
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী রাষ্ট্র সংস্কারের দলিল জুলাই সনদের যখন একদম কাছাকাছি দলগুলো, তখন এ নিয়ে ফের জটিলতা রাজনৈতিক শিবিরে। কেউ দাবি করছে গণভোটের মাধ্যমে এই সনদের সাংবিধানিক দিকগুলোকে এখনই বাস্তবায়ন করতে, কেউ চাইছে গণপরিষদ। তবে জাতীয় সংসদের বাইরে এই প্রক্রিয়ায় সনদ বাস্তবায়ন কতটা টেকসই? আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবচেয়ে ভালো উপায় সাংবিধানিক সংস্কারগুলোর বাস্তবায়ন আইনসভায় করা।
দীর্ঘ ৬ মাসে প্রায় ৭০টি অধিবেশনের পর যখন রাষ্ট্রসংস্কারের মৌলিক ইস্যুতে একটা সিদ্ধান্তে আসতে যাচ্ছে দলগুলো, তখন রাজনীতির মাঠের এসব বক্তৃতা বিবৃতি থেকে এটা স্পষ্ট, এর বাস্তবায়ন নিয়ে এখন আরেক ধরনের জটিলতা তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন পক্ষে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোহাম্মদ আব্দুস সালাম বলেন, ‘আমরা যেভাবে চেয়েছি অন্যদল হয়তো সেভাবে চাচ্ছে না। বির্তক আছে সে বিতর্কটা পরবর্তীতে সমাধান হতে পারে। এটা না হলে দেশ জাহান্নামে চলে যাবে এমন তো কোনো কথা নেই।’
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন বলেন, ‘নির্বাচন তো তাহলে আগের মতো দিতে হবে। পরের সরকার যে হবে সে এটা মানতে বাধ্য হবে কীসের ভিত্তিতে।’
বাস্তবতা হলো যে ৮৪টি বিষয় জুলাই জাতীয় সনদে জায়গা পেয়েছে, তার সবগুলো সাংবিধানিক নয় এবং একটা বড় অংশ সংবিধানে দেয়া রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে কিংবা অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাহী ক্ষমতার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে পারে এবং ইতোমধ্যে এমন অনেক বিষয়ই এভাবে বাস্তবায়ন করে ফেলেছে সরকার।
কিন্তু দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা, নতুন কাঠামোর সংসদীয় কমিটি ও তত্ত্ববধায়ক ব্যবস্থা কিংবা নির্বাচন কমিশনের মত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ নিরপেক্ষ হওয়ার ব্যাপারে যেসব সিদ্ধান্ত সংবিধানের সঙ্গে সম্পর্কিত, সেসব বাস্তবায়ন কি আরেকটি সংসদের আগে সম্ভব?
এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, ‘একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে না ১০ বছর সেটার জন্য তো আমাকে ৩১ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে যেগুলোতে আমরা শতভাগ একমত সেগুলো এখনি বাস্তবায়ন হোক।’
বিতর্ক যাই থাক, জুলাই সদনের বাস্তবায়ন নিয়ে মোটা দাগে যে ৩টি দাবি দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সেটি হলো, গণপরিষদ নির্বাচন, গণভোট এবং নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ গঠনের হলে, সেই সংসদের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে গণপরিষদ কতটা ভালো উপায়?
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সদস্য এম মঈন আলম ফিরোজী বলেন, ‘গণপরিষদ হলে সমস্যা না কিন্তু গণপরিষদ হতে গেলে যে ফ্রেম ওয়ার্ক তৈরি করতে হবে সেখানে বর্তমান সংবিধান টেকনিক্যালি বন্ধ করে দিতে হবে।’
সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. শরীফ ভূঁইয়া বলেন, ‘নির্বাচিত সরকারের জন্য আমরা যদি রেখে দেই তাহলে সাংবিধানিকভাবে সেটা সর্বোত্তম ব্যবস্থা। পরবর্তী সংসদ এসে যদি এটা বাস্তবায়ন না করে তাহলে এ জলাই বিপ্লব থেকে আমাদের একটা প্রাপ্তি হবে শেখা হাসিনা ক্ষমতায় নেই।’
অবশ্য আওয়ামী লীগ আমলে আনা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পর গণভোট বাতিল হয়ে যাবার পর, সাম্প্রতিক সময়ে গণভোট যে আবার করার সুযোগ হয়েছে তা স্পষ্ট হয়েছে, সংশোধনটি বাতিলের হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর। এবং গণভোটের আগের বিধান কার্যকর হলে, এটা দিয়ে সংবিধান সংশোধনও সম্ভব এবং এভাবে দেশের ইতিহাসে সংবিধান সংশোধনের নজিরই আছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর কিছু নেতিবাচক দিকও আছে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞদের কথায় এটা স্পষ্ট, আইনসভার পাশাপাশি সনদ বাস্তবায়নের অন্য আরও অনেক উপায় আছে যদি রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়। কাজেই আলোচিত এই দলিলের মৌলিক ও সাংবিধানিক দিকগুলো এখনই কার্যকর হচ্ছে কি না, তা নির্ভর করছে তৃতীয় দফায় ঐকমত্যের ছায়া কতটা বিস্তৃত হয়, তার উপরই।