল, তা পরে সংসদে অনুমোদন করা হয়েছিল।
হামিদুর রহমান আযাদ বলেছেন, সংবিধানের যেসব সংস্কার নির্বাচনের আগে করা হবে, তা পরবর্তী সংসদে অনুমোদন করিয়ে নিলে বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন থাকবে না।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন সমকালকে বলেছেন, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। বর্ধিত সময়ের মধ্যে মতামত দেওয়া হবে। এনসিপি চায়, গণপরিষদে জুলাই সনদের আলোকে সংবিধান পুনর্লিখন করতে হবে। আগামী নির্বাচন হবে গণপরিষদ নির্বাচন। ১২০ দিনের মধ্যে গণপরিষদ পুনর্লিখিত সংবিধান প্রণয়ন ও গ্রহণ করবে। এরপর গণপরিষদ পাঁচ বছর মেয়াদি সংসদে রূপান্তরিত হবে। ফলে নির্বাচন বিলম্বের আশঙ্কা থাকছে না।
ইসলামী আন্দোলনের মুখপাত্র গাজী আতাউর রহমান বলেছেন, সনদে মতামত দিতে তারাও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলছেন। আইনি স্বীকৃতি ও প্রাধান্য না থাকলে সনদ অর্থহীন হয়ে যাবে।
সংস্কারের সুপারিশে যেসব মতামত
প্রথম দফার সংলাপে ১৬৬ সুপারিশের ৬২টিতে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছিল। দ্বিতীয় দফার সংলাপে ২২ সুপারিশের ১১টিতে ঐকমত্য হয়েছে। বাকিগুলোতে কমিশন সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভোটের অনুপাতে (পিআর) সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন, কমিটির মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কমিশন এবং তিনটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ, প্রধানমন্ত্রী দলীয় প্রধান পদে থাকতে পারবেন না– কমিশনের এমন ৯টি সিদ্ধান্তে নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্ন মত) দিয়েছে বিএনপি।
সনদে দেওয়া মতামতে দলটি আগের অবস্থান জানিয়েছে। আলী রীয়াজ সমকালকে বলেছেন, দলগুলোর মতামত পাওয়ার পর সনদ চূড়ান্ত করা হবে আলোচনার মাধ্যমে। তা বাস্তবায়নে অঙ্গীকারনামায় সব দলের সই থাকবে।