
চিত্রকর এসএম সুলতান, কবিয়াল বিজয় সরকার এবং জারি গানের সম্রাট মোসলেম উদ্দিনের জন্মধন্য জেলা নড়াইল। সবুজ-শ্যামল ছায়াঘেরা এ জেলার অবস্থান দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে। মাত্র তিনটি উপজেলা নিয়ে গঠিত ছোট এ জেলায় সংসদীয় আসন দুটি। এ দুটি আসনে বিজয়ের স্বাদ খুব বেশি পায়নি বিএনপি। হিন্দু অধ্যুষিত এ জেলার আসনগুলো দেশ স্বাধীনের পর থেকে অধিকাংশ সময় আওয়ামী লীগের দখলেই ছিল। ১২টি নির্বাচনের মধ্যে সাতটিতেই আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। এখানে বিএনপি বরাবরই ছিল দ্বিতীয় অবস্থানে।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর নড়াইলের সংসদীয় আসনগুলোয় বিএনপি-জামায়াতের ভালো সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এখানে আওয়ামী ভোটগুলো ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবে। তবে বড় দল হিসেবে এগিয়ে রয়েছে বিএনপি। যদিও নড়াইল-১ আসনে দলীয় কোন্দলে বেকায়দায় রয়েছে দলটি। নড়াইল-২ আসন জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের শরিক এনপিপি চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদকে ছেড়ে দেওয়া হতে পারে বলে জানা গেছে। এদিকে বিজয় ছিনিয়ে আনতে মরিয়া জামায়াতে ইসলামী। দলটি এগোচ্ছে পরিকল্পিতভাবে। অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) দল গোছাতে ব্যস্ত সময় পার করছে।
নড়াইল-১
নড়াইল-১ আসন জেলার কালিয়া উপজেলা, কালোড়া ইউনিয়ন, বিচালি ইউনিয়ন, ভদ্রবিলা ইউনিয়ন, সিঙ্গাশোপুর ইউনিয়ন ও শেখহাটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। কালিয়া উপজেলা ও পৌর বিএনপির কমিটি নিয়ে কোন্দল রয়েছে। জেলা বিএনপির সভাপতি বিশ্বাস জাহাঙ্গীর আলম বিবদমান দুপক্ষের একদিকের নেতৃত্বে রয়েছেন। তিনি এ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী। এই পক্ষে আরো আছেন—উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক স ম ওহিদুজ্জমান মিলু, পৌর বিএনপির সভাপতি শেখ সেলিম হোসেন ও তাদের অনুসারীরা। জাহাঙ্গীর আলম তিন দশকের বেশি সময় নড়াইল জেলা বিএনপির হাল ধরে আছেন। তিনি ১৯৯৬, ২০০৯ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে প্রার্থী হলেও জয় পাননি।
বিপরীতে রয়েছেন উপজেলা বিএনপির সভাপতি সরদার আনোয়ার হোসেন, পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সেলিম রেজা ইউসুফের নেৃতত্বে দলের একাংশ। তাদের পক্ষ নেন জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি জুলফিকার আলী, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বিএনপি নেতা আব্দুল লতিফ সম্রাট, টেক্সাস স্টেট বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম জহির, জিয়াউর রহমান ফউন্ডেশনের উপদেষ্টা আহম্মেদ শফিকুল হায়দার, বিএনপি নেতা বিএম নাগিব হোসেন, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান কল্যাণ ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সুকেশ সাহা আনন্দ, জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি সাজ্জাদুর রহমান সুজা। এতে বিভক্তি চরম আকার ধারণ করে। উল্লিখিত সবাই আগামী নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী।
এ অবস্থায় দুপক্ষ নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করতে পাল্টাপাল্টি সভা-সমাবেশ ও শোডাউনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে চলছে বিষোদ্গার। এতে এখানকার দলীয় সাধারণ কর্মী-সমর্থক ও স্থানীয়দের মাঝে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ব্যক্তিস্বার্থে নেতাদের এমন কাদা ছোড়াছুড়ি ভালো চোখে দেখছেন না এলাকাবাসী। এমন বাস্তবতায় অনেকে বিএনপির বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে, যা আগামী ভোটের মাঠে প্রভাব ফেলতে পারে। যদিও এ আসনের আওয়ামী ভোট জয়-পরাজয় নির্ধারণে বড় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করবে।
জহিরুল ইসলাম আমার দেশকে বলেন, যে সময় পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের অব্যাহত দেশবিরোধী নানা ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আমাদের কথা বলার কথা, ঠিক সে সময়টিতে নেতাদের বিতর্কিত কার্যকলাপ নিয়ে সভা-সমাবেশ ও সমালোচনায় সরব থাকতে হচ্ছে। এটি দুঃখজনক।
বিশ্বাস জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আওয়ামী আমলে হামলা-মামলা উপেক্ষা করে কর্মীদের পাশে থেকে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছি। গত তিন দশক ধরে দলে আমার ত্যাগের মূল্যায়ন পাব বলে আমি জোর আশাবাদী। মনোনয়ন পেলে ধানের শীষের বিজয় হবে।
বিপরীতে বিজয় ছিনিয়ে আনতে বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। এ আসনে দলের জেলা সেক্রেটারি ওবায়দুল্লাহ কায়সারকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বিগত দিনে স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার না থাকায় সাধারণ মানুষ অনেকক্ষেত্রে নৌকার পক্ষে যেতে বাধ্য হয়। বর্তমানে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে ভালোমন্দ বিচার-বিশ্লেষণের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় জামায়াতে ইসলামী মানুষের ভাবনায় স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে। এমন বাস্তবতায় মানুষ আমাকে জয়ী করবে বলে আমি আশাবদী।
তরুণদের নেতৃত্বে গড়া রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি নড়াইলে দল গোছাতে তৎপর হয়ে উঠেছে। পদযাত্রা কর্মসূচির অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে দলটির নেতারা নড়াইল সফর করেছেন। এ আসনে জেলা সমন্বয়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাব্বির আহম্মেদ ও জেলার মুখমাত্র এসএম সাইফুজ্জমান মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে।
এসএম সাইফুজ্জমান বলেন, এনসিপি নড়াইল জেলায় দল গোছানোর চেষ্টা করছে। দ্রুত সবগুলো কমিটি দিয়ে আমরা মাঠে নামব।

নড়াইল-২
আসনটি নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলা এবং সদর উপজেলা (৫টি ইউনিয়ন ব্যতীত) নিয়ে গঠিত। এ আসনে মনোয়নপ্রত্যাশীরা বিরামহীন প্রচার চালাচ্ছেন। এ আসনে এখন পর্যন্ত বিএনপির অর্ধডজন মনোনয়নপ্রত্যাশীর নাম শোনা যাচ্ছে। তালিকায় রয়েছেন—জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম, সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুব মুর্শেদ (জাপল), সাবেক সহসভাপতি এম জাকারিয়া, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আলী হাসান, সাংগঠনিক সম্পাদক শাহরিয়ার রিজভী জর্জ এবং মেজর (অব.) কাজী মঞ্জুরুল ইসলাম প্রিন্স।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভাটের মাঠে বিএনপি সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের শরিক এনপিপি চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদকে এ আসন ছেড়ে দেওয়া হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে। এতে দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা হতাশ, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে ভোটে।
বিগত দিনে কাস্ট হওয়া ভোটের হিসাবমতে, এখানে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর ভোট প্রায় সমান। এ অবস্থায় এবার আওয়ামী ভোট যারা টানতে পারবে তাদের বিজয় সুনিশ্চিত। এমন বাস্তবতায় জামায়াতে ইসলামী এ আসনে চমক দেখাতে পারে।
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম বলেন, বিগত ১৫ বছর জেল-জুলুম ও নির্যাতন উপেক্ষা করে মাঠে-ময়দানে থেকে দলের নেতৃত্ব দিয়েছি। কখোনো পিছু হটিনি। আশা করি দল থেকে অবশ্যই এর মূল্যায়ন পাব।
ফরিদুজ্জমান ফরহাদ বলেন, স্বৈরাচারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গে মাঠে-ময়দানে থেকে হামলা-মামলার শিকার হয়েছি। মামলার শিকার স্থানীয় নেতাকর্মীদের পাশে থেকে উচ্চ আদলত থেকে তাদের জামিনে মুক্ত করতে সার্বিক সহায়তা করেছি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জোটের মনোনয়ন পেয়ে নড়াইল-২ আসনে নির্বাচন করতে গিয়ে ব্যাপক হামলা ও নির্যাতনের শিকার হই। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে আমার দলের কঠোর অবস্থানসহ সার্বিক বিবেচনায় এবারও আমি নড়াইল-২ আসনে জোটের মনোনয়ন পাব বলে আশাবাদী।
জামায়াতে ইসলামী এ আসনে জেলা আমির আতাউর রহমান বাচ্চুকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছে। তিনি এলাকায় ব্যাপক গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, দলের পক্ষ থেকে বিভিন্ন জনহিতকর কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে শহর-গ্রাম ও পাড়া-মহল্লায়। জামায়াতে ইসলামীর ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা জনসাধারণের মাঝে তুলে ধরতে আসনটির প্রত্যন্ত এলাকায় দিনরাত সভা-সমাবেশ ও প্রচার চলমান রয়েছে। ভোটারদের সাড়া পেয়ে আমি সন্তুষ্ট। সামগ্রিক বিবেচনায় এবারের ভোটে কাঙ্ক্ষিত ফল মিলবে ইনশাল্লাহ।
জাতীয় নাগরিক পার্টি এ আসনে এখনো প্রার্থী দেয়নি। তবে এনসিপির নড়াইল জেলার যুগ্ম সমন্বয়ক শরিফুল ইসলাম ও যুবশক্তির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সদস্য সচিব মাহমুদা সুলতানা রিমির মধ্যে যে কেউ প্রার্থী হতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে।