
জিয়াউর রহমান ফোবিয়ায়’ ভুগতেন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। এ কারণে উচ্চ আদালতের বিচারিক দায়িত্ব পালনের পুরোটা সময় বীর উত্তম জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে একের পর এক বিতর্কিত রায় দিয়ে গেছেন। এসব রায়ের মধ্যে রয়েছে—শিশু একাডেমির জায়গার মালিকানা বাতিল, সামরিক ট্রাইব্যুনালে হওয়া কর্নেল তাহেরের রায়কে হাইকোর্টে টেনে এনে শহীদ জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা, শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যা মামলায় জিয়াউর রহমানকে জড়ানো, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জিয়া শিশু পার্কের ওপর খড়্গ, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের প্রধান জিয়াকে স্বাধীনতাবিরোধী ঘোষণা করা, মুফতি আমিনীর মামলায় জিয়াকে নিয়ে বিষোদ্গার ইত্যাদি।
আওয়ামী লীগের ক্যাডার বিতর্কিত বিচারপতি মানিক সম্পর্কে উচ্চ আদালতের আইনজীবী ও বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা বলেন, উচ্চ আদালতের অধিকাংশ মামলার শুনানিতে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ও দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে অপ্রাসঙ্গিকভাবে বিষোদ্গার ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করে বিতর্কেরও জন্ম দেন তিনি। প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে জিয়াউর রহমানের নাম থাকায় বিতর্কিত রায় দিয়ে শিশু একাডেমি ও জিয়া শিুশু পার্ক উচ্ছেদের পথ করে দেন বিতর্কিত এই বিচারপতি। হাইকোর্টের কয়েকটি মামলার রায় পর্যালোচনা করে বিচারপতি মানিকের বিভিন্ন অপকর্ম সম্পর্কে জানা গেছে। তার দেওয়া অধিকাংশ রায়ে শেখ হাসিনার ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটত বলেও জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
আইনজীবীরা জানান, শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বিচারকের আড়ালে ছিলেন শেখ হাসিনার লাঠিয়াল বাহিনীর সদস্য। আদালতে তার দেওয়া অধিকাংশ রায়ে আইন ও বিধি-বিধানের পরিবর্তে শেখ হাসিনার ইচ্ছার প্রাধান্য থাকত। বিচারকের পদ থেকে অবসর নেওয়ার পরও জিয়া পরিবারকে নিয়ে কুৎসা রটনা, অপপ্রচার ও মিথ্যাচার করা ছিল তার নিত্যদিনের কর্মসূচি। বিভিন্ন সংগঠনের নামে জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়াকে ‘গালিগালাজ’ করতে অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন নিজেই। গুলশানে খালেদা জিয়ার বাসভবন ঘেরাওয়ের কর্মসূচি পালন করে ‘কালা মানিক’ খ্যাতি পান। জাতীয় সংসদ তাকে অপসারণের রুলিং দিয়ে ‘স্যাডিস্ট’ আখ্যা দেয়। এটির উল্লেখ সংসদের কার্যবিবরণীতেও রয়েছে।
শিশু একাডেমি নিয়ে বিতর্কিত রায় মানিকের
প্রতি বছর দেশের পাঁচ হাজারেরও বেশি শিশু-কিশোর বাংলাদেশ শিশু একাডেমিতে সাংস্কৃতিক প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকে। এ কারণে তাদের জন্য সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশের একটি উজ্জ্বল প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে শিশু একাডেমি। এর সঙ্গে স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নাম যুক্ত। তিনি ১৯৭৭ সালে এই শিশু একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। একাডেমির মিলনায়তনের নাম ছিল জিয়াউর রহমান মিলনায়তন।
শিশু একাডেমি নিয়ে বিতর্কিত বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রায় দেন। শিশু-কিশোরদের সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশের স্বার্থে বর্তমান উচ্চ আদালত ন্যাবিচারের লক্ষ্যে বিচারপতি মানিকের উদ্দেশ্যমূলক রায় পুনর্বিবেচনা করবে—আইনজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এমনটাই আশা করছেন।
গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এক সময় শিশু একাডেমির জমিটি ছিল ভারত সম্রাটের। ১৯০৫ সাল থেকে এটি গভর্নর হাউস হিসেবে ব্যবহৃত হতো। গণপূর্ত বিভাগের নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, জমিটি ভারত সম্রাটের পক্ষে পূর্ত বিভাগের নামে রেকর্ডভুক্ত। পরে পূর্ত বিভাগ তিনটি ধাপে বাংলাদেশ শিশু একাডেমিকে মোট ৩ দশমিক ৬৯১ একর জমি বরাদ্দ দেয়। এর মধ্যে ১৯৭৭ সালের ২৫ অক্টোবর জিয়াউর রহমান শিশু একাডেমির অনুকূলে ১ দশমিক ৩২ একর জমি বরাদ্দ দেন। শিশু একাডেমির সব স্থাপনা এই জমিতে রয়েছে। পরে ১৯৮৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর ২ দশমিক ১০৮ একর জমি ১০০১ টাকা প্রতীকী মূল্যে শিশু একাডেমিকে দীর্ঘমেয়াদি ইজারা দেওয়া হয়।
এছাড়া ১৯৯০ সালের ১৮ জানুয়ারি আরো শূন্য দশমিক ২৬৩ একর জমি ১০০১ টাকা প্রতীকী ইজারা মূল্যে শিশু একাডেমিকে দীর্ঘমেয়াদি ইজারা দেওয়া হয়। বরাদ্দপত্রে এই জমির পূর্বতন মালিক হিসেবে নবাব সলিমউদ্দিন বাহাদুরের নাম উল্লেখ রয়েছে।
২০১১ সালে জনৈক আসাদুজ্জামান সিদ্দিকী ও আকলাস উদ্দিন ভূঁইয়া নামে দুই ব্যক্তি শিশু একাডেমির জায়গা সুপ্রিম কোর্টের সম্পদ দাবি করে হাইকোর্টের বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও বিচারপতি শেখ জাকির হোসেনের বেঞ্চে রিট আবেদন করেন। রিট গ্রহণ করে বিচারপতি মানিকের বেঞ্চ ওই বছরের ১০ মার্চ রায় ঘোষণা করে শিশু একাডেমির পাশাপাশি সড়ক ভবনও সুপ্রিম কোর্টকে বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশনা জারি করে। দুই সপ্তাহ পর ২৫ মার্চ অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ শিশু একাডেমিকে দ্রুত জমি ছেড়ে দেওয়ার জন্য একটি নোটিস জারি করেন। পাশাপাশি সড়ক ভবন সরিয়ে নেওয়ার জন্যও সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে নোটিস পাঠান মনজিল মোরশেদ।
শিশু একাডেমির বিষয়ে বিচারপতি মানিকের রায় প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি শিশু একাডেমি ভেঙে ফেলার জন্য কথাবার্তা চলছে। আমরা এ ধরনের প্রক্রিয়া বা প্রস্তাবের বিরোধিতা করি।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘বিরোধিতা করি এই কারণে যে, এটা বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান, যেটার মাধ্যমে শিশুদের বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম তাদের (শিশুদের) গঠন, বেড়ে ওঠা, মনমানসিকতা তৈরি করা, এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাকটিভিটিজ তৈরি করা হয়। এ ব্যাপারে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং তিনিই প্রথম শিশু একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সারা দেশে এটার শাখা রয়েছে। সুতরাং এ প্রতিষ্ঠানকে এখান থেকে সরানোটা আমি মনে করি একেবারেই সঠিক সিদ্ধান্ত হবে না। এ ব্যাপারে আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য, আমরা চাই না শিশু একাডেমি ভবনটি ওই জায়গা থেকে স্থানান্তর করা হোক বা অন্য জায়গা দেওয়া হোক। আমার মনে হয় এটা জাতি গঠনের ব্যাপারে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।’
কর্নেল তাহেরের মামলার রায়ে জিয়াকে নিয়ে অপ্রাসঙ্গিক পর্যবেক্ষণ
সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহের দায়ে ১৯৭৬ সালে সামরিক ট্রাইব্যুনালে জাসদ নেতা লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ তাহেরের ফাঁসি হয়। রায় কার্যকরের ৩৫ বছর পর ওই ঘটনাকে বিচারপতি মানিক হাইকোর্টে টেনে আনেন।
২০১১ সালের ২২ মার্চ মানিকের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ তাহেরের মৃত্যুদণ্ডকে ‘ঠান্ডা মাথার খুন’ হিসেবে চিত্রিত করতে সরকারের প্রতি নির্দেশনা দিয়ে রায় দেয়। ১৯৮ পৃষ্ঠার রায়ে বিচারপতি মানিক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রতি অপ্রাসঙ্গিকভাবে বিষোদ্গার ও তীব্র আক্রমণ করেন। রায়ে উল্লেখ করা হয়, ‘কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ড ছিল হত্যাকাণ্ড। কারণ, ট্রাইব্যুনাল গঠনের অনেক আগেই জেনারেল জিয়াউর রহমান কর্নেল তাহেরকে মৃত্যুদণ্ড দিতে মনস্থির করেন।’
রায়ে বলা হয়, ‘যেহেতু জেনারেল জিয়া জীবিত নেই, আইন অনুযায়ী তার বিচার সম্ভব নয়। এর পরও সরকারের উচিত হবে এ হত্যার জন্য দায়ী কেউ জীবিত থাকলে তাকে খুঁজে বের করে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করা।’
মুজিব হত্যায় শহীদ জিয়াকে জড়িয়ে রায়
কর্নেল তাহেরের বিষয়ে দেওয়া রায়ে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা তুলে ধরেন বিচারপতি মানিক। রায়ের একটি অংশে মুজিব হত্যায় শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে দাবি করে বলা হয়, ‘জেনারেল জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ছিলেন। যদিও বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনা এ মামলার বিচার্য বিষয় নয়। ওই সময় হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়েছে।’
রায়ের পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি নিয়মিত সভা-সমাবেশে অংশ নিয়েও জিয়াউর রহমানকে নিয়ে বিষোদ্গার করে বেড়াতেন বিচারপতি মানিক। বিতর্কিত সংগঠন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির (ঘাদানিক) উপদেষ্টা হিসেবে পরিচয় দিয়েও বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তব্য দিতেন।
২০১৯ সালের ১৭ আগস্ট জাতীয় প্রেস ক্লাবে আলোচনা সভায় মানিক বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ছক ১৯৭৩ সালে আমেরিকায় গিয়ে জিয়া এঁকেছেন। তিনিই এই ছক কষেছিলেন। কেন তিনি আমেরিকায় গিয়েছিলেন, তা বের করার জন্য উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে। কেন তিনি আমেরিকায় গেলেন, কেন একটি স্যুটকেস আনার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন? জিয়া হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছেন। এ ব্যাপারটিও তদন্তে আনা উচিত। জিয়াকে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপের জন্য এ দুটি তদন্ত কমিশন গঠন করা দরকার। জিয়া শুধু বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল নায়ক ছিলেন তা নয়, তিনি দেশকে ধ্বংস করে দিয়ে গিয়েছিলেন।’
রমনা শহীদ জিয়া শিশু পার্কে মানিকের খড়্গ, তাপসের পেট ভারী
কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে দেওয়া রায়ে শাহবাগের শিশু পার্কের বিরুদ্ধেও বিষোদ্গার করেন বিচারপতি মানিক। ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে তিনি উল্লেখ করেন, ‘পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর জিয়াউর রহমানের কর্মকাণ্ডে স্বাধীনতাবিরোধী অবস্থানের প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি মুক্তিযুদ্ধের জয় বাংলা স্লোগান মুছে ফেলেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের স্থান রেসকোর্স ময়দানকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পরিণত করেন এবং সেখানে শিশু পার্ক স্থাপন করেন। কুখ্যাত রাজাকার শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রীর পদ দেন জিয়াউর রহমান। স্বাধীনতাবিরোধী কর্নেল মুস্তাফিজুর রহমানকে দেন মন্ত্রীর পদ। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সেনা কর্মকর্তাদের উচ্চপদে আসীন করেন তিনি।’
বিচারপতি মানিকের এমন বিতর্কিত রায়ের পর স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকার শিশু-কিশোরদের প্রিয় পার্কটি বন্ধ করে দেয়। ১৯৮৯ সালে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের অধীন শিশু পার্কটি স্থাপন করেন। ২০১৯ সালে জিয়াউর রহমানের নাম বাদ দিয়ে পার্কটির আধুনিকায়নের নামে ৬০৪ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প নেয় আওয়ামী লীগ সরকার।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্র জানিয়েছে, প্রথমে পার্কটি পর্যটন করপোরেশনের অধীন থাকলেও পরে এটি পরিচালনার দায়িত্ব পায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। জিয়া শিশু পার্কের নাম বদলে পার্কটি সংস্কারের জন্য একনেকে প্রথমে ৭৮ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। পরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের একান্ত আগ্রহে এ প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে ৬০৩ কোটি ৮১ লাখ টাকা করা হয়। এর মধ্যে ৪৮৩ কোটি টাকা দেবে সরকার। সরকারের দেওয়া টাকার অর্ধেক অনুদান, বাকিটা ঋণ। আর দক্ষিণ সিটির নিজস্ব তহবিল থেকে এ প্রকল্পে ১২০ কোটি টাকা খরচ করা হবে বলে অনুমোদিত নথিতে উল্লেখ করা হয়।
জিয়াকে স্বাধীনতাবিরোধী আখ্যা
বিচারপতি মানিক উচ্চ আদালতের বিচারক হয়ে নিয়মিত আওয়ামী লীগের সভা-সমাবেশে নিয়মিত অংশ নিতেন। তিনি অধিকাংশ বক্তব্যে জিয়াউর রহমানের প্রসঙ্গ নিয়ে আসতেন। ২০২৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, ‘জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রবেশকারী ও পাকিস্তানের চর।’
একই অনুষ্ঠানে জিয়াউর রহমানকে রাজাকার হিসেবে চিহ্নিত করে মানিক বলেন, ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করেছিল, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নাম, চেহারা, বৈশিষ্ট্য সব পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন জিয়া। তিনি একজন রাজাকার। তিনি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশে আবার ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সূচনা করেছিলেন।’
মুফতি আমিনীর মামলার শুনানিতেও জিয়াকে নিয়ে বিষোদ্গার
সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে নতুন সংবিধান ছাপানোর ঘটনায় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করে ২০১১ সালের ১৪ জুলাই রাজধানীর লালবাগে আয়োজিত এক সমাবেশে বক্তব্য দেন ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মুফতি ফজলুল হক আমিনী। তিনি বলেন, ‘আমরা এ সংশোধনী মানি না। আমরা এটি ছুড়ে ফেলে দেব।’
ওই বক্তব্যের এক সপ্তাহ পর ২০ জুলাই শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক মুফতি আমিনীকে হাইকোর্টে তলব করেন। এর আগেই সরকার লালবাগে আমিনীকে গৃহবন্দি করে রাখে। ২৭ জুলাই পুলিশ মুফতি আমিনীকে হাইকোর্টে বিচারপতি মানিকের আদালতে হাজির করে। আমিনীর পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক। শুনানিতে অংশ নিয়েছিলেন এমন একজন আইনজীবী আমার দেশকে বলেন, ‘মুফতি আমিনীর হাজিরা উপলক্ষে আদালতে কয়েকশ আইনজীবী আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন। বিচারপতি মানিককে আমরা ওইদিন সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় দেখিনি। উন্মাদের মতো আচরণ করছিলেন। মুফতি আমিনীকে তিনি প্রকাশ্য আদালতে সবার সামনে পিটিয়ে পিঠের চামড়া তুলে নেওয়ার জন্য কয়েকবার নির্দেশ দেন।’
শুনানির একপর্যায়ে অপ্রাসঙ্গিকভাবে জিয়াউর রহমান ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে টেনে এনে বেঞ্চ অফিসারকে (বিও) নির্দেশনা লিখতে বলেন। একপর্যায়ে বিচারপতি মানিক বলেন, ‘জিয়াই আপনাদের রাজনীতির সুযোগ করে দেশকে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। এজন্য তার বিচার করতে হবে। খালেদা জিয়ারও বিচার করতে হবে এই কারণে, তার প্রশ্রয়ে থেকে আপনারা দেশ ও সংবিধানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।’
আদালতে এ সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শী এক সাংবাদিক আমার দেশকে জানান, শুনানির একপর্যায়ে বিচারপতি মানিক বিএনপি চেয়ারপারসনকেও আদালতে হাজির হওয়ার আদেশ দিতে চাইলে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের নেতারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখান। একই সঙ্গে বিচারপতি মানিককে চ্যালেঞ্জ করেন কয়েকশ আইনজীবী। তারা এমন বেআইনি আদেশ দিলে বিচারপতি মানিককে আদালত কক্ষ থেকে বের হতে দেবেন না বলেও হুঁশিয়ার করে দেন। আইনজীবীরা বিচারপতি মানিকের হাত থেকে ‘তলবের নথি’ নিয়ে ছিড়ে ফেলে দেন। আইনজীবীদের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখে তিনি এজলাসের পেছনের দরজা দিয়ে খাসকামরায় গিয়ে আশ্রয় নেন। তখন পুলিশ মুফতি আমিনীকে নিয়ে দ্রুত হাইকোর্ট এলাকা ত্যাগ করে।
শামসুদ্দিন মানিকের বিচারিক এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। আমার দেশকে তিনি বলেন, আমি যতটুকু জানি তাকে (মানিক) বেআইনিভাবে শেখ হাসিনা বিচারক বানিয়েছিলেন। কারণ মানিকের দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে। আমাদের প্রচলিত সংবিধান অনুযায়ী এমন ব্যক্তি উচ্চ আদালতের বিচারপতি হতে পারেন না। কাজেই মানিক সাহেব যত রায় দিয়েছেন, সবই বেআইনি ও এখতিয়ারবহির্ভূত।
খালেদা জিয়ার বাড়ি ঘেরাওয়ের নেতৃত্ব দেন
বিচারকের আসনে বসে শুধু জিয়াউর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধেই বিষোদ্গার করেননি, আদালতের বাইরেও জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানোয় ভূমিকা পালন করে শেখ হাসিনার লাঠিয়াল বাহিনীর নেতৃত্ব দেন মানিক।
২০১৫ সালের ২১ ডিসেম্বর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে বিএনপির এক আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের মক্তিযুদ্ধের চেতনা বাণিজ্যের সমালোচনা করে বক্তব্য দেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিবের ভূমিকা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বিভিন্ন ধরনের দেশবিরোধী অপকর্মের ফিরিস্তি তুলে ধরেন। ওই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে বিচারপতি মানিকের নেতৃত্বে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি (ঘাদানিক) বিএনপি চেয়ারপারসনকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে তার গুলশানের বাড়ি ঘেরাও করে।
বিচারপতি মানিককে আওয়ামী লীগের লাঠিয়াল বাহিনীর সর্দার হিসেবে উল্লেখ করেন বিএনপি নেতারা। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল আমার দেশকে বলেন, আমরা আগে শুনতাম সাত রাজার ধন মানিক আর গত সাড়ে ১৫ বছরে শেখ হাসিনার দুঃশাসনের সময় দেখলাম এক রানির ধন মানিক। এই মানিক শুধু আওয়ামী লীগের লাঠিয়ালই ছিলেন না, তিনি জাতীয় সংসদ কর্তৃক স্বীকৃত একজন স্যাডিস্টও ছিলেন। এই লোকটি বিচারকের ক্ষমতার অপব্যবহার করে জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে বেআইনি সব কর্মকাণ্ড করে ঘৃণার পাত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। বিচার বিভাগ থেকে বিদায় নেওয়ার পরও জিয়া পরিবারের ওপর তিনি বিভিন্নভাবে তার জিঘাংসা ও ক্ষোভ চরিতার্থ করেছেন। চেয়ারপারসনের গুলশানের বাড়ি ঘেরাও করা তার নিকৃষ্ট উদাহরণ। তবে তার রানি হাসিনা পালিয়ে গিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে পারলেও ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, মানিক সীমান্তে ভবঘুরে অবস্থায় জনতার হাতে ধরা পড়েন। তার প্রতিটি অপকর্মের পৃথক বিচার হওয়া জরুরি বলেও মনে করেন বিএনপির এই নেতা।
মানিক ‘স্যাডিস্ট’, অপসারণে সংসদ রুলিং দিয়েছিল
শিশু একাডেমি ও সড়ক ভবন স্থানান্তরের বিষয়ে বিচারপতি মানিকের আদালতের রায় নিয়ে ওই সময় জাতীয় সংসদেও তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সংসদ সদস্যরা মানিকের এমন রায় দেওয়ার এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। একই সঙ্গে তাকে বিকৃত মস্তিষ্কের ও ‘স্যাডিস্ট’ উল্লেখ করে তারা বক্তব্য দেন। এ বিষয়ে স্পিকারও একটি রুলিং দেন।
জাতীয় সংসদের এ-সংক্রান্ত কার্যবিবরণী থেকে জানা গেছে, স্পিকার ২০১২ সালের ২৯ মে সংসদে বলেন, ‘আদালত তাদের নিজেদের প্রয়োজনে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেও সাধারণ মানুষকে বিচার পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়।’ স্পিকারের মন্তব্যের আগে বিতর্কিত রায়কে কেন্দ্র করে বিচারপতি মানিকের তীব্র সমালোচনা করে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, তোফায়েল আহমেদ, শেখ সেলিম এবং রাশেদ খান মেনন বক্তব্য দেন। সে সময় এমপিরা টেবিল চাপড়ে সেসব বক্তব্য সমর্থন করেন। তারা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে বিচারপতি মানিককে অপসারণের জন্য তিনদিনের সময়সীমাও বেঁধে দেন। এর ধারাবাহিকতায় ওই বছরের ১৮ জুন স্পিকার আবদুল হামিদ সংসদে রুলিং দেন। সেখানে এ বিষয়ে প্রধান বিচারপতিকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
আওয়ামী ক্যাডার থেকে বিচারিক লাঠিয়াল
শামসুদ্দিন মানিকের সুপ্রিম কোর্টের সহকর্মীরা জানিয়েছেন, যুক্তরাজ্যে পড়ালেখার পর ব্রিটিশ নাগরিকত্ব নিয়ে সেখানেই বসবাস করেন মানিক। ১৯৭৮ সালে দেশে এসে হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন জীবন শুরু করেন। যুক্ত হন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তাকে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল করা হয়। ২০০১ সালে শেখ হাসিনার সরকার তাকে হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেয়। ২০০৩ সালে রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ তাকে সালাম না দেওয়ায় তাৎক্ষণিক কান ধরে উঠবস করার আদেশ নিয়ে দেশব্যাপী বিতর্কের জন্ম দেন এই বিচারপতি।
আইনজীবীরা জানান, বিচারপতির আসনে বসে যখন যাকে খুশি আদালতে ডেকে অপমান-অপদস্থ করা তার একটি রোগে পরিণত হয়েছিল। ইকোনমি ক্লাসের টিকিট কেটে বিমানের বিজনেস ক্লাসে বসতে না পেরে বিমানের ভেতর তুলকালাম ঘটান। এত ঘটনার পরও শেখ হাসিনা ২১ জন সিনিয়রকে ডিঙিয়ে তাকে আপিল বিভাগের বিচারপতি পদে নিয়োগ দেন। তার বিরুদ্ধে সরকারি বাড়িতে থেকে ভাড়া না দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। পাশাপাশি লন্ডনে বাড়ি কিনেও বিতর্কের জন্ম দেন তিনি।
বিচারপতি মানিকের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, তিনি তো কোনো আইনজীবী কিংবা বিচারকের পর্যায়ের লোক নন। তিনি ছিলেন পতিত শেখ হাসিনার বিচার বিভাগীয় ক্যাডার। একজন বিচারকের যে গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন, তার মধ্যে কোনোটাই ছিল না। তিনি বরাবরই আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার লাঠিয়ালের ভূমিকা পালন করেন।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল আমার দেশকে বলেন, ‘শামসুদ্দিন মানিক মূলত শেখ হাসিনার জুডিশিয়াল কিলার বাহিনীর অন্যতম সদস্য ছিলেন। মুফতি আমিনীর মামলাসহ এমন অসংখ্য মামলার শুনানিতে অযথা জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়াকে নিয়ে কটূক্তি ও বিষোদ্গার করা তার একটি মানসিক রোগে পরিণত হয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘অবিচারকসুলভ এমন আচরণের জন্য দণ্ডবিধি ও ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী তার বিচার দাবি করছি। কারণ, মানিক ছিলেন একজন জুডিশিয়াল কিলার।’