
এক ঐতিহাসিক রায়ে কাঠমান্ডু জেলা আদালত ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসকে নির্দেশ দিয়েছে, ২০১৮ সালের মার্চে নেপালের কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের সময় ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় নিহত যাত্রীদের পরিবারকে সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ওই দুর্ঘটনায় ইউএস-বাংলা ফ্লাইট ২১১-এ থাকা ৭১ আরোহীর মধ্যে ৫১ জন নিহত হন।
নেপালের সংবাদমাধ্যম কাঠমান্ডু পোস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, বিমা কোম্পানি থেকে প্রতি পরিবারকে ২০ হাজার ডলার করে যেসব ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর বাইরে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসকে মোট ২৭ লাখ ৪০ হাজার মার্কিন ডলার (নেপালি মুদ্রায় যা প্রায় ৩৭ কোটি ৮৬ লাখ রুপি) পরিশোধ করতে হবে। এই অর্থ ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেওয়া হবে দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ১৭টি পরিবারকে।
তবে, নেপালের আদালতে এমন কোনো রায় আদৌ প্রদান করা হইয়েছে কি-না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত নয় এয়ারলাইনসটি।
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস জানিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে একটি আদালতের রায় হয়েছে বলে যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, সে বিষয়ে তারা এয়ারলাইন্স এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক বা আদালতের রায় সংক্রান্ত তথ্য পায়নি।
তারা জানিয়েছে, 'আমাদের লিগ্যাল টিম বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিষয়টি যাচাই করছে। যদি এমন কোনো রায় থেকে থাকে, তা আইনগতভাবে বিশ্লেষণ করে যথাযথ সময়ে গণমাধ্যম ও সংশ্লিষ্ট মহলকে জানানো হবে।'
আদালতের কোনো নিশ্চিত তথ্য বা রায়ের অনুলিপি ছাড়া আন্তর্জাতিক কোন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রচার থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়েছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স।
এর আগে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের পক্ষে মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ মো. কামরুল ইসলাম এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানান, 'সম্প্রতি নেপালের কোনো আদালতে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বিরূদ্ধে কোনো ধরনের রায় প্রদান করে নাই। কাঠমান্ডু পোস্টের এ ধরনের প্রতিবেদন সম্পূর্ণ মিথ্যা ও কল্পনা প্রসূত।'
কাঠমান্ডু পোস্টের প্রতিবেদন বলা হয়, নেপালের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবার এভাবে বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরণ আদায় করতে সক্ষম হলো। দেশটিতে গত সাত দশকে ৭০টি বিমান দুর্ঘটনায় মোট ৯৬৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন, যার বেশিরভাগের পেছনে ছিল গুরুতর অবহেলা।
তবুও এর আগে কোনো বিমান সংস্থাকে এইভাবে দায়ী করে ক্ষতিপূরণ আদায়ের নজির ছিল না—কাঠমান্ডু জেলা আদালতের এই রায় সেই প্রেক্ষাপট পাল্টে দিয়েছে।
তবে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস চাইলে এখনো উচ্চ আদালত ও সুপ্রিম কোর্টে আপিল করতে পারবে। তারপরও রোববার দেওয়া এই রায়কে এক গুরুত্বপূর্ণ নজির হিসেবে দেখা হচ্ছে। আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে কোনো বিমান সংস্থা যদি ইচ্ছাকৃত অবহেলা বা মারাত্মক গাফিলতির মাধ্যমে দুর্ঘটনার কারণ হয়, তাহলে যাত্রী বা তাদের পরিবার আদালতের শরণাপন্ন হয়ে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারবেন। এমনকি সীমাহীন অঙ্কের ক্ষতিপূরণ চাওয়ারও সুযোগ থাকবে।
সংবাদমাধ্যমটির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কাঠমান্ডু জেলা আদালতের তথ্য কর্মকর্তা দীপক কুমার শ্রেষ্ঠ জানান, রায়ের পূর্ণাঙ্গ লিখিত অনুলিপি পেতে কিছুটা সময় লাগবে।
এই মামলার বিচারক ছিলেন দিবাকর ভট্ট। নিহত ১৬ যাত্রীর পরিবার ও একজন জীবিত যাত্রীর পক্ষে এই মামলা দায়ের করা হয়েছিল।
২০১৮ সালের ১২ মার্চ ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের পর ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের নির্ধারিত ফ্লাইটটি কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের সময় ভুল পথে চলে যায়। অবতরণের সময় ৭৬ আসনের বোম্বার্ডিয়ার ড্যাশ ৮ কিউ৪০০ উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয়ে আগুন ধরে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই ৫১ জন প্রাণ হারান। নিহতদের মধ্যে ২২ জন ছিলেন নেপালের নাগরিক, ২৮ জন বাংলাদেশি এবং একজন চীনা নাগরিক।
এটি এখন পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশি এয়ারলাইন্সের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। একইসঙ্গে বোম্বার্ডিয়ার ড্যাশ ৮ কিউ৪০০ মডেলের উড়োজাহাজের ইতিহাসেও এটি সবচেয়ে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচিত।
সাত বছর ধরে চলা মামলার রায়ে আদালত জানিয়েছে, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স একটি উড্ডয়নের উপযুক্ত বিমান পরিচালনায় ব্যর্থ হয়ে 'গুরুতর গাফিলতি' করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আদালতের নথি অনুযায়ী, এমবিবিএসের সাত শিক্ষার্থী—আশনা শাক্য, আঞ্জিলা শ্রেষ্ঠ, মিলি মহার্জন, নিগা মহার্জন, প্রিন্সি ধামি, সঞ্জয় মহার্জন ও শ্রেয়া ঝাঁ—তাদের প্রত্যেকের পরিবারকে ১ লাখ ৭০ হাজার ৩৮২ ডলার (প্রায় ২ কোটি ৩৪ লাখ রুপি) করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
২০১৯ সালের ৩১ জুলাই এসব পরিবার 'অবহেলার কারণে মৃত্যু'র অভিযোগে মামলা করেন এবং সীমাহীন ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। এই ক্ষতিপূরণের বাইরে প্রত্যেক পরিবার ২০ হাজার ডলার করে বিমা অর্থও পাওয়ার কথা রয়েছে।
একই রায়ে এমবিবিএসের আরও ছয় শিক্ষার্থী—শ্বেতা থাপা, সঞ্জয় পোড়েল, পূর্ণিমা লোহানি, আঞ্জিলা বরাল, চারু বরাল ও সরুনা শ্রেষ্ঠা—তাদের পরিবারও বিমার অর্থ বাদে ১ লাখ ৭৯ হাজার ৪১৮ ডলার (প্রায় ২ কোটি ৪৭ লাখ রুপি) করে ক্ষতিপূরণ পাবেন।
এ ছাড়া, হিমালয় এয়ারলাইন্সের কর্মী প্রসন্ন পাণ্ডের পরিবারকে ১ লাখ ৭ হাজার ১৭০ ডলার (প্রায় ১ কোটি ৪৭ লাখ রুপি), নিউরোসার্জন ডা. বল কৃষ্ণ থাপার পরিবারকে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫৪৮ ডলার (প্রায় ৩ কোটি ৬৭ লাখ রুপি) এবং ৬৭ বছর বয়সী নার্স জিয়ানি কুমারী গুরুঙ্গের পরিবারকে ৪৫ হাজার ৩০১ ডলার (প্রায় ৬২ লাখ রুপি) ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
গুরুতর আহত হয়েও বেঁচে যাওয়া যাত্রী ডা. সামিরা ব্যঞ্জনকরের জন্য ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৪ হাজার ২৯০ ডলার (প্রায় ৬১ লাখ রুপি)।
প্রসঙ্গত, এসব ক্ষতিপূরণের সঙ্গে ২০ হাজার ডলারের সাধারণ বিমা অর্থ অন্তর্ভুক্ত নয়।
কাঠমান্ডু পোস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুর্ঘটনার সময় ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বিমা কভারেজ ছিল মোট ১০ কোটি ৭ লাখ ডলার। এর মধ্যে বিমানটির বিমা ছিল ৭০ লাখ ডলার এবং যাত্রীদের জন্য কভারেজ ছিল ১০ কোটি ডলার, যা বহন করেছিল সেনা কল্যাণ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি ও সাধারণ বীমা করপোরেশন।
শুরুর দিকে অনেক পরিবার ৫০ হাজার ডলারের ক্ষতিপূরণ নিয়ে মামলা না করেই বিষয়টি মীমাংসার পথে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু পরে তারা সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আদালতের শরণাপন্ন হন, ন্যায্য ও পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের আশায়।
আদালতের কর্মকর্তারা জানান, দুর্ঘটনার তদন্তে আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার 'অ্যানেেক্স ১৩'-এর ভিত্তিতে তৈরি প্রতিবেদনগুলো আইনগত দায় নির্ধারণে ব্যবহারের উপযোগী নয় এবং আদালতে সেগুলোকে কেবল প্রাথমিক প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে না। তবে আদালত ক্ষতিপূরণের পরিমাণ কীভাবে নির্ধারণ করেছে এবং দোষ কার ছিল—পূর্ণাঙ্গ রায়ে তার ব্যাখ্যা থাকবে।
কাঠমান্ডু পোস্টের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আর্থিক, শারীরিক, মানবিক ও মানসিক দিক বিবেচনায় ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করেছে আদালত। রায়ে বলা হয়েছে, বিমানটি উড়ার উপযোগী থাকলেও পাইলটের মানসিক অবস্থার প্রশ্ন এবং বিমান সংস্থার চরম গাফিলতির কারণেই এই দুর্ঘটনা ঘটে।
এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ১৯২৯ সালের ওয়ারশ কনভেনশন ও ১৯৫৫ সালের হেগ প্রটোকলের ভিত্তিতে, যা আন্তর্জাতিক যাত্রায় বিমান সংস্থাগুলোর দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করে। তবে এই রায়ে ১৯৯৯ সালের মন্ট্রিয়াল কনভেনশন প্রযোজ্য হয়নি, কারণ দুর্ঘটনার সময় নেপাল ও বাংলাদেশ—উভয় দেশই এই চুক্তির সদস্য ছিল না।
মন্ট্রিয়াল কনভেনশন ২০০৩ সালে কার্যকর হয়। ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এই চুক্তির আওতায় মৃত্যু বা আঘাতজনিত ক্ষতিপূরণের সীমা বাড়িয়ে ১ লাখ ২৮ হাজার ৮২১ থেকে ১ লাখ ৫১ হাজার ৮৮০ স্পেশাল ড্রইং রাইটস (এসডিআর) করা হয়েছে, যা প্রায় ২ লাখ ১৬ হাজার মার্কিন ডলারের সমান। ২০০৩ সালে এই সীমা ছিল ১ লাখ এসডিআর, প্রায় ১ লাখ ৪২ হাজার ডলার।
দীর্ঘ সাত বছরের আইনি লড়াই শেষে অবশেষে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো রায় পেলেও এই প্রক্রিয়া ছিল অত্যন্ত কষ্টকর ও মানসিকভাবে বিপর্যয়কর।
এমবিবিএস শিক্ষার্থী আঞ্জিলা শ্রেষ্ঠর বাবা বিধুর মান শ্রেষ্ঠ বলেন, 'সাত বছর পর আমরা রায় পেলাম। সন্তান হারানোর পর তার ন্যায্য অধিকার আদায়ে লড়াই করতে হওয়াটা খুব কষ্টের।' তিনি ২৭ লাখ ডলারের ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিলেন। বলেন, শুরুতে বিমান সংস্থা মাত্র ৫০ হাজার ডলার দিতে চেয়েছিল।
তিনি আরও বলেন, 'আমরা ক্ষতিপূরণে এখনো সন্তুষ্ট নই। কিন্তু অন্তত মামলায় জিতেছি, বিচার পেয়েছি।'
সাতজন শিক্ষার্থীর পরিবারের পক্ষে প্রথম মামলা করেন আইনজীবী অমৃত খারেল। তিনি বলেন, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স বিমার অর্থকেই পূর্ণ ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেখিয়ে পরিবারগুলোকে বিভ্রান্ত করেছিল।
প্রতিবেদন অনুযায়ী আইনজীবী খারেল বলেন, 'বাস্তবে যাত্রীরা যখন টিকিট কেনেন, তখনই তার মধ্যে বিমার (ইনস্যুরেন্স) অর্থ অন্তর্ভুক্ত থাকে। আলাদাভাবে বিমান কোম্পানিকে এটি দিতে হয় না।'
তিনি আরও বলেন, 'বিমা ও ক্ষতিপূরণ—এ দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। যদি প্রমাণ হয় দুর্ঘটনা অবহেলা বা ভুলের কারণে ঘটেছে, তখন শুধু বিমার টাকা যথেষ্ট নয়। তখন ক্ষতিপূরণ জরুরি হয়ে পড়ে। এটাই ন্যায়ের প্রকৃত রূপ।'
খারেল বলেন, 'এই মামলায় বিমান কোম্পানির বড় ধরনের গাফিলতি ছিল। সে কারণে তাদের পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়েছে। এটি নেপালের ইতিহাসে প্রথম ঘটনা, যেখানে যাত্রীরা ন্যায্য ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। এটা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার এক বড় জয়।'
তিনি এই রায়কে 'ঐতিহাসিক' হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, 'এই রায়ের মাধ্যমে গোটা বিশ্ব জানতে পারল—নেপালেও এ ধরনের দুর্ঘটনায় আইনি সহায়তা পাওয়া সম্ভব।'
আদালতের কর্মকর্তারাও জানিয়েছেন, এই রায়ের পর থেকে বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবার নেপালে এখন 'সীমাহীন ক্ষতিপূরণ' দাবি করতে পারবেন—যা এর আগে শোনা যায়নি।
তারা আরও বলেন, বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরণের ঝুঁকি থাকলে বিমান সংস্থাগুলো নিরাপত্তা বিধান আরও কঠোরভাবে মানবে, কর্মীদের আরও দক্ষ করে গড়ে তুলবে এবং বিমান পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণেও অধিক গুরুত্ব দেবে।