Image description

মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের মধ্যে ইসরায়েল সম্প্রতি সিরিয়ার দামেস্ক ও সুওয়াইদার গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েল দাবি করেছে যে সুওয়াইদায় দ্রুজ মিলিশিয়া ও সুন্নি বেদুইন উপজাতিদের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে দ্রুজদের রক্ষা করতে এই হামলাগুলো চালানো জরুরি ছিল।

বিশ্লেষকদের মতে, সিরিয়ায় ইসরায়েলের হামলার ফলে নতুন করে যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে, তাতে তুরস্ককে একটি নাজুক পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে। আঙ্কারা এখন সিরিয়ার পরিবর্তিত পরিস্থিতির ওপর তাদের কৌশলগত অবস্থান পুনরায় মূল্যায়ন করছে। সীমান্ত নিরাপত্তা, সন্ত্রাস দমন ও সিরিয়ার রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে তুর্কি রাজনীতিবিদেরা নজিরবিহীন চাপের মধ্যে রয়েছেন।

দ্য নিউ আরবকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তুর্কি নিরাপত্তা বিশ্লেষক এরসান এরগুর ব্যাখ্যা করেছেন যে সিরিয়ার আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষা করা এখন তুরস্কের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ভিত্তিস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, ‘আঙ্কারা এখন আর সিরিয়ার ইস্যুকে কেবল একটি বৈদেশিক নীতির বিষয় হিসেবে দেখে না, বরং এটিকে অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার বিষয় হিসেবে দেখে।’ তিনি আঞ্চলিক বিভাজন থেকে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়া এবং আবার তুরস্কে শরণার্থীর ঢল নামতে পারে—এমন আশঙ্কার কথাও উল্লেখ করেন।

এরগুর বলেন, তুরস্কের কৌশলটি তার ‘সন্ত্রাসমুক্ত তুরস্ক’ প্রকল্পের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। তুরস্কের এ প্রকল্পটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত করে। তুরস্কের ভূরাজনৈতিক অবস্থান, আঞ্চলিক বাণিজ্য ও নিরাপত্তা নেটওয়ার্কগুলো সঙ্গে গভীর যুক্ততার কারণে আঙ্কারা সিরিয়াকে স্থিতিশীল করতে চায়। এটি শুধু তার সীমান্ত রক্ষা করার জন্য নয়, বরং তার আশপাশে ব্যর্থ রাষ্ট্রগুলোর উত্থান রোধ করার জন্যও।

ইসরায়েলি হামলার পর সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে সেনাবাহিনী ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরের কাছে ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা যায়। ১৬ জুলাই ২০২৫
ইসরায়েলি হামলার পর সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে সেনাবাহিনী ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরের কাছে ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা যায়। ১৬ জুলাই ২০২৫ছবি: এএফপি

এরগুর আরও বলেন, তুর্কি নীতিনির্ধারকেরা সিরিয়ায় ইসরায়েলের হস্তক্ষেপকে বিপজ্জনক উসকানি হিসেবে দেখছেন। এ হামলার লক্ষ্য হলো, সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত উত্তেজনা পুনরায় উসকে দেওয়া। এমন পরিস্থিতি আরও একটি গৃহযুদ্ধ শুরু করতে পারে এবং তুরস্কে বর্তমানে আশ্রয় নেওয়া ৩৫ লাখ সিরীয় শরণার্থীর প্রত্যাবর্তনকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

সিরিয়ার ওপর ইসরায়েলি হামলার দ্রুত নিন্দা জানিয়েছে আঙ্কারা। প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান তেল আবিবের বিরুদ্ধে দ্রুজ–সংকটকে ব্যবহার করে সিরিয়ায় হস্তক্ষেপকে ন্যায্যতা দেওয়া এবং সিরিয়ার আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে হুমকির মুখে ফেলার অভিযোগ করেছেন। তুরস্কের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ও একই সুরে কথা বলেছে। তারা সতর্ক করে বলেছে যে চলমান উত্তেজনা বৃদ্ধি শান্তি প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করতে পারে এবং আরও বড় আঞ্চলিক সংকট তৈরি করতে পারে। আঙ্কারা সিরিয়ার পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হলে তার প্রতিরক্ষা সহায়তার জন্য প্রস্তুত বলেও জানিয়েছে এবং জোর দিয়ে বলেছে যে সিরিয়ার স্থিতিশীলতা সব প্রতিবেশী দেশের জন্য অপরিহার্য।

তুরস্ক ইসরায়েলের সম্প্রসারণ ঠেকিয়ে দিচ্ছে

তুর্কি নিরাপত্তা বিশ্লেষক এরগুর যুক্তি দিয়েছেন যে তুরস্কের সিরিয়া নীতি আত্মরক্ষার বাইরে আরও বিস্তৃত হয়েছে। যেটি আঙ্কারাকে ইসরায়েলি আধিপত্য বিস্তারের উচ্চাকাঙ্ক্ষা মোকাবিলার জন্য একটি মূল আঞ্চলিক খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তিনি বলেন, ‘ইসরায়েল স্থানীয় মিলিশিয়াদের সমর্থন দিয়ে এবং দামেস্কের কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বকে ভেঙে তার প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। এখানে ইসরায়েলের জন্য তুরস্ক হচ্ছে শেষ অবশিষ্ট বাধাগুলোর মধ্যে একটি।’

তুরস্কের সাবেক প্রধানমন্ত্রী উপদেষ্টা কাহিত তুজ এই বিশ্লেষণকে সমর্থন করে দ্য নিউ আরবকে বলেছেন যে ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে তার সম্প্রসারণের জন্য তুরস্ককে একটি ঐতিহাসিক ও কৌশলগত বাধা হিসেবে দেখে। তুজ সতর্ক করে বলেন, ‘গাজা ছিল কেবল শুরু। এরপর এসেছে লেবানন, ইয়েমেন ও সিরিয়া। কিন্তু চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো স্বয়ং তুরস্ক।’ তিনি আরও বলেন যে আঙ্কারার ক্রমবর্ধমান প্রতিরক্ষা সক্ষমতা, বিশেষ করে তার ড্রোনশিল্প, ইসরায়েলকে চিন্তিত করে তুলেছে।

এই উদ্বেগের প্রতিধ্বনি ইসরায়েলের নাগেল কমিশনের ২০২৫ সালের প্রতিবেদনেও পাওয়া যায়, যেখানে সিরিয়ায় তুরস্কের প্রভাবকে ইরানের চেয়েও বড় হুমকি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে আঙ্কারা-সমর্থিত সিরিয়ার সরকার ইসরায়েলি স্বার্থের জন্য সরাসরি হুমকি হতে পারে।

এরগুরের মতে, দক্ষিণ সিরিয়ায় ইসরায়েলের হস্তক্ষেপকে কেবল একটি কৌশলগত অভিযান হিসেবে নয়, বরং একটি বৃহত্তর আঞ্চলিক ক্ষমতার লড়াইয়ের অংশ হিসেবে বোঝা উচিত। তেল আবিব সিরিয়াকে বিভক্ত করার জুয়া খেলছে। আর আঙ্কারা তাকে ঐক্যবদ্ধ রাখার ওপর বাজি ধরছে—দুটি উদ্দেশ্যেই, আঞ্চলিক প্রভাব তৈরি করা ও তার দোরগোড়ায় ইসরায়েলি দুঃসাহসিকতার নেতিবাচক প্রভাব এড়ানো।

যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরও বেদুইন যোদ্ধা ও দ্রুজ বন্দুকধারীদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। এ সময় বেদুইন যোদ্ধাদের মোটরসাইকেলে চড়ে সশস্ত্র মহড়া। সিরিয়ার সুয়েইদা শহরে, ১৮ জুলাই ২০২৫
যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরও বেদুইন যোদ্ধা ও দ্রুজ বন্দুকধারীদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। এ সময় বেদুইন যোদ্ধাদের মোটরসাইকেলে চড়ে সশস্ত্র মহড়া। সিরিয়ার সুয়েইদা শহরে, ১৮ জুলাই ২০২৫ছবি: রয়টার্স

ইসরায়েলের ‘ডেভিড করিডর’ পরিকল্পনা

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক তাহা ওউদা ওগ্লু বলেছেন যে সিরিয়ায় প্রভাব বিস্তারের জন্য ইসরায়েল ও তুরস্কের মধ্যে একটি নীরব প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, বিশেষ করে কুর্দি নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেসের (এসডিএফ) সঙ্গে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে।

তাহা ওউদা ওগ্লু সতর্ক করে বলেন যে ইসরায়েল সম্ভবত এমন একটি পরিকল্পনা নিয়েছে, যাকে কিছু আঞ্চলিক বিশ্লেষক ‘ডেভিড করিডর’ বলছেন। এই পরিকল্পনার লক্ষ্য হলো সুওয়াইদার মাধ্যমে ইউফ্রেটিস নদীর পূর্ব দিকের অঞ্চলগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের সংযোগ স্থাপন করা। সিরিয়ার মূল ভূখণ্ডে ইসরায়েলি সম্প্রসারণকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য তেল আবিব এখানে ধর্মীয় বয়ান ব্যবহার করছে। ওউদা বলেন যে আঙ্কারায় এ প্রকল্পটিকে একটি প্রকৃত কৌশলগত প্রকল্প হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা তুরস্কের নিরাপত্তার জন্য হুমকি।

কথিত আছে, সুওয়াইদার সংঘর্ষ চলাকালীন দ্রুজ আধ্যাত্মিক নেতা হিকমত আল-হিজরি কুর্দি ফোর্সের (এসডিএফ) পাশাপাশি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কাছেও সহায়তা চেয়েছিলেন। ওউদা এই সংযোগকে তুর্কি কর্মকর্তাদের দ্বারা দামেস্ককে দুর্বল করতে এবং আঙ্কারাকে পাশ কাটিয়ে একটি কার্যত বাফার জোন তৈরির জন্য ইসরায়েলি-কুর্দি প্রচেষ্টা হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন।

তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান সুওয়াইদার অস্থিরতাকে কাজে লাগিয়ে দক্ষিণ সিরিয়ায় নিজেদের অবস্থান সম্প্রসারণের জন্য এসডিএফকে সতর্ক করেছেন। তিনি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তার জাতীয় নিরাপত্তাকে অন্যদের সার্বভৌমত্বের ঊর্ধ্বে রাখার এবং ভূরাজনৈতিক কৌশল হিসেবে অস্থিরতাকে উসকে দেওয়ার অভিযোগ করেন।

ওউদার মতে, প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এই বার্তাকে আরও দৃঢ় করেছেন এই বলে, তুরস্ক তার দক্ষিণ সীমান্তে কোনো ‘সন্ত্রাসী করিডর’ সহ্য করবে না—যা তথাকথিত ডেভিড করিডরের একটি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত।

দামেস্কের প্রতি পূর্ণ সমর্থন

দামেস্কের প্রতি তুরস্কের নীতি স্পষ্ট ও দৃঢ়। আঙ্কারা আহমেদ আল-শারার অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রকাশ্যে সমর্থন করেছে, তাকে এমন একজন স্থিতিশীল ব্যক্তিত্ব হিসেবে দেখছে, যিনি সিরিয়ার পুনরায় বিশৃঙ্খলার মধ্যে পতন রোধ করতে সক্ষম।

২২ জুলাই প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সুওয়াইদা সংকটে পদক্ষেপের জন্য শারার প্রশংসা করেন, বিশেষ করে দ্রুজ নেতাদের সঙ্গে উত্তেজনা কমানোর জন্য একটি বোঝাপড়া তৈরির সাফল্যকে সাধুবাদ জানান। এরদোয়ান বলেছিলেন, ‘প্রেসিডেন্ট শারা কোনো ছাড় দেননি এবং একটি অত্যন্ত ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছেন। ইসরায়েল এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা চায় না এবং আমাদের এই প্রকল্পের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।’

ওউদা ওগ্লুর মতে, এটি আঞ্চলিক খেলোয়াড় ও সম্ভাব্য ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতি এরদোয়ানের একটি স্পষ্ট বার্তা, ‘শারার সরকার অস্থিতিশীল হলে তুরস্ক চুপ থাকবে না।’ তিনি যুক্তি দেন যে আঙ্কারা শারাকে সিরিয়ার ঐক্য পুনর্গঠনের জন্য একজন বৈধ অংশীদার হিসেবে দেখছে এবং তাকে দুর্বল করার যেকোনো ইসরায়েলি প্রচেষ্টাকে আঞ্চলিক ভারসাম্যের জন্য সরাসরি হুমকি মনে করছে।

সাবেক উপদেষ্টা কাহিত তুজও এই কথার প্রতিধ্বনি করে বলেন যে সিরিয়ার অভ্যন্তরে ইসরায়েলের হামলা চলতে থাকলে আঙ্কারা দ্রুত কূটনৈতিক সংযম ত্যাগ করতে পারে। এখন পর্যন্ত তুরস্ক রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু যদি এই আগ্রাসন চলতে থাকে, তবে এটি তুর্কি স্বার্থ এবং অঞ্চলের ভঙ্গুর স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করতে পারে।

  • বাসিল আল মুহাম্মেদ তুরস্কভিত্তিক সিরীয় সাংবাদিক।

দ্য নিউ আরব থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ।