Image description
বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী এখন নিজেকে নতুনভাবে উপস্থাপন করতে চাইছে—জুলাই বিপ্লবের প্রগতিশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক চেতনার অগ্রণী বাহক হিসেবে। কিন্তু এই রূপান্তর কতটা কার্যকর হবে?
-------------
শফি মোস্তফা
৩ মে, ২০২৫
*************
“ইসলামপন্থী বামপন্থা”—শব্দযুগল শুনলেই অনেকের কাছে পরস্পরবিরোধী মনে হতে পারে। কারণ, ইসলামপন্থী দলগুলিকে বরাবরই রক্ষণশীল রাজনীতির ধারক হিসেবে দেখা হয়। অথচ ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশে এই নতুন রাজনৈতিক প্রবণতা জায়গা করে নিচ্ছে। এর নেতৃত্বে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ (জেআই), দেশের সবচেয়ে পুরোনো ইসলামপন্থী দল।
দীর্ঘদিন ধরেই জেআই জাতীয় রাজনীতিতে বড় কোনো সাফল্য পায়নি। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার দেশ হয়েও তাদের ভোটশেয়ার সচরাচর ১০ শতাংশের নিচে থেকেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পালাবদল এবং কৌশলগতভাবে প্রগতিশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভাষায় ঝুঁকে পড়ায় জামায়াত নতুন পরিচয়ে হাজির হয়েছে। এই নতুন অভিমুখ এক ধরনের “ইসলামপন্থী বামপন্থা”—যেখানে ইসলামী মূল্যবোধের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমতা, মানবিক মর্যাদা এবং সর্বজনীন নাগরিক অধিকার।
ইতিহাস ও সংস্কৃতির বোঝা
---------------------------
বাংলাদেশে সুফিবাদই মূলত ইসলামি চেতনার প্রধান স্রোত। আধ্যাত্মিকতা, মানবিকতা ও অন্তর্ভুক্তির বার্তা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গ্রামের সাধারণ মানুষের মন জয় করেছে। সেখানে জামায়াতের কঠোর আদর্শিক অবস্থান খুব একটা সাড়া জাগাতে পারেনি।
অন্যদিকে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জামায়াতকে ভারাক্রান্ত করেছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার বিরোধিতা তাদের ওপর “রাষ্ট্রবিরোধী” তকমা এঁকে দিয়েছে। যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত নেতাদের ফাঁসি দলের ভাবমূর্তিকে আরও গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে। তাই বহু বাংলাদেশির চোখে জামায়াত এখনো মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, অর্থাৎ রাষ্ট্রবিরোধী।
শহুরে মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী ও সংবাদমাধ্যম—যারা মূলত ধর্মনিরপেক্ষ ও উদারপন্থী মূল্যবোধে অভ্যস্ত—তাদের কাছেও জামায়াতের পুরোনো ইসলামপন্থী প্ল্যাটফর্ম গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ফলে দলটি প্রভাবশালী নগর শ্রেণির সমর্থন থেকে বঞ্চিত থেকেছে।
তার ওপর, দেশে সক্রিয় শতাধিক ইসলামপন্থী দলের ভিড়ে জামায়াতের বিশেষত্ব ম্লান হয়ে গেছে। মূলধারার বড় দলগুলোও ইসলামি প্রতীক ও ভাষণ ব্যবহার করে ভোটারদের আকৃষ্ট করে। ফলে জামায়াতের বার্তা স্বকীয়তা হারিয়েছে।
জুলাই বিপ্লবের সুযোগ
-------------------------
২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব দেশের রাজনৈতিক সমীকরণ নাড়িয়ে দেয়। ছাত্রনেতৃত্বাধীন এই আন্দোলন শাসকশ্রেণিকে কঠিন চাপে ফেলে দেয়। আর ঠিক তখনই জামায়াত নিজেকে “বিপ্লব-সমর্থক” শক্তি হিসেবে উপস্থাপনের সুযোগ খুঁজে নেয়। এর ফলে দলটি হঠাৎ করেই মিডিয়ার আলোচনায় উঠে আসে এবং জনগণের মধ্যে নতুন করে আগ্রহ সৃষ্টি করে।
পরবর্তী ভয়াবহ বন্যা জামায়াতকে জনতার পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দেয়। ত্রাণ ও সামাজিক সহায়তার কার্যক্রম চালিয়ে দলটি ইসলামী কল্যাণরাষ্ট্রের স্বপ্নকে কার্যত বাস্তব রূপ দিতে চেয়েছে। জনগণ সেখানে দেখেছে সামাজিক ন্যায়ের এক বিকল্প রূপকল্প।
নতুন বার্তা, নতুন রূপ
--------------------------
জামায়াত এখন নিজেদের বক্তব্যে প্রগতিশীল উপাদান যুক্ত করছে—মানবাধিকার, সামাজিক ন্যায়বিচার, অন্তর্ভুক্তি। দলীয় নেতারা কল্যাণরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। আমির শফিকুর রহমান জনগণকে আশ্বস্ত করেছেন—“কেউ বেকার থাকবে না।” আর বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে “বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান ইসলাম”—এই স্লোগান আরও শক্তি পেয়েছে।
সংখ্যালঘু অধিকার নিয়েও দলটি নরম ভাষা ব্যবহার করছে। নেতা ঘোষণা দিয়েছেন—সংখ্যালঘুরা পূর্ণ নাগরিক অধিকার ভোগ করবে, যেমন মুসলমানরা নির্ভয়ে ধর্ম পালন করে। এটি জামায়াতের অতীতের কঠোর অবস্থান থেকে দৃশ্যমান সরে আসা।
নারীর ভূমিকা নিয়েও দলটি এখন তুলনামূলক প্রগতিশীল অবস্থান নিচ্ছে। আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের মডেল নয়, বরং “বাংলাদেশি পদ্ধতি”—যেখানে ইসলামি ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার সমন্বয় ঘটানো হবে। আমির মদিনা রাষ্ট্রের উদাহরণ টেনে বলেছেন, সেখানেও নারীরা রাষ্ট্র সংস্কারে অংশ নিয়েছিলেন এবং যুদ্ধেও অবদান রেখেছিলেন।
এমনকি ১৯৭১ সালের দায়-দায়িত্ব সম্পর্কেও জামায়াত সতর্কভাবে নতুন ভাষা ব্যবহার করছে। নেতারা বলছেন, প্রমাণিত হলে তারা ক্ষমা চাইতে প্রস্তুত। যদিও এটি শর্তযুক্ত বক্তব্য, তবুও ইতিহাসের সঙ্গে আপসের ইঙ্গিত দলটির ভাবমূর্তিতে বড় পরিবর্তন নির্দেশ করছে।
উপসংহার
----------
বাংলাদেশে ইসলামপন্থী রাজনীতির নতুন অধ্যায় যেন শুরু হচ্ছে। জামায়াতের দীর্ঘদিনের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ইমেজ, সুফি ঐতিহ্যের প্রভাব, উদারপন্থী বুদ্ধিজীবীদের প্রতিরোধ—সবকিছুর মাঝেও জুলাই বিপ্লব দলটিকে নতুনভাবে দাঁড়ানোর সুযোগ দিয়েছে।
“ইসলামপন্থী বামপন্থা”র এই নতুন রূপ সামাজিক ন্যায়, সমঅধিকার ও মানবাধিকারের আদর্শকে ইসলামী চেতনার সঙ্গে মেলাতে চাইছে। তরুণ প্রজন্ম, যারা একইসঙ্গে ধর্মীয় পরিচয় ও গণতান্ত্রিক আদর্শকে মূল্য দেয়, তাদের কাছে নতুন জামায়াত এখন নিজেদের গ্রহণযোগ্য করে তুলতে চাইছে।
ভবিষ্যৎই বলে দেবে—এই রূপান্তর কি স্থায়ী হবে, নাকি রাজনৈতিক বাস্তবতার চাপ সামলাতে জামায়াত কেবল সাময়িক কৌশল অবলম্বন করছে।
 
 
মোহাম্মদ নাকিবুর রহমান