
সাদিক কায়েম
জুলাই বিপ্লব- বিশেষ ইন্টারভিউ
প্রশ্ন ১: আপনার শৈশব, পারিবারিক পরিবেশ ও বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা কীভাবে আপনার রাজনৈতিক মতাদর্শ ও সংগ্রামী চেতনার ভিত গড়ে দিয়েছে? আপনি কীভাবে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির সাথে এত ওতপ্রোতভাবে জড়িত হলেন?
সাদিক কায়েম:আমার শৈশব কেটেছে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায়, এমন একটি এলাকায় যেখানে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতা জীবনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। আমার পরিবার, বিশেষ করে আমার মা, অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন। তিনি আমাদের ছোটবেলা থেকেই ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিকতার পাঠ দিয়েছেন। আমি বেশিরভাগ সময় নানার বাড়িতে কাটিয়েছি, যেখানে আমার মামারাও গভীর ধর্মীয় চেতনার অধিকারী ছিলেন। বিশেষ করে সাতকানিয়ার মাহফিলগুলো—ইসলামিক সংগীত, কিরাত, গজল, আজান প্রতিযোগিতা—আমার শৈশবকে রঙিন করেছে। যেমন সাঈদি হুজুরের মাহফিলে মানুষের ট্রাক নিয়ে আসার দৃশ্য আমার স্মৃতিতে গেঁথে আছে। এই ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক পরিবেশ আমার প্রাথমিক দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমার পরিবার কোনো স্ট্রাকচারাল সংগঠনের সাথে জড়িত ছিল না, তবে সাঈদি হুজুরের ওয়াজ আমাদের অঞ্চলে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
পরবর্তীতে, বাবার ব্যবসার সুবাদে আমরা খাগড়াছড়িতে চলে যাই। সেখানে আমি এসএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করি। পাহাড়ি পরিবেশ আমাকে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে শিখিয়েছে। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, রাখাইন, এবং বাঙালি সম্প্রদায়ের সাথে মিশে আমি বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের মূল্যবোধ আত্মস্থ করেছি। মাদ্রাসায় পড়াশোনার পাশাপাশি দুপুরে উপজাতি বন্ধুদের সাথে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলতাম, যা আমার মধ্যে সামাজিক সম্প্রীতির বোধ জাগিয়েছিল। এই অভিজ্ঞতাগুলো আমাকে জীবনের প্রতি একটি সহনশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে।
চট্টগ্রামে ফিরে আমি বাইতুশ শরফ মাদ্রাসায় ভর্তি হই। সে সময় ২০১৫-১৬ সালের দিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন, শাহবাগ ক্যাম্পেইনের সাথে জড়িত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, এবং হেফাজতের শাপলা চত্বর গণহত্যা আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। আমি প্রতিদিন মিছিলে অংশ নিতাম এবং নির্যাতনের শিকার বন্ধুদের অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছি—একজন বন্ধুর চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছিল। এই ঘটনাগুলো আমার মধ্যে অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দৃঢ় সংকল্প জাগিয়েছিল। আমরা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে অন্যায়ভাবে আটকদের মুক্ত করব এবং হাসিনার শাসন ভেঙে একটি স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ব। এই সময়েই মূলত আমার রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত হয়, এবং আমি সক্রিয়তার পথে এগিয়ে যাই।
পরবর্তীতে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছিলাম, এখানে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তির পর আমার প্রত্যাশা ছিল দেশশেরা শিক্ষক এবং উদ্ভাবনী পরিবেশের মুখোমুখি হওয়া। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। ভর্তি পরীক্ষার সময় বিজয় একাত্তর হলের গণরুমে ৪০০-৪৫০ জনের ভিড়ে থাকতে হয়েছিল। সূর্যসেন হলে ৫৬ জনের সাথে এক রুমে থাকা, অব্যবস্থাপনা, এবং জোরপূর্বক নানা ধরনের প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ আমাকে মানসিকভাবে দমিয়ে দিয়েছিল। হতাশায় আমি কিছুদিনের জন্য হল ছেড়ে আজিমপুরে চলে যাই। তবে, ফার্স্ট সেমিস্টারে ৩.৯৪ জিপিএ নিয়ে নিজের ডিপার্টমেন্টে প্রথম হয়ে আমি আবারো হলে ফিরে আসি। এক পর্যায়ে ক্যাম্পাসে এবং হলে মেধাবী ছাত্রদের ইচ্ছাকৃত প্রান্তিককরণ এবং অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে আমার মধ্যে ক্ষোভ জমতে থাকে। এই ক্ষোভ আমাকে সমমনা সহপাঠীদের সাথে সংযুক্ত হতে এবং প্রতিবাদের সংস্কৃতি গড়তে প্রেরণা দেয়। আমরা গ্রুপে কাজ করতাম, পরিকল্পনা করতাম, এবং জুনিয়রদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার চেষ্টা করতাম।
বিশেষ করে, আবরার ফাহাদের শাহাদাত আমার জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট ছিল। এছাড়া নিরাপদ সড়ক এবং কোটা সংস্কার আন্দোলনে আমি সামনে থেকে অংশ নিয়েছি। এই আন্দোলনগুলো ক্যাম্পাসে প্রতিবাদের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সহায়ক হয়েছে। আমার শৈশবের ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা, খাগড়াছড়ির বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা, এবং চট্টগ্রামের রাজনৈতিক জাগরণ আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে প্রস্তুত করেছিল। এই যাত্রা আমাকে অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পথে অটল রাখে, যা পরবর্তীতে ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে আমার ভূমিকাকে গঠন করে।
প্রশ্ন ২: আপনারা যখন ভার্সিটিতে ছিলেন, আপনি বলেছেন যে সব ক্যাম্পাস ছাত্রলীগ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল এবং তারা এক ধরনের ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায়, যেটা বাংলাদেশের রাজনীতির এপিসেন্টার, আপনি ক্যাম্পাসে সুস্থ রাজনীতি চর্চা চালিয়ে যাওয়ার এবং প্রশাসনিক দমন এড়িয়ে সংগঠনকে কীভাবে টিকিয়ে রেখেছেন এবং এই কাজগুলো কতটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল?
সাদিক কায়েম: নিঃসন্দেহে এটা তো জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে খেলার মতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সময়ে ক্যাম্পাস ছিল ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে, যারা একটি ভয়াবহ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। এই পরিবেশে কাজ করা ছিল জীবন-মৃত্যুর সাথে খেলার মতো। শিবিরের সাথে সামান্যতম সন্দেহ হলেও কাউকে মারধর করা, এমনকি হত্যা করাও স্বাভাবিক ছিল। আবরার ফাহাদের শাহাদাতের আগে এটি এতটাই স্বাভাবিক ছিল যে, কাউকে শিবির সন্দেহে মারলে সবাই তা উৎসবের মতো উদযাপন করত, বাহবা দিত। এই অমানবিকতা, এই ডিহিউম্যানাইজেশন, যেখানে শিবিরের সাথে জড়িত বলে সন্দেহ হলে একজন মানুষের কোনো অধিকার থাকত না, তা আমাদের কাজকে অসম্ভব ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছিল। আবরারের শাহাদাতের পর জনমনে একটি পরিবর্তন আসে—শুধু সন্দেহে কাউকে মারা অগ্রহণযোগ্য হয়। কিন্তু শিবিরের নেতা বা কর্মী হলে তাকে মারার বৈধতা থেকেই যেত, এবং এই নৃশংসতা সেলিব্রেট করা হতো। এমন পরিস্থিতিতে আমরা এক মুহূর্তের জন্যও আমাদের কাজ বন্ধ করিনি।
ক্যাম্পাসে পাবলিক পরিসরে আমাদের জন্য কোনো সুযোগ ছিল না। শিবিরের উপর এই ডিহিউম্যানাইজেশন বাংলাদেশের অন্য কোনো সংগঠনের উপর এভাবে প্রয়োগ হয়নি। তাই আমরা বাধ্য হয়ে গোপনে, কৌশলগতভাবে কাজ করতাম। আমরা আমাদের ব্যক্তিগত উৎকর্ষতা এবং নিষ্ঠার মাধ্যমে ছাত্রদের কাছে পৌঁছাতাম। আমাদের লক্ষ্য ছিল সবার সাথে এমন গভীর সম্পর্ক গড়া যাতে তারা আমাদের উপর ভরসা করে। কোনো ছাত্র যদি ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা একাডেমিক সমস্যায় পড়ত, আমরা সবার আগে তার পাশে দাঁড়াতাম। কেউ নির্যাতন, জুলুম বা বৈষম্যের শিকার হলে আমরা তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করতাম। আমরা তাদের উদ্ধার করতাম, ঘটনাগুলো ডকুমেন্ট করতাম, নিউজ করে ছড়িয়ে দিতাম। যারা হামলা করেছে, তাদের চিহ্নিত করে তথ্য সংগ্রহ করতাম এবং সেগুলো সার্কুলেট করতাম, যাতে দোষীদের মুখোশ উন্মোচিত হয়। আমরা চেষ্টা করতাম যেন ভবিষ্যতে এমন ঘটনা রোধে এক্সামপ্লারি শাস্তির ব্যবস্থা হয়।
আমাদের সংগঠনের নামে প্রকাশ্যে কাজ করার পরিবেশ না থাকায় আমরা ক্যাম্পাসের স্বাধীন অ্যাকটিভিস্ট ও সাংবাদিকদের সাথে সহযোগিতা করতাম। তাদের সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে আমরা একসাথে কাজ করতাম। এই প্রক্রিয়ায় আমাদের অসংখ্য ভাই নির্যাতনের শিকার হয়েছে। প্রায় ৩,০০০-এর বেশি সদস্যকে হল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, মারধর করা হয়েছে, নির্মম নির্যাতন করা হয়েছে। আমার এক ভাই, মহসিন, শিবির সদস্য হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পর তাকে চারতলা থেকে ফেলে দেওয়া হয়। তাকে প্রথমে ইচ্ছামতো মারধর করা হয়, তার পা রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়। হামাগুড়ি দিয়ে সে একটি গাড়ির নিচে আশ্রয় নেয়, কিন্তু সেখান থেকে তাকে টেনে বের করে আবার মারা হয়। পানির জন্য বললে তাকে প্রস্রাব দেওয়া হয়, এবং শেষে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এমন নৃশংসতার অসংখ্য উদাহরণ আছে। ২০০৯-১০ সালের দিকে মহসিন হল থেকে একসাথে ৭০-৮০ জনকে বের করে দেওয়া হয়। অনেকের ল্যাপটপ, টাকা-পয়সা, ব্যক্তিগত জিনিসপত্র চুরি করা হয়। মেধাবী ছাত্ররা, যারা ডিপার্টমেন্টে প্রথম হয়েছে, শিবিরের সাথে জড়িত সন্দেহে তাদের একাডেমিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। কেউ ক্লাস বা পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি।
এই দমন ও নির্যাতনের মধ্যেও আমরা আমাদের কাজ অব্যাহত রেখেছি। প্রতিটি বৈধ ছাত্র আন্দোলনে আমরা সামনে থেকে বা পেছন থেকে সহায়তা করেছি। আমরা সবসময় ছাত্রদের পাশে ছিলাম, তাদের অধিকারের জন্য লড়েছি। আল্লাহর রহমতে, আমরা অটল ছিলাম। আমরা প্রস্তুত ছিলাম যে সত্যের জন্য, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য জীবন দিতে হলে দিয়ে দেব। ফ্যাসিবাদ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই কখনো থামেনি, এবং আমরা প্রতিনিয়ত এই সংগ্রাম চালিয়ে গেছি।
প্রশ্ন ৩: এমন পরিস্থিতিতে যখন ক্যাম্পাসে কোটা আন্দোলনটা আস্তে আস্তে শুরু হতে থাকলো ২০১৮ সালে, এবং এটাও তখন ইনিশিয়ালি আন্দোলনটার যখন সূচনা হচ্ছিল, তখন আপনাদের উদ্দেশ্যটা কী ছিল—যে এটা শুধু কোটার মধ্যে সীমিত রাখা, নাকি আন্দোলনটাকে আরেকটা ব্রডার পারস্পেক্টিভে নিয়ে যাওয়া? এবং আপনারা কী পরিবর্তনটা আনতে চেয়েছিলেন?
সাদিক কায়েম: ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিল, কিন্তু এটি শুরুতে প্রধানত কোটাকেন্দ্রিক ছিল। ক্যাম্পাসে তখন ছাত্রলীগের দ্বারা সৃষ্ট দমন-পীড়ন এবং অমানবিক পরিবেশের কারণে শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে কথা বলা কঠিন ছিল। আমরা, বিশেষ করে শিবিরের নেতা-কর্মীরা, এই আন্দোলনে সামনে-পিছনে, লজিস্টিক সাপোর্ট থেকে শুরু করে নীতি নির্ধারণ পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে সমন্বয় করেছি। আমি নিজেও পুরো আন্দোলনের মাঠে ছিলাম। তখনকার প্রেক্ষাপটে আমাদের উদ্দেশ্য প্রাথমিকভাবে কোটার বৈষম্যের বিরুদ্ধে সরব হওয়া ছিল, কারণ এটি শিক্ষার্থীদের অধিকারের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত তাছাড়াও সরকার পতনের মতো বৃহৎ লক্ষ্যে যাওয়া কঠিন ছিল, কারণ সবাইকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে একত্রিত করা সম্ভব ছিল না। তাই আমাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল কোটা ব্যবস্থার অবিচার দূর করা এবং শিক্ষার্থীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।
তবে, আমাদের দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এই আন্দোলনকে ধাপে ধাপে ব্রডার পারস্পেক্টিভে নিয়ে যাওয়া। আমরা জানতাম, ক্যাম্পাসে যে দমন-পীড়ন, ট্যাগিং, এবং অমানবিকতা চলছে, তা শুধু কোটার সমস্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি ছিল ফ্যাসিবাদী শাসনের একটি প্রকাশ। আমরা চেয়েছিলাম, এই আন্দোলনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে, যাতে তারা কেবল কোটার বিরুদ্ধে নয়, সামগ্রিক অবিচার ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে। আমাদের পরিকল্পনা ছিল স্টেজ-বাই-স্টেজ এগোনো, যাতে আন্দোলন ব্যাকফায়ার না করে। আমরা প্রথমে শিক্ষার্থীদের অধিকারের ইস্যুতে ঐক্য গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম, যা পরে বৃহত্তর ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের ভিত্তি হবে। আমরা পরিবর্তন চেয়েছিলাম একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজের, যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের অধিকার পাবে, এবং ক্যাম্পাসে দমন-পীড়নের সংস্কৃতি শেষ হবে। এই আন্দোলন ছিল আমাদের জন্য একটি পথ তৈরির প্রক্রিয়া, যা পরবর্তীতে বড় আন্দোলনের দিকে নিয়ে যাবে।
প্রশ্ন ৪: ২০১৮-এর কোটা আন্দোলন থেকে ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত কীভাবে আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি বদলালো? এই সময়ে কী কী ঘটনা জনগণের চাপা ক্ষোভকে উসকে দিল?
সাদিক কায়েম: ২০১৮-এর কোটা আন্দোলন থেকে ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত আমরা একটি দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছি। ২০১৮-এর আন্দোলন ছিল প্রধানত শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক এবং কোটার অবিচারের বিরুদ্ধে। কিন্তু এটি আমাদের জন্য একটি শিক্ষা ছিল যে, শুধু একটি ইস্যু নিয়ে আন্দোলন করে ফ্যাসিবাদী শাসনের মূল কাঠামো ভাঙা সম্ভব নয়। ২০১৮ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনা জনগণের মধ্যে চাপা ক্ষোভকে জাগিয়ে তুলেছে, যা শেষ পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানের রূপ নেয়।
২০২৩ সালে আমরা বেশ কয়েকটি আন্দোলন করেছি, যা জনগণের ক্ষোভকে আরও তীব্র করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘প্রোডাক্টিভ রামাদান’ নামে একটি অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহায়তায়, রোজাদারদের উপর হামলা করে। রক্তাক্ত ছাত্রদের ছবি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে, যা মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে তীব্র ক্ষোভ জাগায়। এছাড়া, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইফতার নিষিদ্ধ করার ঘটনা একটি ৯০% মুসলিম জনগোষ্ঠীর দেশে অভাবনীয় দুঃসাহস ছিল। এই ঘটনাগুলো জনগণের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের উপর আঘাত হানে।
এরপর মোদী বিরোধী আন্দোলনের সময় বায়তুল মোকাররমে নির্মমভাবে মানুষের উপর হামলা করা হয়। ট্রান্সজেন্ডার ইস্যু নিয়েও শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন আন্দোলন করে, কারণ আওয়ামী লীগের আমদানি করা পশ্চিমা সংস্কৃতি আমাদের সমাজের কাঠামো ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির ‘ডামি নির্বাচন’ এই ক্ষোভকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এমনকি আওয়ামী লীগের নিজস্ব সমর্থকরাও ভোট দিতে যায়নি। ২০২৩-এর ২৮ অক্টোবর পল্টনে বিএনপি ও মতিঝিলে জামায়াতের সমাবেশে ন্যাক্কারজনক হামলা এবং পরবর্তী গণগ্রেপ্তার জনগণের ক্ষোভকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যায়।
এই সময়ে সর্বস্তরের মানুষ—কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতা—হাসিনার শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। শুধুমাত্র কিছু সরকারি আমলা এবং বামপন্থী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হাসিনা তার শাসন টিকিয়ে রেখেছিল। এমনকি প্রবাসী রেমিট্যান্স প্রেরণকারীরাও তাদের প্রাপ্য সম্মান ও অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। এই সকল ঘটনা মিলে জনগণের মধ্যে একটি চাপা ক্ষোভ তৈরি হয়, যা ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের জ্বালানি হয়ে ওঠে। আমরা এই ক্ষোভকে সংগঠিত করার চেষ্টা করেছি, এবং ফিলিস্তিন ইস্যুতে আন্দোলনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নতুন করে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছি।
প্রশ্ন ৫: ২০২৩-২৪ সালে আপনারা কীভাবে গণঅভ্যুত্থানের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন? ক্যাম্পাস ও জনগণকে একত্রিত করতে কী কী কৌশল ব্যবহার করেছেন?
সাদিক কায়েম: ২০২৩-২৪ সালে আমরা একটি গণঅভ্যুত্থানের স্বপ্ন দেখেছিলাম, যার কেন্দ্র হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা বিশ্বাস করতাম, হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের পতনের জন্য একটি গণবিপ্লব প্রয়োজন, যেখানে সর্বস্তরের মানুষ—ছাত্র, শিক্ষক, রিকশাচালক, বাসচালক, কৃষক, শ্রমিক—একত্রিত হবে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল শাহবাগে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করা, যেখানে একজন রিকশাচালকের ডাকে সবাই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। আমরা স্বপ্ন দেখতাম, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা—সবাই একত্রে হাসিনার মসনদ ভেঙে তছনছ করে দেবে।
এই লক্ষ্যে আমরা বেশ কিছু কৌশল অবলম্বন করেছি। প্রথমত, আমরা ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতাম এবং ছাত্রদল, শিবির, এবং অন্যান্য গ্রুপের সঙ্গে আলোচনা করতাম। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, হাসিনার পতনের জন্য একটি বৃহৎ গণঅভ্যুত্থান দরকার, যেখানে সবাইকে এনগেজ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, আমরা সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গড়ার চেষ্টা করেছি। আমি নিজে শিবিরের পক্ষ থেকে বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, কিন্তু দুঃখজনকভাবে, বিএনপি এবং অন্যান্য দল ভারত বা পশ্চিমা দূতাবাসের প্রেসক্রিপশনের উপর নির্ভর করছিল। তারা ক্ষমতায় আসতে চেয়েছিল, কিন্তু জনগণের মুক্তির জন্য সত্যিকারের ঐক্য গড়তে পারেনি। ২০২৩ সালে বামপন্থীদের নিয়ে একটি ছাত্র ঐক্য গঠিত হয়, কিন্তু তা সফল হয়নি। ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে একটি প্রোগ্রামে মাত্র ২০০-২৫০ জন উপস্থিত ছিল, যা প্রমাণ করে তাদের আন্দোলন জনগণের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
তৃতীয়ত, আমরা জনগণের ক্ষোভকে সংগঠিত করার জন্য বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন করেছি। ফিলিস্তিন ইস্যুতে আমরা শিক্ষার্থীদের নতুন করে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছি। আমরা জানতাম, হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের সব ছিদ্র বন্ধ করার চেষ্টা সত্ত্বেও, একটি ছিদ্র থেকে যাবে, এবং সেখান দিয়ে তার পতন হবে। আমরা আমাদের সীমিত সম্পদের মধ্যে থেকে আন্দোলন চালিয়ে গেছি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, ফ্যাসিবাদ টিকে থাকতে পারে না। ২০২৪-এর নির্বাচনের পর, যখন সবাই হতাশ হয়ে পড়েছিল, আমরা আশাবাদী ছিলাম। আমরা বিশ্বাস করতাম, পরিবর্তন আসবেই, এবং আমাদের কৌশলগত প্রস্তুতি এবং ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক সংগঠন সেই পরিবর্তনের পথ প্রশস্ত করেছে।
প্রশ্ন ৫: কোটা আন্দোলন কীভাবে শুরু হয়েছিল? শিক্ষার্থীদের মধ্যে এটি কীভাবে ছড়িয়ে পড়ে, এবং আপনারা কীভাবে এটিকে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে রূপান্তরিত করেছেন?
সাদিক কায়েম: ২০২৪ সালের কোটা আন্দোলনের সূচনা ছিল সম্পূর্ণ অরগানিক এবং শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে। ৫ই জুন, যখন সরকার কোটা পুনর্বহালের ঘোষণা দেয়, তখন ক্যাম্পাসে একটি ক্ষোভের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে। এই কোটা পুনর্বহালের ফলে মেধাবী শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কায় ছিল, যা তাদের জন্য একটি সরাসরি স্বার্থের বিষয় ছিল। ওই দিনই আমাকে নাহিদ, মাহফুজ, আসিফ, এবং আব্দুল কাদের ফোন করে জিজ্ঞেস করে, “ভাই, কী করা যায়?” আমি তাদের বললাম, “তোমরা এগিয়ে যাও, আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি। একসঙ্গে কাজ করব।” এই কথার পর থেকে আন্দোলন শুরু হয়, এবং শিক্ষার্থীরা অর্গানিকভাবে এতে যুক্ত হতে থাকে।
আমাদের ক্যাম্পাসে সবসময় একটি নেটওয়ার্ক ছিল। যখনই কোনো স্বাধীন অ্যাকটিভিস্ট কিছু করার পরিকল্পনা করতেন, তারা প্রথমে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। এই আন্দোলনের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ ছিল খাঁটি, কারণ কোটা তাদের ভবিষ্যতের সঙ্গে জড়িত। আমরা প্রথম থেকেই জানতাম, এই আন্দোলনকে শুধু কোটার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে এটি দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব ফেলবে না। আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে একটি গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করা, যা ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে যাবে। তবে আমরা শিক্ষার্থীদের প্রথম থেকে রাজনৈতিকভাবে অতিরিক্ত সচেতন করতে চাইনি, কারণ তাতে আন্দোলন বিভক্ত হয়ে যেতে পারত। আমরা প্রথমে তাদের অর্গানিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছি। ধীরে ধীরে, আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি পরিবর্তন করে আমরা এটিকে ফ্যাসিবাদ বিরোধী একটি বৃহত্তর আন্দোলনে রূপান্তরিত করেছি। প্রতিদিন রাতে আমরা বসে পরবর্তী দিনের কর্মসূচি ঠিক করতাম, এবং এভাবে আন্দোলনটি কৌশলগতভাবে এগিয়ে যায়।
প্রশ্ন ৬: ২০২৪ সালের কোটা আন্দোলনের নেতৃত্ব এবং সমন্বয় কীভাবে গঠন করা হয়েছিল? আপনারা কীভাবে লজিস্টিক এবং নীতি নির্ধারণের দায়িত্ব পরিচালনা করেছেন?
সাদিক কায়েম:
২০২৪ সালের কোটা আন্দোলনের নেতৃত্ব ছিল একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা, যেখানে শিবিরের পাশাপাশি স্বাধীন অ্যাকটিভিস্ট এবং ছাত্রশক্তির মতো প্ল্যাটফর্ম কাজ করেছে। আমরা শুরু থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে আন্দোলনটি কোনো ঐতিহ্যবাহী কমিটি বা পদ-পদবির মাধ্যমে চলবে না, কারণ তাতে বিভেদ সৃষ্টি হতে পারত। ৩ জুলাইয়ের দিকে মাহফুজের সঙ্গে আমার দীর্ঘ আলোচনা হয়। তখন প্রস্তাব আসে যে সভাপতি-সেক্রেটারি বা আহ্বায়ক-সহসভাপতির মতো পদ থাকবে কিনা। আমি এর তীব্র বিরোধিতা করি। আমি বলেছিলাম, এই ধরনের পদবি দিলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হবে। কে কার কথা শুনবে? হাসনাত কেন নাহিদের কথা মানবে, বা সারজিস কেন অন্য কারও নির্দেশ মেনে নেবে? তাই আমরা একটি নতুন পদ্ধতি বেছে নিলাম—সবাইকে “সমন্বয়ক” হিসেবে ঘোষণা করা হলো। এই “সমন্বয়ক” পদটি সবাইকে সমান মর্যাদা দিয়েছে এবং সবাই নিজেদের মালিকানা অনুভব করেছে।
লজিস্টিক এবং নীতি নির্ধারণের দায়িত্ব আমরা বিভক্ত করে নিয়েছিলাম। আমি প্রধানত মাহফুজের সঙ্গে নীতি নির্ধারণের আলোচনা করতাম। মাহফুজ ছিলেন নাহিদ, আসিফদের তাত্ত্বিক গুরু, এবং আমরা একসঙ্গে কৌশল ঠিক করতাম। মাঠ পর্যায়ে সমন্বয়ের জন্য ফরহাদ ভাই, যিনি তখন বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সেক্রেটারি ছিলেন, তিনি দায়িত্ব পালন করতেন। জাহিদুল হক, আমাদের ছাত্র অধিকার সম্পাদক, মাঠের লজিস্টিক—মাইক, ব্যানার, স্যালাইন, পানি, ম্যানপাওয়ার—সবকিছু পরিচালনা করতেন। আমরা কারওয়ান বাজার থেকে ভ্যান ভাড়া করে প্রয়োজনীয় সামগ্রী আনতাম। প্রতিদিন বিশাল খরচ হতো, কিন্তু সবকিছু আমরাই সরবরাহ করতাম। আমাদের একটি পূর্ণাঙ্গ টিম ছিল, যারা দিন-রাত কাজ করত। নাহিদ, আসিফ, মাহফুজ, সারজিস, হাসনাত—এরা সবাই আন্দোলনের মুখ হিসেবে কাজ করতেন। কেউ কেউ ছাত্রশক্তি বা ছাত্র অধিকারের মাধ্যমে আগে থেকেই জড়িত ছিলেন, আবার কেউ অর্গানিকভাবে এসেছিলেন। যেমন সারজিস ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকলেও আমাদের এই আন্দোলনের সাথে অর্গানিকভাবে জড়িয়ে পড়েছিল, তাছাড়াও হাসনাত কোন ধরনের রাজনীতির সাথে যুক্ত না থাকলেও ক্যাম্পাসে নানা বিষয়ে সরব ছিল যার ফলে আমাদের আন্দোলনে সে-ও অর্গানিকভাবে জড়িয়ে যায়। আমাদের পূর্বের বোঝাপড়া এবং ইশারা-ইঙ্গিতের ভাষা তাদের সঙ্গে কাজ করতে সহায়ক ছিল। এই সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা আন্দোলনটিকে সংগঠিত এবং কার্যকর রাখতে পেরেছি।
প্রশ্ন ৭: আন্দোলনকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য আপনারা কী কৌশল অবলম্বন করেছিলেন? কীভাবে অন্য ক্যাম্পাস এবং জনগণকে এতে সম্পৃক্ত করেছেন?
সাদিক কায়েম:
আমরা শুরু থেকেই বুঝেছিলাম যে কোটা আন্দোলনকে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমাবদ্ধ রাখলে এটি বৃহত্তর প্রভাব ফেলবে না। তাই আমাদের কৌশল ছিল সারা দেশের ক্যাম্পাস এবং জনগণকে এতে সম্পৃক্ত করা। প্রথমে আন্দোলনটি ঢাকা-কেন্দ্রিক ছিল, কিন্তু আমরা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে এতে যুক্ত করতে হবে। আমি কেন্দ্রীয় শিবিরের সঙ্গে মিটিং করেছি, এবং সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বশীলদের সঙ্গে সমন্বয় করেছি। ৩ জুলাইয়ের একটি মিটিংয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে এই আন্দোলনকে সর্বশক্তি দিয়ে সমর্থন দিতে হবে। আমি বলেছিলাম, “এই আন্দোলন আমাদের একটি বিশাল সুযোগ দিয়েছে। যদি আমরা এটিকে সর্বোচ্চ সমর্থন দিতে পারি, তাহলে কোটা সংস্কারের পাশাপাশি হাসিনার পতনের দিকে এগিয়ে যেতে পারব।”
আমরা সারা দেশের ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের সংযুক্ত করার জন্য নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করেছি। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের টিম ছিল, যারা স্থানীয়ভাবে আন্দোলনের প্রচার ও সংগঠনের কাজ করত। আমরা কর্মসূচিগুলো সার্বজনীন করার জন্য নতুন কৌশল নিয়েছিলাম। উদাহরণস্বরূপ, আমরা “বাংলা ব্লকেড” নামে একটি কর্মসূচি চালু করি। এটি ঐতিহ্যবাহী অবরোধের মতো ছিল, কিন্তু আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে “অবরোধ” শব্দটি এড়িয়ে “ব্লকেড” ব্যবহার করেছি। কারণ দীর্ঘদিনের হরতাল-অবরোধের পর মানুষ এই শব্দগুলো শুনে হাসাহাসি করত। “বাংলা ব্লকেড” নামটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা তৈরি করে, এবং ৭-৯ জুলাইয়ের মধ্যে এই কর্মসূচি সারা দেশে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছড়িয়ে পড়ে। শাহবাগ থেকে শুরু করে কাঁটাবন, এমনকি ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিয়েছে। এই কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা শুধু শিক্ষার্থীদের নয়, সাধারণ জনগণকেও আন্দোলনের সঙ্গে সংযুক্ত করতে পেরেছি।
প্রশ্ন ৮: আন্দোলনের সময় সরকার এবং হাইকোর্টের প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে আপনারা কীভাবে কৌশল গ্রহণ করেছিলেন? কীভাবে আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন?
সাদিক কায়েম:
২০২৪ সালের কোটা আন্দোলনের সময় সরকারের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল সম্পূর্ণ উপেক্ষা। আমাদের বড় বড় শোডাউন সত্ত্বেও মন্ত্রী বা দায়িত্বশীল কেউ কোনো মন্তব্য করেনি। এই নীরবতা আমাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ ছিল, কারণ এটি প্রমাণ করছিল যে তারা আমাদের আন্দোলনকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। আমরা তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে কর্মসূচিগুলোকে আরও সার্বজনীন করতে হবে। এই সময়ে হাইকোর্টের মাধ্যমে সরকার একটি কৌশল নেয়। তারা আন্দোলনকে শান্ত করার জন্য কোটা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত এক মাসের জন্য “ফ্রিজ” করার ঘোষণা দেয়। আমরা এটি পরিষ্কারভাবে বুঝেছিলাম যে এটি একটি কৌশল, যার মাধ্যমে তারা আন্দোলনকে ঠাণ্ডা করে আবার পরে কোটা পুনর্বহাল করবে।
৯ জুলাই রাতে আমরা এই বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছি। আমি, মাহফুজ, এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতির সভাপতি আল সাদিক ভুইয়া ভিসির বাসায় মিটিং করেছি। সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব ছিল যে দুজনের এনআইডি কার্ড দিয়ে হাইকোর্টে একটি রিট করা হবে, যার মাধ্যমে কোটা বাতিল করা হবে। আমরা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছি। আমরা বলেছি, আমরা হাইকোর্টের রায়ের জন্য আন্দোলন করছি না। আমাদের দাবি ছিল নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে কোটা বাতিল করা। হাইকোর্টের রায় দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি করবে এবং সাময়িকভাবে আন্দোলনকে দুর্বল করে দেবে। তিন-চার ঘণ্টার দফায় দফায় মিটিংয়ে আমরা এই অবস্থানে অটল ছিলাম।
সরকার এবং এজেন্সির পক্ষ থেকে হুমকি আসতে থাকে। তারা বলেছিল, “তোমরা যদি ব্লকেড তুলে না নাও, তাহলে গুলি চালানো হবে।” আমরা স্পষ্টভাবে বলেছি, আমরা হাইকোর্টের রায় মানব না। পরবর্তী দিনের জন্য আমরা নতুন কর্মসূচি ঠিক করেছি। ফরহাদ ভাই প্রস্তাব দেন যে রাষ্ট্রপতি এবং সারা দেশের ডিসি’দের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হবে। আমাদের সমন্বয়ক মুসাদ্দেক আলী নূর মোহাম্মদ এই স্মারকলিপি লেখেন, এবং ফরহাদ ভাই এটি চূড়ান্ত করেন। রাষ্ট্রপতির কাছে একটি টিম পাঠানো হয়, এবং সারা দেশের জেলা সভাপতিদের মাধ্যমে ডিসি’দের কাছে স্মারকলিপি পৌঁছানো হয়। এই কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছি এবং সরকারের উপেক্ষার বিরুদ্ধে জনগণের সমর্থন আরও বাড়িয়েছি।
প্রশ্ন ৯: জুলাই আন্দোলনের আইকনিক স্লোগান “তুমি কে আমি কে” যা আন্দোলনের পরবর্তী গতিপথ বদলে দিয়েছিল, এর সূচনা কীভাবে হয়েছিল? এবং এর পরদিনই ছাত্রলীগের ন্যাক্কারজনক হামলা সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপরে সারা বাংলাদেশে শোরগোল ফেলে দিয়েছিল—এর পটভূমি কী ছিল?
সাদিক কায়েম:
১২ জুলাই, ২০২৪ পর্যন্ত সরকার আমাদের আন্দোলনকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করছিল। শেখ হাসিনা তখন দেশের বাইরে ছিলেন, এবং দায়িত্বশীল কোনো পর্যায় থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া আসছিল না। আমরা আশা করছিলাম যে সরকারের কেউ একটা ভুল মন্তব্য করুক, যেমন ২০১৮ সালে মতিয়া চৌধুরী আন্দোলনকারীদের “রাজাকার” বলে ট্যাগ করেছিলেন। এমন একটি মন্তব্য আন্দোলনকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যেতে পারত। আমি এবং জুনায়েদ ভাই এই ধরনের একটি মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমরা চাইছিলাম সরকার এটাকে ট্যাগ করুক, ব্যাশিং করুক, কারণ তাতে আন্দোলনটি তাদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে উঠত।
ঠিক তখনই একজন সাংবাদিক শেখ হাসিনাকে প্রশ্ন করেন, এবং তিনি বলেন, “আমি কি রাজাকারের নাতি-পুতিদের কোটা দিব নাকি?” এই মন্তব্যটি ছিল আমাদের জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট। আমরা এই মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সাথে সাথে ফরহাদ ভাই নাহিদকে ফোন দিয়ে বলেন, “আজ মিছিল করবেন। এটি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে নয়, সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে হবে। স্লোগান হবে—‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার রাজাকার’।” এই স্লোগানটি হাসিনার মন্তব্যের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া ছিল। মিছিল শুরু হয় সূর্যসেন হল থেকে, শিক্ষার্থীরা অর্গানিকভাবে যোগ দেয়। একের পর এক হল থেকে শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে আসে। এই স্লোগানের মাধ্যমে একটি বিশাল গণজাগরণ সৃষ্টি হয়। সেই রাতটি জুলাই আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাত ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণবিস্ফোরণ ঘটে, যা হাসিনার শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। গত ১৬ বছর ধরে “রাজাকার” ট্যাগিং দিয়ে শিক্ষার্থীদের দমন করা হয়েছিল। এই স্লোগান তাদের সেই বঞ্চনার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ ছিল।
পরদিন, ১৫ জুলাই, আমরা হাসিনার মন্তব্যের প্রতিবাদে দুপুর ১২টায় রাজু ভাস্কর্যে একটি কর্মসূচির ঘোষণা করি। কিন্তু সকাল থেকেই ছাত্রলীগ বহিরাগত সন্ত্রাসীদের নিয়ে ক্যাম্পাসে অবস্থান নেয়। আমি খবর পাই যে তারা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাতে মিছিল এবং ফুটবল খেলা দেখার কারণে অনেক শিক্ষার্থী ক্লান্ত ছিল, ফলে দুপুরের কর্মসূচিতে উপস্থিতি কম ছিল। ছাত্রলীগ এই সুযোগে হামলা চালায়। শহীদুল্লাহ হল, জিয়া হল, মুজিব হল—বিভিন্ন হলে শিক্ষার্থীদের ডাকতে গেলে ছাত্রলীগ হামলা করে। মধুর ক্যান্টিনে তারা অবস্থান নিয়ে নৃশংসভাবে শিক্ষার্থীদের উপর আক্রমণ করে। অনেকে, বিশেষ করে আমাদের বোনেরা, রক্তাক্ত হয়। সমন্বয়করা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আমরা ইট-পাটকেল দিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করি, কিন্তু তাদের হামলার তীব্রতা ছিল অভূতপূর্ব। এই হামলা সারা দেশে শোরগোল ফেলে দেয়, কারণ এটি সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগের নৃশংসতাকে প্রকাশ করে।
প্রশ্ন ১০: ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের হামলার পর যখন শিক্ষার্থীদের মনোবল ভেঙে গিয়েছিল, তখন আন্দোলনকে পুনরায় সংগঠিত করা কতটা কঠিন ছিল?
সাদিক কায়েম:
১৫ জুলাইয়ের হামলা আমাদের জন্য একটি বিশাল ধাক্কা ছিল। শিক্ষার্থীরা, বিশেষ করে মেয়েরা, মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিল। অনেকের মনোবল ভেঙে গিয়েছিল, এবং সমন্বয়কদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়েছিল। আমি আসিফের সাথে কথা বলি এবং বলি, “যদি এখন প্রতিরোধ গড়ে না তুলি, তাহলে শিক্ষার্থীরা ভয় পেয়ে যাবে। আমরা আর ফিরে আসতে পারব না।” আমরা দুটি পদক্ষেপ নিয়েছিলাম: প্রথমত, আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। আমি হাসপাতালে গিয়ে আহতদের সরিয়ে নিয়েছি, কিন্তু সেখানেও ছাত্রলীগ হামলা করে। আমি গুরুতর আহতদের বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করি। দ্বিতীয়ত, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে মাগরিবের পর একটি প্রতিবাদ মিছিল বের করব। আমি কেন্দ্রের সাথে মিটিং করে বলি, “যত লোক লাগে, আমি ব্যবস্থা করব। লাঠি-সোটা নিয়ে প্রতিরোধ গড়ব।”
আমরা শহীদুল্লাহ হল, একুশে হল, এবং এস এইচ হলকে কেন্দ্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম। এই তিনটি হল ইতিমধ্যে ছাত্রলীগমুক্ত হয়েছিল, কারণ “তুমি কে আমি কে” স্লোগানের রাতে শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগকে বের করে দিয়েছিল। আমার পরিকল্পনা ছিল ১০০০ লোক নিয়ে ক্যাম্পাসে প্রতিরোধ গড়া। আমরা অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে লাঠি-সোটা ক্যাম্পাসে ঢোকাই। কিন্তু সন্ধ্যায় শহীদুল্লাহ হলের শিক্ষার্থীদের একসঙ্গে বের করতে পারিনি। সমন্বয়করা, বিশেষ করে নাহিদ এবং আসিফ, রাজি ছিল না। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম পরের দিন, ১৬ জুলাই, শাহবাগে একটি বড় সমাবেশ করব। কিন্তু মেয়ে সমন্বয়করা বললেন, “১৫ জুলাইয়ের হামলার সময় তোমরা পালিয়েছিলে। আমরা আর কর্মসূচিতে আসব না।” তারা সমন্বয়কদের উপর ক্ষুব্ধ ছিল। আমি বারবার বোঝানোর চেষ্টা করি, “এটি আমাদের অস্তিত্বের লড়াই। যদি আজ কর্মসূচি না দিই, ছাত্রলীগ আর হাসিনা মনে করবে আমরা ভয় পেয়ে গেছি।” শেষ পর্যন্ত আমি শহীদ মিনারে কর্মসূচির প্রস্তাব দিই। অনেক আলোচনার পর তারা রাজি হয়।
১৬ জুলাই সকালে আমরা সাবেক সভাপতিদের নিয়ে মিটিং করি এবং কাজ ভাগ করে নিই। আমি কো-অর্ডিনেশনের দায়িত্ব নিই। শহীদ মিনারে দুপুর ১২টা থেকে শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে থাকে। আমরা কৌশলগতভাবে সায়েন্স ল্যাব, ধানমন্ডি, এবং চানখারপুলে লোক মোতায়েন করি, যাতে পুলিশ এবং ছাত্রলীগের মনোযোগ বিভক্ত হয়। প্রতিটি হলে ক্যাম্পেইন করে শিক্ষার্থীদের বের করি। দুপুর ১টার মধ্যে শহীদ মিনারে বিশাল লোকারণ্য তৈরি হয়। সবার হাতে লাঠি ছিল, এবং আগের দিনের হামলার রাগ-ক্ষোভ তাদের মধ্যে জ্বলছিল। আমরা ১৫ জুলাইয়ের হামলাকারীদের তথ্য সংগ্রহ করে পোস্টার ছড়িয়ে দিয়েছিলাম, যা আন্দোলনকে আরও গতি দেয়। এই সমাবেশের মাধ্যমে আমরা মনোবল ফিরিয়ে আনি এবং আন্দোলনকে পুনরায় সংগঠিত করি।
প্রশ্ন ১২: জুলাইয়ে ছাত্ররা কফিন নিয়ে গায়েবি জানাজার কর্মসূচি করেছিল, যা অনেকের নজর কেড়েছিল তখন। সেই কর্মসূচির পিছনের ঘটনাগুলো কি?
সাদিক কায়েম:
১৬ জুলাই সন্ধ্যায় আমরা খবর পাই যে সারা দেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে, এবং সায়েন্স ল্যাব, রংপুর, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে আবু সাঈদ, ওয়াসিম, শান্তসহ ছয়জন শহীদ হয়েছেন। এই খবর আমাদের দৃঢ়তাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। আমি আসিফের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, “খুনি হাসিনার পতন নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা থামব না।” আমরা ঠিক করি, শহীদদের সম্মানে গায়েবি জানাজার কর্মসূচি দেব। এটি ছিল একটি তাৎপর্যপূর্ণ প্রোগ্রাম, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঐক্য ও প্রতিরোধের চেতনাকে জাগিয়ে তুলবে।
কিন্তু এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা ছিল অত্যন্ত কঠিন। পুরো ক্যাম্পাস যৌথবাহিনী—পুলিশ, র্যাব, বিজিবি—দিয়ে অবরুদ্ধ ছিল। সকাল থেকে যেখানেই শিক্ষার্থীরা জড়ো হওয়ার চেষ্টা করছিল, পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। সাতটি কফিন ক্যাম্পাসে আনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল মাহফুজ ভাইকে। তিনি অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে কফিন আনার চেষ্টা করেন, কিন্তু পুলিশ বাধা দেয়। আমরা তখন মিছিল নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের কাছে যাই এবং পুলিশকে সরিয়ে কফিনগুলো নিয়ে আসি। কফিনগুলো ভিসি চত্বরে আনার পর প্রতিটির উপর একটি করে পতাকা রাখি।
গায়েবি জানাজা শুরু হওয়ার সাথে সাথে পুলিশ গুলি চালানো শুরু করে। শিক্ষার্থীরা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে, এবং আমরা হল পাড়ার দিকে চলে আসি। এর মধ্যে খবর আসে যে ক্যাম্পাস বন্ধ করে দেওয়া হবে। এই খবর শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা ছড়ায়, কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল আন্দোলনের কেন্দ্র। আমরা তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আন্দোলনকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেব। শিক্ষার্থীরা যখন হল ছাড়তে শুরু করছিল, আমরা তাদের বোঝাই, “মরলে একসঙ্গে মরব, বাঁচলে একসঙ্গে বাঁচব। কেউ হল ছাড়বে না।” আমরা হলের গেটে তালা মেরে রাখি। যারা বেরিয়ে গিয়েছিল, তাদের উপর ছাত্রলীগ কাঁটাবন, শাহবাগে হামলা করে। আমরা সাবেক সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করে শিক্ষার্থীদের ঢাকায় থাকার ব্যবস্থা করি। সে সময় শিক্ষকদের কাছেও সাহায্য চাই, ডানপন্থী শিক্ষকেরা কেউ এগিয়ে আসেননি তবে বামপন্থী শিক্ষকদের সহযোগিতা পেয়েছিলাম। এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও গায়েবি জানাজা আমাদের দৃঢ়তাকে আরও শক্তিশালী করে।
প্রশ্ন ১৩: যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দমন করা হচ্ছিল, তখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমস্বরে জেগে উঠেছিল। সকল স্তরের শিক্ষার্থীকে আন্দোলনে সংযুক্ত করার জন্য আপনারা কী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন?
সাদিক কায়েম:
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যখন দমনের মুখে পড়ছিল, তখন আমরা বুঝেছিলাম যে আন্দোলনকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সারা দেশের সকল স্তরের শিক্ষার্থীকে যুক্ত করতে হবে। আমি সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বশীলদের সাথে এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতাদের সাথে মিটিং করি। তাহমিদ, হুজাইফা, সাদিক আল আরমান, রাফিদ—এদের সাথে আমার আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল। আমরা চাইছিলাম প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আন্দোলনে এনগেজ করতে। কিন্তু ১৮ জুলাই সকাল থেকে যেভাবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে জেগে ওঠে, তা আমাদের কল্পনার বাইরে ছিল। সাদিক আল আরমান পুরো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। শহীদদের রক্ত আর লাশের সারি দেখে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি অভূতপূর্ব গণজাগরণ সৃষ্টি হয়।
এই সময় সরকার সমন্বয়কদের সংলাপে ডাকে এবং বলে, “সকল দাবি মেনে নেওয়া হবে।” আমি তখন নাহিদ, মাহফুজ, সারজিস, হাসনাত—সবাইকে ফোন দিয়ে বলি, “রক্তের ওপর কোনো সংলাপ হতে পারে না। যে সংলাপ করবে, সে শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানি করবে।” আমরা সবাইকে পোস্ট দিতে বলি, “রক্তের উপর সংলাপ হয় না।” এই পোস্টগুলো আন্দোলনকে আরও গতি দেয়। এই সময়ে আমরা রাজনৈতিক দলগুলোকে আন্দোলনে যুক্ত করার চেষ্টা করি। আমি জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার সাহেবের সাথে কথা বলি। আমি তাকে বলেছিলাম, “আপনারা কী করছেন? এত বিশাল একটা মোমেন্টাম, শিক্ষার্থীদের এত স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন। আওয়ামী লীগ যদি বিরোধী দলে থাকতো এবং এমন একটা সুযোগ পেতো, অনেক আগেই রেজিম ভেঙে ফেলতো। আপনারা আসেন, এনগেজ হন। এটা একটা স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন। বিএনপিকে এখানে এনগেজ করেন।” তিনি মির্জা ফখরুলের সাথে কথা বলেন। কিন্তু তাদের স্টেটমেন্ট ছিল, “তোমরা যেভাবে ভাবছ, আমরা সেভাবে ভাবছি না। তোমরা একটু বেশি ভাবছ, বেশি বুঝছ।” এই প্রতিক্রিয়া আমাদের হতাশ করলেও আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, কে সমর্থন দিল বা না দিল, তা ফ্যাক্টর নয়। আমরা আমাদের লড়াই চালিয়ে যাব।
ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট এবং কারফিউয়ের আশঙ্কার মধ্যেও আমরা এমন কর্মসূচি ঠিক করি, যাতে নেতা থাকুক বা না থাকুক, আন্দোলন চলতে থাকে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গণজাগরণ এই কৌশলকে সফল করে। আমাদের পূর্বের যোগাযোগ এবং সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা ফল দেয়, এবং আন্দোলন কোটার সীমা ছাড়িয়ে হাসিনার পতনের দাবিতে রূপ নেয়।
প্রশ্ন ১৪: আন্দোলনের এক পর্যায়ে সরকারের পক্ষ থেকে ইন্টারনেট সংযোগ সম্পূর্ণ ছিন্ন করা হয়, এবং সংবাদমাধ্যমে নানা গুজব ছড়ায়, বিশেষ করে নয় দফা এবং আট দফা দাবি নিয়ে। সে সময় আপনারা আন্দোলন কীভাবে চালিয়ে গিয়েছিলেন, এবং দাবিপত্রের এই ভিন্নতার কারণ কী ছিল?
সাদিক কায়েম:
১৮ জুলাই রাতে যখন ইন্টারনেট সংযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়, তখন আন্দোলনের জন্য একটি অন্ধকার পরিস্থিতি তৈরি হয়। পুরো আন্দোলনটি ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল ছিল—আমরা মুহূর্তের মধ্যে একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে পারতাম, বিশ্বের পরিস্থিতি দেখতে পারতাম। কিন্তু হঠাৎ সব বন্ধ। নাহিদ, আসিফ—সব সমন্বয়কদের নাম্বার বন্ধ। স্যাটেলাইট মিডিয়াগুলোতে সরকারের প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছিল—শিক্ষার্থীরা দাবি মেনে নিয়েছে, পড়ার টেবিলে ফিরে গেছে, এমনকি হাসনাত, সারজিসের নামে বলা হচ্ছিল তারা সংলাপে বসেছে। এই গুজব আমাদের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ ছিল। ১৫ জুলাইয়ের হামলার পর থেকে আমি পুরোপুরি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ি, এবং ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের সময় পুরো আন্দোলনের দায়িত্ব আমাদের ওপর চলে আসে।
আমরা আগে থেকেই ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের সম্ভাবনা অনুমান করেছিলাম। তাই আমরা ১০-১২টি অফলাইন সিম এবং মোবাইল কিনে রেখেছিলাম। সিফাত উল্লাহ ভাই, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সাবেক সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক ছিলেন, তিনি একটি অফলাইন নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার দায়িত্ব পান। আমরা সারা দেশকে ১০টি অঞ্চলে ভাগ করে রেখেছিলাম। প্রতিটি অঞ্চলের দায়িত্বশীলদের নাম্বার আগে থেকে সংগ্রহ করা ছিল, এবং কীভাবে নির্দেশনা দেওয়া হবে, তা পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছিল। ইন্টারনেট বন্ধ হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা এই অফলাইন নেটওয়ার্ক চালু করি। আমি তখন নিজে প্রতিনিয়ত স্থান পরিবর্তন করতাম—একদিন বাসায়, একদিন অফিসে, একদিন রাস্তায়।
১৯ জুলাই শুক্রবারের জন্য আমরা নির্দেশ দিই যে সারা দেশে গণমিছিল বের করতে হবে। জুমার নামাজের পর প্রতিটি মসজিদ থেকে বড় বড় মিছিল বের হবে, এবং আমাদের ছেলেরা সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবে। এই মিছিলগুলো গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে ডিজাইন করা হয়। ফলস্বরূপ, ঢাকা, সাভার, যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, বাড্ডা, মিরপুর, সায়েন্স ল্যাব—প্রতিটি জায়গা থেকে বিশাল গণজোয়ার দেখা যায়। আমি নিজে এই মিছিলে ছিলাম। যেহেতু সমন্বয়কদের সাথে যোগাযোগ ছিল না—নাহিদকে পাওয়া যাচ্ছিল না, আসিফকে গুম করার গুজব ছড়ানো হচ্ছিল—আমরা নিজেরাই কর্মসূচি ঠিক করি।
নয় দফা দাবির বিষয়ে বলি। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতিদের একটি গ্রুপ—মির্জা গালিব ভাই, জুনায়েদ, রিফাত ভাই, ফরহাদ ভাই, সিফাত উল্লাহ ভাই—মিলে নয় দফা তৈরি করি। এই দাবিগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছিল যে একটি দফা মানলে আরেকটির সাথে সংযোগ তৈরি হবে, এবং পুরোপুরি মানলে হাসিনার রেজিম ভেঙে পড়বে। প্রথম দফা ছিল—ছাত্র হত্যার দায় নিয়ে হাসিনাকে জাতির কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে। এই দাবিগুলো আন্দোলনকে চলমান রাখার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। আমরা আসিফের সাথে আলোচনা করে এই দাবিগুলো চূড়ান্ত করি। কিন্তু ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের মধ্যে এটি প্রচার করা ছিল চ্যালেঞ্জ।
আমরা বারসিকের একটি অফিসে বসে মোসাদ্দেক আলীকে ডেকে আনি। তার সাথে নয় দফার ভূমিকা ড্রাফট করি। তারপর আব্দুল কাদেরকে ফোন দিয়ে বলি, “আমরা নয় দফা তৈরি করছি। এটি তোমার নামে প্রকাশ করতে চাই।” তিনি রাজি হন। আমরা তাকে বলি, “সাংবাদিকরা ফোন করলে তুমি সত্যায়ন করবে। কিন্তু নিরাপত্তার জন্য ৫-৬ কিলোমিটার দূরে গিয়ে ফোন করবে, তারপর মোবাইল বন্ধ করে সেফ হোমে চলে যাবে।” আমরা নারায়ণগঞ্জ মহানগরের অফিস সম্পাদক অমিতের মাধ্যমে তাকে সেফ হোমে পাঠাই। নয় দফা প্রচারের জন্য আমরা পেনড্রাইভে ভিডিও এবং প্রেস রিলিজ তৈরি করি। কিন্তু আমাদের অফিসে বিদ্যুৎ ছিল না, বাসায় প্রিন্টারের কালি শেষ। আমি, সিফাত উল্লাহ, এবং শাকিল দুটি বাইক নিয়ে বাংলামোটরের একটি অফিস থেকে প্রিন্ট করাই। সাংবাদিকরা শাহবাগে ছাত্রলীগের অবস্থানের কারণে আসতে পারছিলেন না। আমরা দুজনকে বাইক দিয়ে পাঠাই। সাংবাদিক সোহান এবং মেহেদীকে একটি হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ব্লুটুথের মাধ্যমে নয় দফা শেয়ার করি। ১০-১২টি পেনড্রাইভে ভিডিও বার্তা তৈরি করে প্রতিটি মিডিয়া হাউজে পাঠাই। দেশি মিডিয়া প্রচার না করলে আমরা আন্তর্জাতিক মিডিয়ার দ্বারস্থ হই। শফিক ভাইয়ের এএফপি অফিসে ইন্টারনেট ছিল। আমরা শহীদুল আলম এবং তার স্ত্রীর মাধ্যমে নয় দফা প্রচার করি। আল জাজিরাও এটি প্রকাশ করে। প্রথম দিন পত্রিকাগুলো ছাপায়নি, দ্বিতীয় দিন মাত্র ৩-৪টি পত্রিকায় ছাপা হয়।
আট দফার বিষয়টি সরকারি এজেন্সির কাজ। তারা নয় দফাকে মডারেট করে আট দফা তৈরি করে, যেখানে মূল দাবি—হাসিনার ক্ষমা প্রার্থনা—বাদ দেওয়া হয়। বাকি দাবিগুলোকে “পানি, ফুল, পাখি, লতাপাতা” টাইপের নিরীহ দাবিতে রূপান্তর করা হয়, যাতে সরকারের ওপর কোনো চাপ না পড়ে। এটি ছিল তাদের প্রোপাগান্ডার অংশ, যেন আন্দোলন দুর্বল হয়। কিন্তু আমাদের অফলাইন নেটওয়ার্ক এবং নয় দফার প্রচারের মাধ্যমে আমরা আন্দোলনকে সচল রাখি।
প্রশ্ন ১৫: সম্প্রতি আল জাজিরার অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের সামি তার ফেসবুক পোস্টে শেয়ার করেছিলেন যে, সরকার যখন ছাত্রনেতাদের গুম করা শুরু করে, তখন আপনি “সালমান” ছদ্মনামে ছাত্র আন্দোলনকারীদের জন্য সেফ হোমের ব্যবস্থা করেছিলেন। এর পিছনের গল্প কী?
সাদিক কায়েম:
১৯ জুলাই থেকে ২ আগস্ট পর্যন্ত যতগুলো প্রেস রিলিজ প্রকাশিত হয়েছে, সব আমি লিখেছি। এই সময়ে সমন্বয়কদের সেফ হোমে নিয়ে যাওয়া, আন্দোলন কো-অর্ডিনেশন, কর্মসূচি ঠিক করা, শহীদদের তালিকা প্রকাশ, দেশি-আন্তর্জাতিক স্টেকহোল্ডারদের সাথে যোগাযোগ—সবকিছু আমি পরিচালনা করেছি। যেহেতু আমার সাথে অনেক মানুষের যোগাযোগ ছিল, নিরাপত্তার কারণে আমি “সালমান” ছদ্মনাম ব্যবহার করতাম। সে মুহুর্তে এটি আমার নিরাপত্তার প্রশ্ন ছিল। আমি অনেককে চিনতাম না, কিন্তু আমার লক্ষ্য ছিল কাজটি সম্পন্ন করা। শহীদুল আলম থেকে শুরু করে অনেক স্টেকহোল্ডারের সাথে আমি যুক্ত ছিলাম।
১৯ জুলাই রাতে নাহিদের সাথে দীর্ঘ আলোচনা হয়। তিনি বলেন, “আন্দোলন এখন তোমার হাতে। তুমি চালিয়ে যাও। পারবে তো?” আমি বলি, “অবশ্যই। আমরা তো আন্দোলনের জন্যই নেমেছি। তোমরা শক্ত থাকো। ইনশাআল্লাহ, বিজয় আসবে।” ২২ জুলাই থেকে আমরা সেকেন্ড লেয়ারের সমন্বয়কদের—হান্নান মাসুদ, মোসাদ্দেক, মাহিন সরকার—সেফ হোমে পাঠানোর ব্যবস্থা করি। ২৬ জুলাই মূল সমন্বয়কদের ডিবি অফিসে ধরে নিয়ে যায়। পরদিন হান্নান মাসুদ, মাহিন সরকারকে গুম করার জন্য হাসপাতালে আটকে রাখা হয়। আমরা অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে তাদের বের করে সেফ হোমে পাঠাই।
সেফ হোমের ব্যবস্থার জন্য আমি প্রথমে একটি এম্বাসির পলিটিক্যাল অফিসারের সাথে যোগাযোগ করি। তিনি বলেন, “এটি হলিউড মুভি নয়। এম্বাসির কাজ সেফ হোম দেওয়া নয়।” তিনি আমাকে সাংবাদিক নাজমুল হাসানের নাম্বার দেন। নাজমুলের সাথে কথা বলে তিনি একজন নারী সাংবাদিকের নাম্বার দেন, যিনি আমাকে জুলকারনাইন সায়ের সামির নাম্বার দেন। জুলকারনাইন আমাকে ইউএনের মানবাধিকার কর্মীরনাম্বার দেন। তিনি তার অফিসে শেল্টারের ব্যবস্থা করেন। এই প্রক্রিয়াটি ছিল জটিল এবং দীর্ঘ। জুলকারনাইন তার ফেসবুক পোস্টে ঘটনার মাত্র ১০% বলেছেন। আমি একই সময়ে ৩০টি স্টেকহোল্ডারের সাথে যুক্ত ছিলাম। প্রতিদিন কর্মসূচি ঠিক করা, নাম প্রণয়ন, শহীদদের ডকুমেন্টেশন—সবকিছু চলছিল একটি হতাশাজনক পরিস্থিতিতে। কিন্তু আমরা হাল ছাড়িনি। ২৫ জুলাই গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে নাহিদ, আসিফের সাথে আবার দেখা হয়। আমি তাদের সবকিছু জানাই, তাদের মনোবল বাড়াই। এভাবে আমরা আন্দোলনকে সচল রাখি।
প্রশ্ন ১৬: আন্দোলনকে এক পর্যায়ে যখন আন্দোলনের সকল নেতাদের ডিবি অফিসে গুম করে ফেলা হলো এবং জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি নেওয়া হলো তখন অনেকে মনে করেছিলেন যে আন্দোলন হয়তো শেষ সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আন্দোলনকে পুরোপুরিভাবে এক দফার আন্দোলনে রূপ দেওয়া হয়েছিল। এটি কীভাবে সম্ভব হয়েছিল?
সাদিক কায়েম: জুলাই ২৬–২৭, ২০২৪ তারিখে সারা দেশে গণগ্রেপ্তার চলছিল। সবাই বলছিল, “হাসিনা টিকে গেছে।” কিন্তু আমরা—আমি, জুনায়েদ, ফরহাদ ভাই, রিফাত, মোসাদ্দেক—দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম। একটি পক্ষ প্রস্তাব দিয়েছিল ক্যাম্পাস খোলার জন্য আন্দোলন করা হোক। আমরা স্পষ্টভাবে বলি, “না। ক্যাম্পাস খোলা হোক বা বন্ধ হোক, আন্দোলন চলবেই। এখন আর কোটার প্রশ্ন নেই। এখন থেকে আন্দোলন হবে এক দফার—শেখ হাসিনার পতন।” এই সিদ্ধান্ত ছিল আমাদের কৌশলের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মুহূর্ত।
আন্দোলনকে টিকিয়ে রাখতে আমরা ছোট ছোট কর্মসূচি ঘোষণা করি। হাসিনা পাগলের মতো সবাইকে গ্রেপ্তার করছিল—নুরুল হক নুর, জামায়াত নেতা, যাকে পায় তাকে। কিন্তু এতে তার তেমন লাভ হয়নি। আন্দোলনের নিউক্লিয়াস ছিলাম আমরা। আমরা যে কর্মসূচি দিতাম, তা নির্ধারণ করতো পরের দিন কী হবে। আমাদের পরিকল্পনা ছিল গোপন; ক্লোজ সার্কেলের বাইরে কেউ জানতো না। এটি ছিল আল্লাহর রহমত। হাসিনা যাকে ধরতো, তাতে আন্দোলনের কোনো ক্ষতি হতো না।
হাসিনা যখন শোক প্রকাশের নির্দেশ দেয়, আমরা এর বিরোধিতা করে সিদ্ধান্ত নিই চোখে-মুখে লাল কাপড় বেঁধে ফেসবুক প্রোফাইল পিকচার লাল করার। প্রথমে কালো কাপড়ের আইডিয়া ছিল, কিন্তু ফরহাদ ভাই লাল কাপড়ের প্রস্তাব দেন। এই কর্মসূচি শহীদদের প্রতি সম্মান ও হাসিনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে ওঠে। “রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ” এবং “মার্চ ফর জাস্টিস” কর্মসূচিগুলোর পেছনে গভীর পরিকল্পনা ছিল। “মার্চ ফর জাস্টিস” ঘোষণার মাধ্যমে আমরা গণগ্রেপ্তার বন্ধ করতে সক্ষম হই।
সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতি ছিল ২৮–২৯ জুলাই। সেদিন ডিবি অফিসে সমন্বয়করা—নাহিদ, আসিফ—বাধ্য হয়ে স্বীকারোক্তি দেয় যে আন্দোলন স্থগিত হয়ে গেছে, সরকার আমাদের দাবি মেনে নিচ্ছে, আমরা আন্দোলন স্থগিত করে দেব। সেই সময়টা ছিল সবচেয়ে কঠিন—আন্দোলনকে টিকিয়ে রাখা। তখন আমি দ্বিতীয় স্তরের সমন্বয়ক মাহিন সরকার, রিফাত রশিদদের সাথে আলোচনা শুরু করলাম, “তোমরা কি আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারবে?” আমি বললাম, “তোমরা যদি না পারো, তাহলে আমি তৃতীয় স্তরের সমন্বয়কদের নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাব। এখান থেকে পিছনে ফিরে বা ঘুরে তাকানোর কোনো সময় নেই।” আমি পরবর্তীতে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করি। সেই বিক্ষোভ কর্মসূচিটা মনে হচ্ছিল আগুন নিয়ে খেলার মতো, কারণ তখন কোনো ছেলেমেয়ে উপস্থিত ছিল না। সারা দেশে যারা ছিল, সব ছিল শুধুমাত্র আমাদের সংগঠনের ছেলেরা। বাইরে থেকে সাধারণ কেউ ছিল না। যেমন, আমাদের ছেলে মোসাদ্দেক পল্টনে একাই নেতৃত্ব দিয়েছিল। তাছাড়া উত্তরায়, চট্টগ্রামে, সারা দেশে আমাদের সংগঠনের ছেলেরা আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছিল।
২ আগস্ট শুক্রবার, নাহিদ, আসিফদের ডিবি থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আমি তাদের সাথে দীর্ঘ আলোচনা করি এবং আবার কোলাবোরেটিভ কাজ শুরু করি। আমরা সারা দেশে গায়েবি জানাজা ও কফিন মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করি। এই কর্মসূচি শহীদদের সম্মান জানানোর পাশাপাশি আন্দোলনের মোমেন্টাম ফিরিয়ে আনে। ১ আগস্ট থেকে আমরা এক দফার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, কিন্তু ঘোষণার জন্য সঠিক সময়ের অপেক্ষা করছিলাম। ২ আগস্ট রাতে আমরা দীর্ঘ আলোচনা করি—এক দফার অসহযোগ আন্দোলনে কী থাকবে, কীভাবে ঘোষণা হবে। অবশেষে, ৩ আগস্ট শহীদ মিনারে এক দফা ঘোষণা করা হয়: শেখ হাসিনার পদত্যাগ।
৪ আগস্টের কর্মসূচি ছিল ফাইনাল খেলা। ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ দুপুর ১২টায় শাহবাগে প্রোগ্রাম ঘোষণা করেছিল। আমি আসিফকে ফোন দিয়ে বলি, “আমাদের প্রোগ্রাম সকাল ১০টায় বা সর্বোচ্চ ১১টায় করতে হবে। শাহবাগ আমাদের দখল করতে হবে, নয়তো তারা আমাদের কচুকাটা করবে।” আমরা সকাল থেকে শাহবাগ দখল করি। ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা অস্ত্র নিয়ে নামে, কিন্তু আমরা তাদের হটিয়ে দিই। শাহবাগ, সায়েন্স ল্যাব—সব জায়গায় ব্যাপক গোলাগুলি হয়। প্রায় ১২০–১৩০ জন শহীদ হন। এই তীব্রতার মধ্যে নাহিদ, বামদের প্রভাবে, আমাদের সাথে পরামর্শ না করে ৫ আগস্টের জন্য শাহবাগে শ্রমিক সমাবেশ ও শহীদ মিনারে নারী সমাবেশ ঘোষণা করে। তারা ৬ আগস্টের জন্য “মার্চ টু ঢাকা” ঘোষণা করে। এটা শুনে আমি ক্ষুব্ধ হই। আমি মাহফুজকে বকি এবং আসিফকে ফোন দিয়ে বলি, “এক সেকেন্ড দেরি করার সময় নেই। আজ রাতেই ‘মার্চ টু ঢাকা’ ঘোষণা করতে হবে। আমি ঢাকাকে ১০টি ভাগে ভাগ করছি। যত লোক লাগে, আমি দেব।” আমি বলি, “হাসিনা যদি একদিন পায়, সে সব ম্যানেজ করে আন্দোলন ঠান্ডা করে ফেলবে।” ৪ আগস্ট রাতে কারফিউ জারি হয়, কিন্তু আসিফ আমার কথায় ৫ আগস্টের জন্য “মার্চ টু ঢাকা” ঘোষণা করে।
৫ আগস্ট রাত থেকে সারা দেশ থেকে মানুষ দলে দলে ঢাকায় আসতে শুরু করে। আমরা ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে প্রস্তুত হই। সকাল সাড়ে ১০টায় গোপন সূত্র থেকে খবর পাই যে হাসিনা আর টিকবে না। তখন থেকে আমরা বিজয়ের প্রস্তুতি নিতে থাকি। দুপুর ১২টায় শাহবাগে বিশাল মিছিল জড়ো হয়। এর আগে আমি কখনো জনসম্মুখে আসিনি। ৫ আগস্ট প্রথমবার আমি নাহিদ, আসিফদের সাথে চ্যানেল ২৪-এর অফিসে গিয়ে প্রেস কনফারেন্স করি। এটি ছিল আমার প্রথম প্রকাশ্য উপস্থিতি।
এই সময় থেকে আমরা নিশ্চিত ছিলাম যে হাসিনা আর টিকতে পারবে না। তখনই আমরা নতুন সরকার গঠনের চিন্তা শুরু করি। জাতীয় সরকারের প্রস্তাবনা দিই। সরকারপ্রধান কে হবে? ড. মুহাম্মদ ইউনূস নাকি অন্য কেউ? আমি ড. ইউনূসের সহকারী লামিয়া মোরশেদের সাথে যোগাযোগ করি। ৪ আগস্ট সকাল ১১টায় আমরা ড. ইমরোজের সাথে মিটিং সেট করি, কিন্তু পরিস্থিতির কারণে তা সম্ভব হয়নি। ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় চ্যানেল ২৪-এর অফিস থেকে আমরা ড. ইউনূসের সাথে যোগাযোগ করি। প্রেস কনফারেন্সের পর আমরা কার্জন হলে যাই। আসিফ বলে, “ভাই, তিনটি গাড়ি ও একটি সেফ হাউসের ব্যবস্থা করো। আজ রাতটা নিরাপদ থাকা গুরুত্বপূর্ণ।” ধানমন্ডির একটি বাসায় আমরা ২০–২৫ জন একসঙ্গে ছিলাম। সেখানে উপদেষ্টাদের নাম ঠিক করি, ড. ইউনূসের সাথে ভবিষৎ পরিকল্পনার রূপরেখা তৈরি করি।
এক দফার আন্দোলন ছিল আমাদের দৃঢ়তা, গোপন কৌশল, এবং সংগঠনের শক্তির ফল। ২৮–২৯ জুলাইয়ের সংকট কাটিয়ে আমরা ছোট ছোট কর্মসূচির মাধ্যমে মোমেন্টাম ধরে রাখি, শহীদদের সম্মান জানাই, এবং ৫ আগস্টের “মার্চ টু ঢাকা” দিয়ে হাসিনার পতন নিশ্চিত করি। এই আন্দোলনের প্রতিটি পদক্ষেপে হাজারো ঘটনা জড়িত ছিল—এটি তার একটি অংশ মাত্র।
প্রশ্ন ১৭: আপনি একবার বলেছিলেন, 'ফতহে গণভবন পতন ঘটানোর চেয়ে বড় রাজনীতি আর কিছু নেই।' এখানে 'ফতহে গণভবন' পরিভাষাটির অর্থ কি এবং এর পিছনের প্রেক্ষাপট কি? আপনার কাছে সত্যিকারের 'ফতহে' বা বিজয়ের প্রকৃতি কী—ক্ষমতা দখল, নাকি মানুষের চেতনাজগতের মুক্তি?
সাদিক কায়েম: ফতেহে গণভবন মানে গণভবনের বিজয়। এই বিজয়ের মুহূর্তটি ছিল অবিস্মরণীয়, এমন এক আনন্দ ও উল্লাস যা বর্ণনা করা কঠিন। ওই দিন গণভবনে মানুষের ভিড়, তাদের আবেগ, উচ্ছ্বাস—কেউ নামাজ পড়ছিল, কেউ সিজদায় লুটিয়ে পড়ছিল, কেউ মোনাজাত করছিল, কেউ আল্লাহর কাছে দোয়া করছিল, কেউ কাঁদছিল, কেউ ফোনে প্রিয়জনদের সাথে এই আনন্দ ভাগ করে নিচ্ছিল। এটি ছিল আবেগ, আনন্দ, আর বিজয়ের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ।
ফতেহে গণভবন শুধু একটি স্থানের বিজয় নয়, এটি ছিল দীর্ঘদিনের দমন-পীড়ন থেকে মুক্তির প্রতীক। এটি ঐতিহাসিক বিজয়ের ধারাবাহিকতা—যেমন মক্কা বিজয় বা মদিনা ফতেহ, যখন মানুষ অত্যাচার থেকে মুক্তি পেয়ে উল্লাস করেছিল। বাংলার ইতিহাসে যখন এই অঞ্চল হিন্দুত্ববাদী আধিপত্য বা অন্যায় শাসন থেকে মুক্তি পেয়েছিল, তেমনি ফতেহে গণভবন ছিল ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান এবং মানুষের আজাদির উৎসব। এটি ছিল গণঅভিযোগের বিজয়, যেখানে দীর্ঘদিনের নিপীড়ন, অত্যাচার ও দমন থেকে জনগণ মুক্তি পেয়েছে।
এই ফতেহ সূরা নাসরের আলোকে বোঝা যায়, যেখানে বলা হয়েছে, “যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে বিজয় আসবে এবং তুমি দেখবে মানুষ দলে দলে আল্লাহর দ্বীনের দিকে আসছে, তখন তুমি তাসবিহ পড়বে, আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবে এবং ইস্তিগফার করবে।” ফতেহে গণভবন ছিল এমনই এক বিজয়, যেখানে মানুষ শুধু রাজনৈতিক মুক্তি পায়নি, বরং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে এই বিজয় উদযাপন করেছে। এটি ছিল বাংলাদেশের মানুষের আজাদির আনন্দ, একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত যা আমাদের সংগ্রামের সার্থকতার প্রতীক।
প্রশ্ন ১৮: জুলাই আন্দোলনে অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্ব যারা ছিল, তারা এখন নতুন রাজনৈতিক দল, নতুন রাজনৈতিক মূল্যবোধ নিয়ে আসছে। এটা নিয়ে আপনার মতামত কী? আদর্শ এবং বাস্তবতার মধ্যে দুইটার সাথে কীভাবে সমন্বয় রাখতে পারে এই দলটা?
সাদিক কায়েম: জুলাই আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বিরাট সুযোগ তৈরি করেছে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে একটি নতুন প্রজন্মের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত হয়েছে, যা আগে কখনো এভাবে দেখা যায়নি। শহুরে মধ্যবিত্ত, আরবান মিডল ক্লাস, এমনকি যারা আগে রাজনীতির প্রতি উদাসীন ছিল, তারাও এখন রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে চায়। এই রাজনৈতিক আশা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, এবং চেতনার জাগরণ একটি শূন্যতা পূরণের জন্য নতুন রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তা তৈরি করেছে। আমি মনে করি, বাংলাদেশপন্থী একটি রাজনৈতিক দল এখন সময়ের দাবি, যারা মুসলিম বিদ্বেষী হবে না, অতি উগ্র হবে না, বরং ইসলামের পক্ষে এবং বাংলাদেশের স্বার্থে কাজ করবে। এই দলের আদর্শ জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শনের সাথে মিল থাকতে পারে, যিনি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে দেশকে এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বিএনপি আজ তার আদর্শ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। তারা অত্যধিক সেকুলার এবং ভারতপন্থী হয়ে পড়েছে, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরক্তি সৃষ্টি করেছে। আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষ যেমন ক্ষুব্ধ হয়েছিল, বিএনপির বর্তমান নীতি ও কর্মকাণ্ড যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে তারাও জনগণের আস্থা হারাবে। এই পথে গেলে বিএনপি ব্যর্থ হবে, এবং এটি আরেকটি গণঅভ্যুত্থানের পথ প্রশস্ত করতে পারে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, সেটি পূরণের জন্য এমন একটি দল দরকার, যারা সততা, নিষ্ঠা, এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার সাথে কাজ করবে। এই শূন্যতা পূরণে যারা সৎভাবে এগিয়ে আসবে, তাদেরই সফলতার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
জুলাই আন্দোলনের পর ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি) গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, যেখানে নাহিদ, আসিফ, হাসনাত, সারজিসের মতো নেতারা ছিলেন। এই নেতাদের প্রতি মানুষের বিপুল আশা-ভরসা ছিল। কিন্তু তারা সেই আশার প্রতিদান দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের ব্যর্থতার কারণ শুধু মিসম্যানেজমেন্ট বা সংকীর্ণ মানসিকতা নয়, বরং নৈতিক ও মানসিক অবক্ষয়। তারা এতটাই অসৎ হয়ে পড়েছে যে, সাধারণ মানুষ এখন তাদের প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছে, নিজেদের প্রতারিত মনে করছে। তাদের চিন্তাভাবনা ছাত্রশক্তির গণ্ডির মধ্যে আটকে আছে। তারা একটি রাজনৈতিক দলের জন্য যে উদার মানসিকতা, সবাইকে সঙ্গে নেওয়ার ক্ষমতা, এবং ঐক্যের রাজনীতি প্রয়োজন, তা গড়ে তুলতে পারেনি। ৫ই আগস্টের পর, যখন সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে কাজ করার প্রয়োজন ছিল, তারা বরং মাইনাস করার রাজনীতি শুরু করে। তাদের মধ্যে কোনো ঐকমত্য নেই। একেকজন একেক দিকে চিন্তা করে—কেউ ব্যবসার উদ্দেশ্যে, কেউ চাঁদাবাজির জন্য, কেউ ব্যক্তিগত ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য এসেছে। এভাবে রাজনীতি হয় না। রাজনীতির জন্য দরকার দলের প্রতি নিষ্ঠা, চিন্তার ঐক্য, এবং সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করার মানসিকতা। এনসিপির নেতারা এই আদর্শের সঙ্গে বাস্তবতার সমন্বয় করতে পারেনি, তাই তাদের সম্ভাবনা এখন অনেকটাই কমে গেছে।
বিপরীতে, আমি মনে করি জুনায়েদ ভাইদের উদ্যোগ অনেক বেশি সম্ভাবনাময়। তাদের সততা, মহৎ উদ্দেশ্য, এবং নিষ্ঠা আছে। যদি তারা সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে পারে, সৎভাবে এবং নিষ্ঠার সঙ্গে লেগে থাকে, তাহলে তাদের সফল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে তাদের একটি চ্যালেঞ্জ হলো জনপরিচিতি। অভ্যুত্থানের সময় নাহিদ বা আসিফের মতো নেতারা জনমানুষের কাছে পরিচিত ছিলেন, কিন্তু জুনায়েদ ভাইদের এখনো সেই পরিচিতি গড়ে তুলতে হবে। তবে এনসিপির বর্তমান নৈতিক অবক্ষয় এতটাই স্পষ্ট যে, তাদের পূর্বের পরিচিতি এখন আর কোনো মূল্য বহন করে না। মানুষ তাদের উপর আস্থা হারিয়েছে। জুনায়েদ ভাইরা যদি ধৈর্য ধরে কাজ করে, তাহলে এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারবে।
আমি মনে করি, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন একাধিক তরুণ শক্তির উত্থান প্রয়োজন। এটি শুধু ইসলামপন্থী রাজনীতির জন্যই নয়, সমগ্র বাংলাদেশের জন্য উপকারী। জামায়াতে ইসলামীর মতো দলগুলোর জন্যও এটি ভালো, কারণ বাংলাদেশের বর্তমান সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে তারা একা সঠিকভাবে নিজেদের বোঝাতে পারছে না। তাদের মিত্র দরকার। নতুন রাজনৈতিক শক্তি গড়ে উঠলে জামায়াতের মিত্র বাড়বে, যেমনটা বামপন্থী দলগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায়। তারা কমন শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে। এই ধরনের ঐক্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে।
রাজনীতি একটি ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্র, ব্যবসার মতো। বিনিয়োগের মতো এখানেও ঝুঁকি নিতে হয়। লাভ হলে অনেক লাভ, আর ক্ষতি হলে সব হারানোর সম্ভাবনা। তবে আমি বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশাল সম্ভাবনা দেখি। বর্তমান প্রজন্মের মানসিকতায় যে পরিবর্তন এসেছে, তা অভূতপূর্ব। এক বছর আগেও যে প্রজন্ম ফুটবল, ফুড ব্লগিং, বা ফেসবুকে ব্যস্ত ছিল, তারা এখন রাজনৈতিকভাবে সচেতন। পান থেকে চুন খসলেই তারা সমালোচনা শুরু করে। এই প্রজন্মকে যদি সঠিকভাবে গড়ে তোলা যায়, তাহলে তারা দীর্ঘমেয়াদে সফল হবে।
আমি বিশ্বাস করি, জুনায়েদ ভাইদের উদ্যোগ এই মুহূর্তে সবচেয়ে সম্ভাবনাময়। তাদের সততা, মহৎ উদ্দেশ্য, এবং সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে। তারা যদি সবাইকে সঙ্গে নিয়ে, ঐক্যের রাজনীতি করে এগিয়ে যায়, তাহলে তারা আদর্শ ও বাস্তবতার সমন্বয় ঘটিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারবে। তবে রাজনীতি গতিশীল, সময়ই বলে দেবে এই উদ্যোগ কতটা সফল হবে।
প্রশ্ন ১৯: আপনি নিজেও একজন ডানপন্থী ছাত্র রাজনীতিক। আপনি কি মনে করেন, এখন সময় এসেছে ডানপন্থী রাজনীতির ভেতরে আদর্শিক ও কৌশলগত সংস্কার আনার? আপনি নেতৃত্বে থাকলে কী কী পরিবর্তন আনতে চান?
সাদিক কায়েম: আমি এমন একটি রাজনীতির স্বপ্ন দেখি, যেখানে কেউ অতি উগ্র ডানপন্থী বা অতি বামপন্থী-লিবারেল হয়ে উঠবে না। আমি মধ্যমপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী, যেখানে সবাই তাদের আদর্শ ও সংস্কৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে সহাবস্থান করতে পারে। মুখে মধ্যমপন্থার কথা বলা সহজ, কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগে অনেকেই ব্যর্থ হন। আমি চাই, ডানপন্থী রাজনীতি এই মধ্যমপন্থাকে শুধু কথায় নয়, কাজেও প্রতিফলিত করুক।
আমার কল্পনার বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যেখানে কেউ তাদের আত্মপরিচয় নিয়ে সংকটে ভুগবে না বা হীনমন্যতায় ভুগবে না। প্রত্যেকে নিজের ধর্ম, সংস্কৃতি, এবং মূল্যবোধ গর্বের সঙ্গে প্রকাশ করতে পারবে। এর পাশাপাশি, অন্য ধর্মের মানুষদের নিরাপত্তা ও সম্মান নিশ্চিত করা হবে। আমি চাই, ডানপন্থী রাজনীতি এমন একটি সমাজ গড়ে তুলুক, যেখানে সবাই তাদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশের স্বাধীনতা পাবে, এবং সবার জন্য নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে।
ডানপন্থী রাজনীতির একটি বড় সমস্যা হলো, অনেকের মধ্যে হীনমন্যতা বা ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স কাজ করে। এটি তাদের আত্মপরিচয়ের সংকট থেকে উৎপন্ন হয়। এই সমস্যা সমাধানের জন্য আমি মনে করি, ডানপন্থীদের তাদের ইতিহাস ও অতীতের গৌরবকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। আমাদের গৌরবময় ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং অবদানগুলো জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের বিশাল অবদান ছিল—৭০-৮০ জন যোদ্ধা ছিলেন মাদ্রাসার ছাত্র। কিন্তু এই ইতিহাস আজ প্রায় মুছে ফেলা হয়েছে। ১৯৭৫-এর বিপ্লব, ১৯৯০-এর গণআন্দোলন—এসব ক্ষেত্রেও ডানপন্থীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এই অবদানগুলোকে সংরক্ষণ করতে হবে, প্রচার করতে হবে, এবং জনগণের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগাতে হবে।
মূল সংস্কার বলতে আমি মনে করি প্রথমত, জুলাই আন্দোলনের চেতনাকে ধরে রাখা উচিত, যা ছিল ডানপন্থী চেতনার একটি শক্তিশালী বহিঃপ্রকাশ। এই আন্দোলনের স্লোগান “তাকবীর, আল্লাহু আকবর” ছিল আমাদের সামগ্রিক আদর্শের প্রতিফলন। যা জনগণের মধ্যে ঐক্য ও শক্তি জাগাবে। দ্বিতীয়ত, ডানপন্থীদের রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়ানো উচিত। আমাদের তরুণদের ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং আদর্শ সম্পর্কে শিক্ষিত করতে হবে, যাতে তারা গর্বের সঙ্গে তাদের পরিচয় প্রকাশ করতে পারে। তৃতীয়ত, প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামোগত সংস্কারের উপর জোর দেওয়া উচিত। বাংলাদেশের শিক্ষা, প্রশাসন, এবং বিচার ব্যবস্থার মতো প্রতিষ্ঠানগুলো আজ ভঙ্গুর অবস্থায়। এগুলোকে স্বাধীন, শক্তিশালী, এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ করতে হবে।
আমি চাই, ডানপন্থী রাজনীতি এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করুক, যেখানে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করা যায়। আমাদের অতীতের গৌরব, বর্তমানের চ্যালেঞ্জ, এবং ভবিষ্যতের রোডম্যাপ জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। আমি এমন একটি রাজনীতি গড়তে চাই, যেখানে ডানপন্থীরা শুধু আদর্শের কথা বলবে না, বরং সেই আদর্শ বাস্তবে রূপায়িত করবে। এটি হবে একটি সমন্বিত, মধ্যমপন্থী, এবং সবার জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিতকারী রাজনীতি, যা বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করবে।