Image description

জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনের জন্য মৌলিক সংস্কারের শর্ত দিলেও দলটি ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছে জোরেশোরে। ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি তুললেও সারাদেশে ২৯৬ আসনে প্রার্থী ঘোষণার পর করেছে ভোটকেন্দ্রভিত্তিক কমিটি। এসব কমিটির মাধ্যমে ভোটার তালিকা ধরে প্রচার ও জরিপ চালাচ্ছে। নির্বাচনী জোট কিংবা সমঝোতা করতে বিভিন্ন দলের সঙ্গে করছে বৈঠক। সংস্কার ও নির্বাচনে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’-এর দাবিতে অন্য দলগুলোকে এক করার চেষ্টা করছে।

নির্বাচনের সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিলেও জামায়াত নেতারা প্রকাশ্যে বলছেন, সংস্কার ও জুলাই হত্যার আগে ভোট আয়োজন করা যাবে না। অন্তর্বর্তী সরকার ও ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক বৈঠকেও তারা বলছেন, মৌলিক সংস্কার ছাড়া নির্বাচনে অংশ নেবেন না। দলের আমির ডা. শফিকুর রহমান গত এক সপ্তাহে একাধিকবার বলেছেন, অতীতের মতো পাতানো নির্বাচন মানবেন না। নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। 

ঐকমত্য কমিশন, এনসিপির মতো জামায়াতও মৌলিক সংস্কার বলতে বোঝাচ্ছে– পিআর পদ্ধতিতে সংসদের উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা, সাংবিধানিক নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা খর্ব করা ও সরকারপ্রধানের পদের মেয়াদ নির্ধারণ করা। প্রথম দুটি বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে বড় ধরনের মতপার্থক্য রয়েছে জামায়াতের। দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের সমকালকে বলেছেন, ‘অবশ্যই মৌলিক সংস্কার হতে হবে। এ ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না।’

সংস্কার ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সামনে
আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন স্থগিত হওয়ায় দলটি আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না ধরে বিএনপির প্রধান নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে জামায়াত। দলটি সেরা নির্বাচনী সাফল্য ১৮ আসন হলেও আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বিএনপিবিরোধী ভোটের জোরে আগামীতে তা বাড়বে বলে আশা করছে। 

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত বছরের ১৬ ডিসেম্বরে জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রথমবারের মতো জানান, ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। জামায়াত এ সময়সূচিকে সমর্থন করে। পরে দলটির আমির জানান, সংস্কার সাপেক্ষে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের আগেই নির্বাচন হওয়া উচিত। 

গত জুনে জাতির উদ্দেশে আরেক ভাষণে সরকারপ্রধান জানান, ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে। জামায়াত এ ঘোষণাকেও সমর্থন করে। তবে গত ১৩ জুন লন্ডনে ড. ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের পর সরকার ও বিএনপির যৌথ বিবৃতিতে জানানো হয়, সংস্কার ও বিচার সাপেক্ষে রমজানের আগে, অর্থাৎ আগামী বছরের মধ্য ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হতে পারে। সরকার ও বিএনপির যৌথ বিবৃতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে জামায়াত অভিযোগ তোলে, এর মাধ্যমে নিরপেক্ষতা হারিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। এর পর থেকে দলটি বলছে, আগামী নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার জামায়াত আমির বলেন, সংস্কার হলে আগামী বছরের প্রথমার্থেই নির্বাচন হতে পারে। 

গত ১৯ জুলাই রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জামায়াতের জাতীয় সমাবেশের সাত দফা দাবির প্রথমটিই ছিল লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড। জামায়াতের একজন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল সমকালকে বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছে– এমন ধারণায় দলটির প্রতি পুলিশ ও প্রশাসনের পক্ষপাত দেখা যাচ্ছে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে তৎকালীন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেভাবে ‘সেফ এক্সিট’ নিয়েছিল, এবারও তেমন কথা শোনা যাচ্ছে। এ পরিস্থিতি থাকলে ২০০৮ সালের মতোই আগামী নির্বাচনে বিএনপির পক্ষে অস্বাভাবিক ফল হতে পারে। তেমন নির্বাচনে অংশ নিয়ে জামায়াতের কী লাভ? শোনা যাচ্ছে, অধিকাংশ জেলার ডিসি, এসপি বিএনপির তালিকা থেকে এসেছে। আগে মাঠ প্রশাসন ঠিক করতে হবে।

গত মে মাসে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে শপথের দাবিতে যমুনা ঘেরাও করে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের আন্দোলন ও সরকারের তিন উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবির প্রেক্ষাপটে ড. ইউনূসের দায়িত্ব ছাড়ার চিন্তার গুঞ্জন ছড়ায়। সে সময় সরকারপ্রধানের পর ২৪ মে রাতে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গেও বৈঠক করেন জামায়াতের শীর্ষ নেতারা। সেখানেও তারা আগামী নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের নিশ্চয়তার দাবি জানান। গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকেও নির্বাচনের শান্তিপূর্ণ পরিবেশের নিশ্চয়তা চায় জামায়াত। বৈঠকে অংশ নেওয়া দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ সমকালকে বলেন, “প্রধান উপদেষ্টাও বলেছেন, ‘শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য শান্তিপূর্ণ পরিবেশ লাগবে।’ জামায়াতও তাই চায়।”

আনুপাতিক পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণসহ সংস্কারের যেসব প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হচ্ছে না– সে সময় কাছাকাছি আনতে চলতি মাসের শুরুতে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপির ‘গোপন বৈঠক’ হয় সরকারি মধ্যস্থতায়। সেখানে বিএনপি জানিয়ে দেয়, পিআর পদ্ধতির হলে উচ্চকক্ষের প্রয়োজন নেই। জামায়াত প্রতিনিধিরা জানান, মৌলিক সংস্কার ছাড়া তাদের পক্ষে নির্বাচনে যাওয়া কঠিন। 

পিআরের চাপ দিলেও আসনভিত্তিক প্রস্তুতি
রাজনৈতিক সূত্রের খবর, বিএনপিকে ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষ গঠনে রাজি করাতেই পুরো নির্বাচনই পিআরে আয়োজনের চাপ সৃষ্টি করেছে জামায়াত। চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন অবশ্য আগে থেকেই পিআর চায়। আনুপাতিক নির্বাচন না চাইলেও এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদ, এবি পার্টিও এ দাবিকে সমর্থন দিচ্ছে। জামায়াত সূত্রের খবর, বিএনপি উচ্চকক্ষে পিআর মেনে নিলে, জামায়াত নিম্নকক্ষে পিআরের দাবি ত্যাগ করবে।

এ কারণেই দল আসনভিত্তিক নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ডা. তাহের সমকালকে বলেছেন, জামায়াতে হঠাৎ করে কাউকে দলে ভিড়িয়ে প্রার্থী করা হয় না। অনেক আগে থেকেই প্রার্থী ঠিক করা থাকে। এবারও তাই করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে মনোনীত প্রার্থীরা তৃণমূলে কাজ করছেন। 

জামায়াত পিআর চাইলেও আসনভিত্তিক প্রার্থী কেন দিচ্ছে? পিআরের দাবি কী শুধুই চাপ সৃষ্টি করতে? এসব প্রশ্নে ডা. তাহের বলেন, যে পদ্ধতিতেই নির্বাচন হোক, জামায়াত প্রস্তুতি রাখছে। অন্য যেসব দল পিআর চায়, তারা প্রার্থী চায়। মূল কথা হচ্ছে, জামায়াত নির্বাচনের বিরুদ্ধে নয়, বরং নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত।

জামায়াতের সাংগঠনিক অঞ্চলের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করা একাধিক নেতা সমকালকে বলেন, রংপুর বিভাগের ৩৩, রাজশাহী বিভাগের ১২, খুলনা বিভাগের ৩৬, চট্টগ্রাম বিভাগের ১১, বরিশাল বিভাগের চার, সিলেট বিভাগের তিন এবং ঢাকা বিভাগের কয়েকটি আসনে বিএনপির বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার সামর্থ্য রয়েছে জামায়াতের। তবে সব আসনেই ২০ থেকে ৫০ সদস্যের ভোটকেন্দ্রভিত্তিক কমিটি করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা ভোটারভিত্তিক প্রচার চালাচ্ছেন।

নির্বাচনী বন্ধুর খোঁজ
১৯৯৬ সালে শেষবারের মতো ৩০০ আসনে প্রার্থী দিয়েছিল জামায়াত। সেবার দলটির ভরাডুবি হয়। ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ ভোট এবং তিনটি আসন পেয়েছিল। এবার দলটি ২৯৬ আসনের প্রার্থী ঘোষণা করলেও নির্বাচনী মিত্রের সন্ধানে রয়েছে জামায়াত। পিআরের সমর্থক দলগুলোকে নিয়ে গত বুধবারও বৈঠক করেছে জামায়াত। 
ইসলামী আন্দোলন আগেই ঘোষণা দিয়েছে, ইসলামপন্থি দলগুলোকে নিয়ে নির্বাচনী সমঝোতা করবে। হেফাজতে ইসলামসংশ্লিষ্ট কওমি ঘরানার দলগুলো রয়েছে এ সমঝোতায়। খেলাফত মজলিসের দুই অংশ ও নেজামে ইসলাম পার্টি গতকাল শুক্রবারও বৈঠক করেছে ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে। 

ইসলামপন্থিদের ভোট ‘এক বাক্সে আনার’ এ উদ্যোগে জামায়াতও যুক্ত হতে পারে। এ দলগুলো গত ১৯ জুলাই জামায়াতের সমাবেশে যোগ দেয়। গণঅধিকার পরিষদসহ আরও কয়েকটি দলকে যুক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে জামায়াত। শেখ হাসিনার পতন ঘটানো অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের গঠিত এনসিপির সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতার প্রচেষ্টা রয়েছে।

জামায়াতের এক জ্যেষ্ঠ নেতা সমকালকে বলেন, জোট নয়, আসন সমঝোতার প্রচেষ্টা রয়েছে। বিএনপিতে মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা অনেক বেশি। তাই দলটির পক্ষে আসন ছাড়া খুব কঠিন। বৃহত্তর সমঝোতা হলে জামায়াতের পক্ষে ২০০ আসন ছাড়াও কঠিন নয়। জামায়াতের ঘোষিত প্রার্থীদের আগেই বলে দেওয়া হয়েছে, দল অন্য কাউকে আসন ছেড়ে দিলে নির্বাচন থেকে সরে যেতে হবে।