
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ঢিলেঢালা বৈঠক এবং অন্তর্বর্তী সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট জাতীয় নাগরিক কমিটি (এনসিপি) ও জামায়াতের নির্বাচনের পেছানোর দাবির কারণে ‘রোজার আগের নির্বাচন’ অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি। তবে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং সারাদেশের মানুষ ভোট দেয়ার জন্য আছেন মুখিয়ে। কোনো অঘটন না ঘটলে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন যখন ঘরে কড়া নাড়ছে তখন জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ‘দক্ষিণপন্থীদের উত্থানে উদ্বিগ্ন’ বক্তব্য নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিতর্ক শুরু হয়েছে। নেটিজেনদের কেউ কেউ প্রশ্ন করছেন, মির্জা ফখরুল বিএনপির দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে এমন বক্তব্য দিতে পারেন কিনা? কেউ বলছেন, তারেক রহমানের বিএনপি কী মির্জা ফখরুলের বক্তব্য সমর্থন করে? কেউ লিখেছেন, দক্ষিণপন্থীদের উত্থান বলতে মির্জা ফখরুল কাদের বুঝিয়েছেন? শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের চিন্তা চেতনার সঙ্গে ‘দক্ষিণপন্থীদের উত্থানে উদ্বিগ্ন’ শব্দটি যায় না। কেউ বলছেন, বিএনপির মহাসচিবকে কথা বলার সময় আরো সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। কেউ বলছেন, তৌহিদী জনতা, আলেম ওলামাদের ভোটের কী বিএনপির প্রয়োজন নেই? আবার কেউ বলছেন, মির্জা ফখরুল হয়তো জামায়াত-এনসিপি-ইসলামী আন্দোলনকে উদ্দেশ্য করে ‘দক্ষিণপন্থীদের উত্থান’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তার উচিত ছিল বক্তব্যে সেটা ক্লিয়ার করা। প্রশ্ন হচ্ছে আসন্ন নির্বাচনের আগে মির্জা ফখরুল ইসলাম ভোটারদের কী বার্তা দিচ্ছেন?
মূলত প্রথম আলোকে দেয়া সাক্ষাৎকরে প্রশ্ন করা হয়েছিল ‘আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসানের পর দেশের রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থীদের উত্থান হতে যাচ্ছে? আপনি কী দেখেন?’ জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, আমিও দেখছি। সে জন্য আমি উদ্বিগ্ন। আমি বাংলাদেশকে সব সময় একটা সত্যিকার অর্থে উদারপন্থী গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ হিসেবে দেখতে চাই এবং এখানে গণতন্ত্র হবে সবচেয়ে বড় বিষয়। সেই জায়গায় যদি এখন এমন এমন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান হয়, যারা গণতন্ত্রেই বিশ্বাস করে না। আবার তারা নিজেরা জোর করে চাপিয়ে দিতে চায় মতবাদকে, এটা নিঃসন্দেহে এলার্মিং সিচুয়েশন। কিছু কিছু দলের মধ্যে এমনও কথা আছে যে মহিলাদের তারা কিছুতেই সামনে আনতে চায় না। মহিলাদের তারা রাজনৈতিক ক্ষমতা তো দূরের কথা, তারা সামাজিক ক্ষমতায়নও করতে চায় না। এসব দলের যদি উত্থান হয় এই দেশে, তাহলে তো পিছিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো পথ থাকবে না’।
দেশের ১২ কোটি ভোটারের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটার ইসলামী চিন্তা চেতনা অনুসরণ করেন। যার জন্যই শুক্রবার জুম্মার নামাজে মসজিদে মুসুল্লিদের জায়গা হয় না; রাস্তায় নামাজ পড়ার দৃশ্য দেখা যায়। ধর্মান্ধ না হলেও দেশের মানুষ ইসলামী চিন্তা চেতনা ধারণ করেন। ইসলামী জলসা, ওয়াজ মাহফিলে লাখ লাখ লোকজড়ো হয়। পীর-ফকিরের দরবার-খানকা শরীফের উরশ লাখো জাকেরান-আশেকান-মুরিদের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠে। প্রশ্ন হচ্ছে দক্ষিণপন্থী কারা। তথাকথিত প্রগতিশীল মতবাদ, সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী এবং ধর্ম নিরপেক্ষতায় বিশ্বাসীদের বামপন্থী বলা হয়। আর এর বিপরীত পক্ষ তথা গণতান্ত্রিক এবং ধর্মের প্রতি অতি বিশ্বাসীদের ডানপন্থী বা দক্ষিণপন্থী বলা হয়। দেশে দুই ধরার দলই রয়েছে। রাজনৈতিক ভাবে বামপন্থীরা কার্যত শক্তিহীন। আর দক্ষিণপন্থীদের বিস্তার বেশি। বিশেষ করে রাজনৈতিক শক্তির বাইরে দক্ষিণপন্থী বিপুল পরিমাণ অরাজনৈতিক শক্তি রয়েছে। যারা নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এটা ঠিক দক্ষিণপন্থী দল হিসেবে পরিচিত জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। কৌশলগত কারণে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি নামে প্রতিষ্ঠিত ছাত্রদের এই দলটি ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’ দেয়ার ঘোষণা দিয়ে মধ্যপন্থী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে)। ভারতের প্রেসক্রিপশন ও আধিপত্যবাদী বিদেশী অপশক্তির (যুক্তরাষ্ট্রের ভাষায় জামায়াত ‘মর্ডারেট ইসলামী দল’) প্রেসক্রিপশনে আওয়ামী লীগকে আগামী সংসদে পুনর্বাসনে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের দাবি তুলছে। তারা নির্বাচন পেছানোর দাবিও জানাচ্ছে। এনসিপি ভারত ও হাসিনার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান দেখালেও ‘নির্বাচন পেছানো ইস্যু’ সমর্থন থাকায় তারাও জামায়াতের সঙ্গে সুর মিলিয়েছে। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনগুলোর ভোটের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের সংগঠন থাকলেও জনসমর্থন খুবই কম। জামায়াত কিছু আসন পেলেও ইসলামী আন্দোলনের তেমন কিছুই নেই। দেশের বিপুল সংখ্যা জনগোষ্ঠী মুসলমান হওয়ায় দল দু’টি কার্যত ইসলামী রাজনীতির নামে ধর্ম নিয়ে ব্যবসায় মেতে উঠেছে। ১৯৯৬ সালে নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা দক্ষিণপন্থী ভোটারদের ভোট পেতে যেভাবে মাথায় পট্টি বেঁধেছিল অনেকটা সেরকম। ইসলাম বিদ্বেষী হলেও শেখ হাসিনা কেবল মাদরাসার শিক্ষার্থী-শিক্ষক, ইসলামী ধারার অরাজনৈতিক সংগঠন, পেশাজীবী সংগঠন, পীর-মাশায়েখ, মাজার শরীফ, দরবার শরীফের পীর-মুরিদানের ভোট পেতেই ধর্মের ব্যবহার করেছেন। তিনি হেফাজতের মতো ইসলামী সংগঠনকে ছায়াতলে রেখেছিলেন কেবল ভোটের অংকের হিসাব করেই।
বিএনপি উদার গণতান্ত্রিক দল হলেও জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী রাজনৈতিক শক্তি। জাতীয় পার্টি একই ধারার দল হলেও গণধিকৃত দলটি এখন অর্ধমৃত। বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ’৭৮ সালে সব ধরনের চিন্তা চেতনার মানুষের সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন বিএনপিতে। বেগম খালেদা জিয়াও একই পথে হেঁটেছেন। এখন তারেক রহমানও এই চেতনায় বিশ্বাসী। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা যেমন আওয়ামী লীগের ‘ভোট ব্যাংক’ হিসেবে পরিচিত ছিল; তেমন পীর-মাশায়েখের মুরিদান, আলেম-ওলামা, মাদরাসার শিক্ষার্থী, ইসলামী চেতনায় বিশ্বাসী অরাজনৈতিক সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীসমর্থকরা বিএনপির ভোট ব্যাংক হিসেবে পরিচিত। জামায়াতসহ কয়েকটি ইসলামী ধারার রাজনৈতিক দল থাকলেও এই দক্ষিণপন্থী ভোটাররা বিএনপিকেই ভোট দিয়ে থাকে। স্বাধীনতার পর জিয়াউর রহমানের শাসনামল, বিচারপতি আবদুস সাত্তারের শাসনামল এবং বেগম খালেদা জিয়া তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন এই দক্ষিণপন্থী চেতনার ভোটারদের ভোটেই। তথাকথিত বামপন্থী এবং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ভোটারগণ কখনোই বিএনপিকে পছন্দ করে না; তারা সব সময় আওয়ামী লীগে ভোট দেয়। এই দক্ষিণপন্থী অরাজনৈতিক ডানপন্থী কোটি কোটি ভোটার মুখিয়ে রয়েছেন বিএনপিকে ভোট দেয়ার জন্য। জামায়াত ‘ইসলাম’ নামে রাজনীতি করলেও সাধারণ ভোটাররা ওই দলকে ভোট দেয় না। আর ইসলামী আন্দোলন নামের চরমোনাই পীরের দল বিগত হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে আওয়ামী লীগের ছাতার নীচে বেড়ে উঠেছে। ইসলামী ধারার এই দলটি মুখে ইসলামের কথা বললেও ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগের শাসনামলের প্রতিটি পাতানো নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। এমনকি ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ বিএনপিসহ কোনো দলের প্রার্থীকে নির্বাচনী প্রচারণা এবং পোষ্টার লাগাতে দেয়া হয়নি। কেবলমাত্র ইসলামী আন্দোলনের হাতপাখা পোষ্টার লাগানো হয়েছিল। শুধু কি তাই দু’আড়াই বছর আগে বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে হাতপাখা মার্কার প্রার্থীর পোষ্টারে ‘শেখ হাসিনা সমর্থিত প্রার্থী’ শব্দ জুড়ে দেয়া হয়েছিল। হাসিনা পালালেও দেশে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ আওয়ামী লীগের ভোটার রয়ে গেছে। সেই ভোটে আওয়ামী লীগকে আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদে আনার ভারতীয় নীল নকশা বাস্তবায়নে ইসলামী ধারার দল দু’টি যখন সংখ্যানুপাতির পদ্ধতি (পিআর) নির্বাচন দাবি করছে; তখন তৌহিদী জনতা তাদের থেকে আরো দূরে সরে যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত এই বাস্তবতা বুঝে আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে ঠেকাতে নানা কৌশল করছে। তাদের অনুগত গণমাধ্যম ও প্রচারণা সংস্থাগুলো বিএনপিকে ঠেকাতে ‘চাঁদাবাজী’ খবর ফলাও করে প্রচার করছে। আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ ও ইসলামী চেতনার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী ভোটারদের বিএনপি থেকে ছুটিয়ে জামায়াতের দিকে নেয়ার চেষ্টা করছে। এ অবস্থায় বিএনপির দায়িত্বশীল নেতাদের কথাবার্তায় আরো সতর্ক হওয়া উচিত। যুক্তরাষ্ট্র-ভারত এবং তাদের তাবেদার গণমাধ্যমগুলো যে ভাষায় ‘দক্ষিণপন্থী’ শব্দ ব্যবহার করে বাংলাদেশের আলেম-ওলামা-পীর-মাশায়েখ ও ইসলামী স্কলারদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে; মির্জা ফখরুলের বক্তব্যের সুর তেমনই। তিনি জামায়াত-ইসলামী আন্দোলনের নাম উল্লেখ না করেই দক্ষিণপন্থী দলগুলোর উত্থানে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। ইঙ্গো-মার্কিন শক্তি ইসলামী চেতনার বিশ্বাসী দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলোকে উগ্রপন্থী হিসেবে প্রচার করে। মির্জা ফখরুল কী তাদের সঙ্গে সুর মেলাচ্ছেন?
অবশ্য মির্জা ফখরুলের বক্তব্য প্রথম আলোয় প্রকাশ এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় বিতর্ক উঠার পর বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তারা কেউ মির্জা ফখরুলের এমন বক্তব্যে অবাক হননি। বিএনপি নেতারা বলেন, ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে বিএনপির রাজনীতি করলেও মির্জা ফখরুল ছাত্রজীবনের বাম রাজনীতির চেতনা থেকে সরে জাতীয়তাবাদী ইসলামী মূল্যবোধের চেতনায় মিশে যেতে পারেননি। তবে তিনি প্রথম আলোকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এক প্রশ্নের জবাবে ওই বক্তব্য দিয়েছেন। বিএনপির কোনো সভা-সমাবেশে তার এমন বক্তব্য দেয়ার সুযোগ নেই; তিনি সেটা দেনও না। ফলে মির্জা ফখরুলের ওই বক্তব্য বিএনপির নয়। তাছাড়া বিএনপিকে যে দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলো ভোট দেয় তারা অতীতে বেগম জিয়াকে ভোট দিয়েছে; আগামীতে বেগম জিয়া ও তারেক রহমানকেই ভোট দেবেন। তবে একজন নেতা জানালেন, মহাসচিবের তথাকথিত প্রগতিশীল চিন্তার কারণে ইসলামী ধারার দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে। মাঝখানে দূরত্ব কমানোর উদোগ নেয়া হলেও তা সফল হয়নি। আগামীতে এ দূরত্ব থাকবে না। তবে হাসিনার শাসনামলের ১৫ বছর জেল-জুলুম, নির্যাতন-হামলা-মামলা, খুন-গুমের শিকার হয়েও নেতাকর্মীরা বিএনপিকে ধরে রেখেছেন। ভারতের তাবেদার আওয়ামী লীগ ১৫ বছর বিএনপি ও দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলোকে তাদের শত্রু মনে করতো। এখন ইঙ্গো-মার্কিন শক্তি বিএনপির সঙ্গে দক্ষিণপন্থী শক্তি তথা আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখদের বিরোধ বাঁধানোর চেষ্টা করবে। বিএনপিকে তাদের ফাঁদে পা দেয়া যাবে না। দলের দায়িত্বশীল নেতাদের কথাবার্তায় আরো সতর্ক হতে হবে। প্রবাদে রয়েছে ‘বন্দুকের গুলি আর মুখের বুলি’ একবার বের হলে তা আর ফেরত আসে না।