Image description

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ও জনপ্রিয় দল বিএনপির ভেতরেও রয়েছে এন্তার ঝামেলা। এই দলটিকে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিমের বিরুদ্ধে প্রায় দেড় দশক ধরে কঠিন কঠোর সংগ্রাম চালাতে হয়েছে। অনেক নেতাকর্মী গুম ও খুনের শিকার হয়েছেন। হামলা, মামলা, নির্যাতনে জর্জরিত হতে হয়েছে লাখ লাখ নেতাকর্মীকে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে যে দলের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকার কথা ছিল, প্রহসনের নির্বাচনে ক্ষমতার মেয়াদ বারবার বাড়িয়ে সেই দলটিকে স্বাভাবিক রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কার্যক্রমও চালাতে দেওয়া হয়নি। লাখ লাখ নেতাকর্মীকে মিথ্যা মামলায় বছরের পর বছর জেল খাটতে হয়েছে। অনেককে পলাতক ফেরারি জীবন যাপন করতে হয়েছে। নির্যাতনে অনেকে পঙ্গু হয়ে গেছেন। জীবনধারণের জন্য অনেককে জমিজিরেত সব বিক্রি করে নিঃস্ব হতে হয়েছে। কায়ক্লেশে জীবিকা অর্জন করতে হয়েছে।

চব্বিশের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট রেজিমের পতনের পর সেই দলটিতে অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। দলের চেয়ারপারসন অসুস্থ। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রবাসী জীবনের অবসান ঘটিয়ে এখনও দেশে ফেরেননি। এমন অবস্থায় দলের বাকি নেতারা উচ্ছৃঙ্খল হয়ে ওঠা সদস্যদের রাস টানতে পারছেন না। শৃঙ্খলা ভেঙে অনেকে চাঁদাবাজি, দখল ও সন্ত্রাসসহ নানা রকম গণবিরোধী তৎপরতায় জড়িয়ে পড়ার দায়ে অভিযুক্ত হচ্ছেন। তাদের বিরুদ্ধে শক্ত সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন স্তরে কয়েক হাজার বহিষ্কৃত হয়েছেন। তবুও শৃঙ্খলা ফিরছে না। দলের আগাগোড়া পুনর্গঠন ও রাজনীতির সংস্কার ছাড়া এ থেকে নিস্তার নেই বলে পর্যবেক্ষকদের মত।

এর বাইরেও নানা রকম অভ্যন্তরীণ সমস্যায় ক্লিষ্ট হচ্ছে বিএনপি। কোটারি, দলাদলি ও পক্ষপাতিত্বের জের ধরে দুর্বল হচ্ছে সংগঠন। গতকাল দৈনিক প্রতিদিনের বাংলাদেশ পত্রিকায় ‘আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কী’ শিরোনামে যে শীর্ষ প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে সেটি পড়ে লিখিত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন একজন বিএনপি নেতা। স্থানীয়, নিজ জেলা ও জাতীয় পর্যায়ে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় নেতাটি বলেছেন, আওয়ামী লীগের পতন ও বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্লেষণের পাশাপাশি বিএনপির অবস্থাও তুলে ধরা দরকার। সঙ্গত কারণে নামধাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নেতাটি বলেন, আওয়ামী লীগ এখন অতীত আর বিএনপি এখন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। কাজেই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে অধিষ্ঠানের আগে এই দলেরও দোষত্রুটি শোধরানো দরকার। তিনি বলেন, বিএনপিতেও অভ্যন্তরীণ অনেক ঝামেলা আছে। রয়েছে নানান অনিয়ম।

নিজে আইন পেশায় নিয়োজিত এই নেতা দলের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন অনিয়মের উদাহরণ তুলে ধরতে গিয়ে লিখেছেন, ধরুন একটি জেলার কোর্টে জিপি, পিপি নিয়োগ হয়েছে। সেখানে দলীয় মেধাবীদের বাদ দিয়ে সব পরীক্ষায় তৃতীয় শ্রেণিপ্রাপ্তকে জিপি বানানো হলো। এর মধ্যে অনেকে জীবনে কোনোদিন সিভিল মামলা করেননি। জিপি হয়েও জিপির চেম্বারে বসে ক্রিমিনাল মামলা পরিচালনা করে লাখ লাখ টাকা কামাচ্ছেন। 

নেতাটি লিখেছেন, দলের নেতারা যুক্তি দিয়ে বলবেন, এসব আইন উপদেষ্টা করেছেন, কিন্তু সত্যি কথা হলোÑ আইন উপদেষ্টা দলের নেতার কথায়ই সব নিয়োগ দিয়েছেন। কারণ আইন উপদেষ্টাও জানেন, ওই নেতারা হাইকমান্ডের লোক। অভিযোগকারী নেতাটি প্রশ্ন করেন, এতে কি মেসেজ গেল জেলাবাসীর কাছে? এই প্রশ্নের জবাব তিনি নিজেই দিতে গিয়ে লিখেছেন, মেসেজ গেল যে, বিএনপির কাছে মেধাবীর কোনো প্রয়োজন নেই, বরং বৈষম্য আর নেতাদের পছন্দের কোটা আগের চেয়ে বেড়েছে।

নিজের জেলার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি লিখেছেন, দলের হাইকমান্ড আগে এক নেতার কথায় জেলা চালাতেন। এখন অন্য এক নেতার কথায় জেলা চলে। দলের নয়, এমন কেউ সেই নেতার কথার সামান্য বাইরে গেলেই তার বিরুদ্ধে অ্যাকশন। এখনকার জন আগের জনের তুলনায় আরও বেশি একনায়কসুলভ আচরণ করছেন। কারণ তিনি হাইকমান্ডের আরও বেশি কাছের মানুষ। সুতরাং নিজের মান, সম্মান, ব্যক্তিত্ব জলাঞ্জলি দিয়ে জেলার ওই নতুন একনায়কের বন্দনা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই কারও। 

তিনি আরও লিখেছেন, যেমন ধরুনÑ একজন কর্মী স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে কর্মসূচি করতে গিয়ে অসংখ্যবার গ্রেপ্তার হয়েছেন, পুলিশ দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন, প্রতিটি প্রোগ্রাম সফল করতে শ্রম-ঘাম-টাকা ঢেলে দিয়েছেন, তিনি মেধাবী ও উচ্চশিক্ষিত হলেও জেলার নব্য একনায়ক নেতার কাছে তার মূল্য নেই। অন্যদিকে যেকোনো আন্দোলন না করলেও একনায়ক নেতার সাথে ছিল, নেতার বাজার-সওদা করে দেওয়া থেকে শুরু করে নানা প্রয়োজন মিটিয়েছে এবং যে বিভিন্ন পরীক্ষায় চারবার করে ফেল করে সার্টিফিকেট কিনে পাস দেখিয়েছে, তাকেই বেশি মর্যাদা দেওয়া হয়।

লিখিত প্রতিক্রিয়ায় অভিযোগ করা হয়, এসব অসংগতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ারও সুযোগ নেই। এসব নিয়ে কথা বললে সারা জীবনের রাজনীতির পাততাড়ি গুটিয়ে বিদায় নিতে হবে, কারণ একনায়ক নেতাটি দলের হাইকমান্ডের কাছে প্রিয় ও আস্থাভাজন। তার পক্ষে দলের শীর্ষ নেতাদের প্রভাবিত করে ব্যবস্থা নেওয়ানো সম্ভব। আবার সেই প্রভাবশালী একনায়ক নেতাটি কোটি কোটি টাকার অনৈতিক বাণিজ্য, এমনকি নারী কেলেঙ্কারি করলেও কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সব মিলিয়ে বিএনপির ভেতরে অনেক জায়গাতেই এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে বলে তিনি অভিযোগ করেন এবং সব শেষে একটি প্রশ্ন ছুড়ে দেন : ‘এর প্রতিকার কী?’