
গতকাল গাজীপুরে সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ ও দোষীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় পার্টি মহাসচিব ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেছেন, গঠনতন্ত্রের ২০/২(খ) ধারাতে বলা হয়েছে চেয়ারম্যানের দীর্ঘ সময়ের অনুপস্থিতে সিনিয়র কো চেয়ারম্যান, কো-চেয়ারম্যান অথবা প্রেসিডিয়ামের কো সদস্যকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ করতে পারবেন। অর্থাৎ চেয়ারম্যান গঠনতন্ত্রের ক্ষমতাবলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিয়োগ করতে পারবেন। চেয়ারম্যান এখন দেশে আছেন, সুস্থ আছেন এবং নিয়মিত অফিসে আসেন, তাছাড়া কাউকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিয়োগ করেননি গোলাম মোহাম্মদ কাদের। চেয়ারম্যান দায়িত্ব না দিলে অন্য কোনো পন্থায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হওয়ার সুযোগ জাতীয় পার্টিতে নেই। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে তাদের কাজ করার প্রক্রিয়াটি শুরু থেকে বেআইনি এবং অবৈধ। বহিস্কৃতদের কাউন্সিলে জাতীয় পার্টির মূলধারার কোন নেতাকর্মী যাবে না। আমি মনে করি, আমরা দীর্ঘদিন একসাথে রাজনীতি করেছি, তাই শিষ্টাচারের কারণে তারা কাউন্সিল থেকে বিরত থাকবেন। তাদের এই কাউন্সিল রাজনীতিতে কোন সুবাতাস আনবে না। কারণ, তাদের এই কাউন্সিল আহ্বান সম্পূর্ণ অবৈধ। যারা জাতীয় পার্টি ভেঙেছে তারা কেউই রাজনীতিতে সফল হতে পারেনি। এরশাদের জাতীয় পার্টি বা জিএম কাদের এর জাতীয় পার্টি হচ্ছে মূল ধারার জাতীয় পার্টি। মূল ধারার জাতীয় পার্টি টিকে ছিল টিকে থাকবে।
শুক্রবার (৮ আগস্ট) জাতীয় পার্টি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, গেল ২৮ জুন জাতীয় পার্টির জাতীয় কাউন্সিল হবার কথা ছিল। হল বরাদ্দ না পাওয়ার কারণে কাউন্সিলটি স্থগিত করা হয়। ওই সময়ে হল কর্তৃপক্ষ আমাদের জানিয়েছিলেন, প্রধান উপদেষ্টার বাজেট সংক্রান্ত একটি সভা অনুষ্ঠিত হবে। তাই, তারা আমাদের হল ভাড়ার অগ্রিম টাকা গ্রহণ করেননি। পরবর্তীতে আমরা ২৭ তারিখেও হল চেয়েছিলাম। কিন্তু, হল কর্তৃপক্ষ লিখিতভাবে হল বরাদ্দ দেওয়ার ব্যাপারে অপারগতা প্রকাশ করেন। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, কিছু সিনিয়র নেতা এই বিষয়টিকে মিথ্যা দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এই ঘটনায় আমাদের কিছু সিনিয়র নেতারা ২৮ জুনই কাউন্সিল করার জন্য রেষারেষি শুরু করে। এর প্রেক্ষিতে ২৫ জুন জাতীয় পার্টির ৭৮টি ইউনিট কমিটির নেতৃবৃন্দ সভা করে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের এর উপরে পূর্ণ আস্থা ব্যক্ত করে। একই সাথে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। পরবর্তীতে ২৮ জুন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্যদের সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী সিনিয়র নেতাদের দল থেকে বহিষ্কার করার। প্রেসিডিয়াম সদস্যদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে ৩০ ধারা মোতাবেক জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের অনেককেই বহিষ্কার করেন। এর প্রেক্ষিতে বহিষ্কৃতরা একটি দেওয়ানী মোকদ্দমা করেন। দীর্ঘ শুনানির পরে মহামান্য বিজ্ঞ আদালত আদেশ দেন যে, আবেদনটি পরিবর্তিত আকারে মঞ্জুর করা হলো। আদালতের নির্দেশনাটি হলো জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান ও দফতর সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলার পরবর্তী ধার্য তারিখ পর্যন্ত সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এই আদেশে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানকে বাতিল করা হয়নি, চেয়ারম্যান পদ অবৈধ ঘোষণা করা হয়নি এবং বর্তমান চেয়ারম্যান কে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়নি। মানে হচ্ছে যারা প্রাথমিক সদস্য পদ সহ বহিষ্কৃত হয়েছে, তারা অদ্যাবধি পর্যন্ত বহিষ্কৃত আছে। যারা বহিষ্কৃত হয়েছেন তাদের পক্ষে জাতীয় পার্টির কোন সভায় অংশ নেওয়া অবৈধ। তারা কোন সভা ডাকতে পারেন না এবং প্রেসিডিয়াম সভা করতে পারেন না। বহিস্কৃতদের কাউন্সিল ডাকার অধিকার নেই। অনেকেই জাতীয় পার্টির পদপদবি ব্যবহার করে সভা করছেন, কেউ মহাসচিব দাবি করছেন। প্রকৃতপক্ষে আদালতের আদাশে মহাসচিব শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি এবং আদেশেও মহাসচিবের বিষয় উল্লেখ করা হয়নি। তাহলে আরেকজন কি করে মহাসচিব দাবি করেন? আমরা লক্ষ্য করছি আদালতের রায়ের অপব্যাখ্যা হচ্ছে। নেতাকর্মীদের বিভ্রান্ত না হতে অনুরোধ জানাচ্ছি।
সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় পার্টি মহাসচিব ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের সকল সিদ্ধান্ত সভা করে সবার মতামতের ভিত্তিতে নিয়ে থাকেন। জাতীয় পার্টি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হচ্ছে। যারা এই পার্টিতে নেতা হয়েছেন তারা গঠনতন্ত্র মোতাবেক পদোন্নতি পেয়েছেন। আবার, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তারা বহিষ্কৃতও হয়েছেন। বহিষ্কৃতরা যে সভা করছে তা গঠনতন্ত্র বিরোধী এবং বেআইনি। আদালতের আদেশকে অপব্যাখ্যা করা হচ্ছে যা আদালত অবমাননার শামিল। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমাদের জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে বিরত আছেন।
দেশে এখন নির্বাচনের কোনো পরিবেশ নেই। রাষ্ট্রের উপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এমন বাস্তবতায় মনে হচ্ছে নির্বাচন করার জন্য সরকারের কোন আন্তরিকতা ছিল না। নির্বাচন নিয়ে সরকার নতুন ইনিংস শুরু করেছে, আমরা দেখতে চাই এই ইনিংসে সরকার কেমন ব্যাটিং বোলিং করে। এর পরেই আমরা নির্বাচনের ব্যাপারে সঠিক মন্তব্য করতে পারবো। এখন যদি সরকার সচেষ্ট হয় তাহলে আগামী ৬ মাসের মধ্যে হয়তো নির্বাচন করা সম্ভব হবে। নির্বাচনের জন্য সরকারের সদিচ্ছা ও সক্ষমতা থাকতে হবে।
তিনি বলেন, জাতীয় পার্টির সাথে বর্তমান সরকার অবিচার করছে। অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সাথেও নির্বাচন কমিশন দফায় দফায় সভা করছে। কিন্তু, নিবন্ধিত এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ জাতীয় পার্টিকে সভায় ডাকছে না। নির্বাচন কমিশন সংবিধানের শপথ নিলে অবশ্যই জাতীয় পার্টিকে আলোচনায় ডাকা উচিত। নির্বাচনে লেভেল প্লেয়েইং ফিল্ড না থাকার এটি একটি বড় নিদর্শন হচ্ছে জাতীয় পার্টিকে আলোচনায় ডাকা হচ্ছে না। অপর এক প্রশ্নের জবাবে জাতীয় পার্টি মহাসচিব বলেন, রাজনীতিতে সকল দলেরই ভুল ত্রুটি আছে, ২০১৪ সালে আমরা নির্বাচন বর্জন করেছি। জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান জিএম কাদের এর নেতৃত্বে ২৭০ জন এর বেশী প্রার্থী নির্বাচন বর্জন করেছিল। পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং গোলাম মোহাম্মদ কাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করেছিলেন। পরবর্তীতে এরশাদ স্যার কে সিএমএইচ এ ভর্তি করে কি করা হয়েছিল তা আপনারা সবাই জানেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে দেশের প্রায় সকল দলই অংশ নিয়েছিল। সেই নির্বাচনটিও প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। আগামী দিনে আমরা গণমানুষের প্রত্যাশা এবং তারুণ্যের স্বপ্নকে সামনে রেখে রাজনীতি করবো। তিনি বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের পক্ষে সংসদে একমাত্র জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের জোরালোভাবে বক্তৃতা করেছেন। গেল বছর ২৫ জুলাই বর্ধিত সভা ডেকে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়েছিল জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল। রংপুরে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে আমাদের দু’জন নেতা শহীদ হয়েছেন। অন্তত ৪ জন কারাবরণ করেছে এবং কয়েকশ’ নেতাকর্মী মামলায় জর্জরিত হয়ে পালিয়ে বেরিয়েছিল। তখন জাতীয় পার্টি বলেছিলো, সরকার যা করছে তা পরিস্কারভাবে গণহত্যা। সেসময়ে গণহত্যা বন্ধের দাবিও জানিয়েছিল জাতীয় পার্টি। দুঃখের বিষয় হচ্ছে আন্দোলনের পরে আমরা দেখলাম আন্দোলনের কৃতিত্ব একটি ক্ষুদ্র অংশ দখল করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জাতীয় পার্টি গণতান্ত্রিক দল, গণতান্ত্রিক চর্চায় জাতীয় পার্টিকে রাখতে হবে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে দেশে যদি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না থাকে, পুলিশ ও প্রশাসন যদি সঠিকভাবে কাজ না করে এবং নির্বাচনে লেভেল প্লেয়েইং ফিল্ড না থাকে তাহলে নির্বাচনে অংশ নেওয়া হচ্ছে হাত পা বেধে সাঁতার কাটতে নামার শামিল। সরকার যদি শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ হয় তবেই আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবো।
অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন, এডভোকেট মোঃ রেজাউল ইসলাম ভুঁইয়া, আলমগীর শিকদার লোটন, ইঞ্জিনিয়ার ইকবাল হোসেন তাপস, অধ্যাপক মহসিনুল ইসলাম হাবুল, বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট মমতাজ উদ্দিন, ইঞ্জিনিয়ার মইনুর রাব্বি চৌধুরী রুম্মন, চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা হেনা খান পন্নী, প্রফেসর ডক্টর গোলাম মোস্তফা, মোঃ খলিলুর রহমান খলিল, ভাইস চেয়ারম্যান আমির উদ্দিন ডালু, মোঃ হেলাল উদ্দিন, এম এ সোবাহান আখতার হোসেন দেওয়ান, চেয়ারম্যানের প্রেস সেক্রেটারি খন্দকার দেলোয়ার জালালী, যুগ্ম দফতর সম্পাদক সমরেশ মন্ডল মানিক প্রমুখ।