
সাবেক সংসদ সদস্য শাম্মী আহমেদের গুলশানের বাসায় চাঁদাবাজির ঘটনায় আলোচনা-সমালোচনা চলছেই। আর আলোচনায় ঘুরেফিরেই আসছে চাঁদাবাজির মূল হোতা আব্দুর রাজ্জাক বিন সুলাইমান রিয়াদ ও ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক জানে আলম অপুর নাম। এর মধ্যে রিয়াদকে গ্রেপ্তার করা হলেও এখনও অধরা অপু। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা বলছেন, সংগঠনের শীর্ষ পর্যায় থেকে দিনের পর দিন ব্যবস্থা গ্রহণ না করার কারণেই এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। কারও মন্তব্য, জুলাই আন্দোলনকারী হিসেবে অঘোষিত ‘অপরীসীম ক্ষমতার অপব্যবহার’ এর অন্যতম কারণ।
দেশব্যাপী আলোচনায় আসা ওই ঘটনায় ইতোমধ্যেই গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের রবিবার আদালতে তুলে পুলিশ। পরে তাদের মধ্যে চারজনের ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। ইতোমধ্যে ৫ নেতাকে বৈষম্যবিরোধী ও গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ও ছাত্র সংসদের ৫ নেতার চাঁদাবাজির ঘটনায় সারা দেশে তুমুল সমালোচনার ঝড় উঠে। গ্রেপ্তার ৫ নেতার মধ্যে আব্দুর রাজ্জাক বিন সুলাইমান রিয়াদ ও জানে আলম অপুর রাজনৈতিক বিভিন্ন নেতার সঙ্গে থাকা ছবি, তাদের আচার-আচরণ, কর্মকাণ্ড নিয়ে ফেসবুকে কড়া সমালোচনা করছেন নেটিজনরা। তাদের ভাষ্য, চাঁদাবাজরা প্রভাবশালী; যার সঙ্গেই তাদের দেখা হয়েছে, তার সঙ্গেই ছবি তুলে রেখেছেন। যেসব ছবি দেখিয়ে বড় বড় ধরনের চাঁদা বা ডিল করে থাকেন। একজন লিখেছেন, ‘রিয়াদ ও অপু প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বাইক, আইফোন কীভাবে কিনছে? তাদের সার্কেলের সবার জীবন জাঁকজমকপূর্ণ। এছাড়াও জুলাই বিপ্লবে তাদের অবদান থাকায় তারা কাউকে পরোয়া করে আচার-আচরণ দেখাতেন না। যার-তার সঙ্গে যা-তা ব্যবহার করে বেড়াতেন। তাদের এমন কার্যকলাপে অনেকেই অসন্তুষ্ট ছিলেন। কেউ মুখ খোলেনি জানান তারা। তাদের গ্রেপ্তারের পরপরই ফেসবুকে তাদের অপকর্ম নিয়ে মুখ খুলছে অনেকেই।
জানা গেছে, আব্দুর রাজ্জাক বিন সুলাইমান রিয়াদ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ফোরামের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও পড়াশোনা করছেন প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটিতে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত না থেকেও দেন মিডটার্ম ও সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা। জুলাইকে পুঁজি করে পরীক্ষা নিতে শিক্ষকদের বাধ্য করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি, আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামায়াত-এনসিপি নেতা ও অন্তবর্তী সরকারের উপদেষ্টাসহ আলোচিত ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলতেন। আর সেসব ছবি ফেসবুকে শেয়ারের মাধ্যমে ক্ষমতার প্রভাব দেখানোর অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। যদিও জুলাই বিপ্লবে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন এই ছাত্র। বর্তমানে তারই নৈতিকতার স্থলনে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নেটিজনরা।
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ছবিগুলোতে দেখা যায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনেকের সঙ্গে ছবি রয়েছে রিয়াদের। এই প্ল্যাটফর্মটি সে চাঁদাবাজি ও অন্যায় কর্মকাণ্ডে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। এক ছবিতে তাকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টার সঙ্গেও দেখা গেছে। জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহর সঙ্গেও অনেক ছবি। সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং বিএনপি নেতা লুৎফুজ্জামান বাবর, ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থের সঙ্গেও রিয়াদকে দেখা গেছে ঘনিষ্ঠভাবে। জামায়াত নেতা ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদের সঙ্গেও ছবিতে উপস্থিতি রয়েছে তার।
রিয়াদের বিষয়ে তার এক বন্ধু বলেন, রিয়াদ ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী। সে এখনও ২য় সেমিস্টার শেষ করতে পারেনি। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে কম আসেন, শুধু পরীক্ষা দেন।
এদিকে চাঁদাবাজির অভিযোগে গ্রিন ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ও কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক জানে আলম অপুকে বহিষ্কার করেছে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ। যদিও তাকে এখনও গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। জুলাইয়ে অবদান থাকায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে সহানুভূতি পেলেও নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নেন না তিনি। পঞ্চম সেমিস্টারের পরীক্ষা নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা। রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ছবি তুলে শো-অফ, প্রভাব বিস্তারসহ নানা অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। এ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে এডমিট কার্ড জালিয়াতির ঘটনায় এক সেমিস্টার বহিষ্কার হন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, গ্রিন ইউনিভার্সিটিতে এডমিট কার্ড জালিয়াতির মত ঘটনা কখনও ঘটেনি, যেটা জানে আলম শুরু করেছিলেন।
এর আগে গ্রিন ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের এই শিক্ষার্থীকে ২০২৪ সালের ১২ জুন রাস্তা আটকে বাস ভাংচুর ও অসদাচরণের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, জানে আলম অপু গেজেটভুক্ত আহত ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে টিউশন ফি মওকুফের সুবিধাভোগী শিক্ষার্থী হিসেবে স্বীকৃত। গত ৫ মার্চ এ বিষয়ে প্রকাশিত গেজেট এবং তৎপরবর্তীতে জানে আলমের আবেদনের প্রেক্ষিতে এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিক অনুমোদন ও যথাযথভাবে কার্যকর করে। কিন্তু জানে আলম তা না মেনে পূর্ববর্তী বকেয়া প্রদানে অস্বীকৃতি জানান এবং সেগুলোকেও ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে মওকুফ পাওয়া টিউশন ফি সুবিধায় আনার অযৌক্তিক দাবি তুলেন; যা নিয়ে অশস্তিতে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এদিকে গত ১৭ জুলাই প্রথম দফায় চাঁদা আনতে সাবেক এমপির বাসায় যান দু’ব্যক্তি। সেই সময়ের একটি সিসিটিভি ফুটেজে তাদের উপস্থিতি ধরা পড়ে। ফুটেজটি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তাদের দুইজনের একজন হচ্ছেন গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক জানে আলম অপু। ফুটেজে দেখা যায়, অপু তার কাঁধে একটি ব্যাগ বহন করছেন-যা তিনি প্রায়ই সঙ্গে রাখেন। সেদিনও ব্যাগটি তার সঙ্গে ছিল। এছাড়া অপুর কথোপকথনের কিছু অংশও শোনা যায়। এ ঘটনার পর ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়ে নিজের অবস্থান তুলে ধরেন।
পোস্টে তিনি বলেন, ‘প্রথমত আমি গ্রেপ্তার হইনি, দ্বিতীয়ত আমি কোথাও চাঁদাবাজিও করি নাই। আজকের গুলশানের ঘটনায় আমি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনোভাবেই জড়িত ছিলাম না।’ এছাড়া চাঁদাবাজির ঘটনার ভিডিওর ব্যাখ্যা মিডিয়ার সামনে দিবে বলেও তিনি জানান।
জানে আলম অপুর বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, জুলাই যোদ্ধা হিসেবে তার প্রতি আমাদের সহানুভূতি সর্বদা ছিল। রাজনৈতিক নেতাদের মতো সেও নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে না। চতুর্থ সেমিস্টার শেষ করেছে কিনা সন্দেহ। এর আগেও বাস ভাঙচুরের ঘটনায় তাকে ক্যাম্পাস থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়েছিল। পরে ৫ আগস্টের পরে তা উঠিয়ে নেওয়া হয়। অপু আর্থিকভাবে একটু দুর্বল। তার ক্যারিয়ার নিয়ে সবাই চিন্তিত।
যা বলছেন তরুণ নেতারা
জুলাই বিপ্লবের অন্যতম সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা উমামা তার ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘রিয়াদ গত ডিসেম্বরে রূপায়ন টাওয়ারে আমার সামনে অত্যন্ত উশৃঙ্খল আচরণ করেছিল। আমরা মেয়েরা তাকে থামানোর চেষ্টা করলে, সে আমাদের ওপর চড়াও হয়। সেই ঘটনার পর তার সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, তার বিরুদ্ধে হুমকি, মারামারি এবং চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে। তখন আমি অবাক হইনি, কারণ ততদিনে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে এমন ধরনের মানুষের উপস্থিতি সর্বত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।’
তিনি লেখেন, ‘তারা রূপায়ন টাওয়ারে অবাধে আসা-যাওয়া করত। দুর্নীতি বা অসততার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানালে, সে সময় পিনড্রপ সাইলেন্সই পাওয়া যেত। আমি নিজে চোখের সামনে দেখতাম কীভাবে এসব লোকজন দিনের শেষে এক্সেস পেয়ে যেত। আজ, মাস কয়েক পর এই প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকালে, কোনো ভাষা খুঁজে পাই না। প্রত্যেকে নিজের মতো করে এই প্ল্যাটফর্মকে নষ্ট করেছে। এবার প্রথমবারের মতো চাঁদাবাজি করতে গিয়ে তারা পুলিশের হাতে ধরা পড়ল। সঠিকভাবে খোঁজ নিলে বুঝবেন, এদের শেকড় অনেক গভীরে।’
জুলাই বিপ্লবের আরেক সক্রিয় নেতা আব্দুল্লাহিল বাকি ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘চাঁদাবাজির কৌশলটা দেখেন। প্রভাবশালী যার সাথেই দেখা হয়, তার সঙ্গেই ছবি তোলে। নাহিদ, হাসনাতদের সঙ্গেও ছবি তুলেছে। কারণ এসব ছবি দেখিয়ে বড় বড় ডিল করা যায়, ধান্ধার। এই ছেলেটা নতুন বাইক নিয়ে ঘুরে, নতুন নতুন আইফোন কিনে, তার সার্কেলের সবাই লাক্সারিয়াস লাইফ কাটাচ্ছে। কিন্তু সোনাচান ভেবেছে, কখনও ধরা খাবে না। যার-তার সঙ্গে বেয়াদবি করে, কাউকে সম্মান দিয়ে কথা বলে না।’