Image description

শিক্ষা উপদেষ্টার পদত্যাগসহ বিভিন্ন দাবিতে সচিবালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেছেন রাজধানীর বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) এ আন্দোলনের সময় জাকির মাহমুদ হাসান নামে একজনকে পিটিয়ে আটক করে নিয়ে যেতে দেখা যায় পুলিশের। তাকে ছাত্রলীগ নেতা দাবি করে তার কাছে বোমা পাওয়া গেছে বলেও প্রচার চালানো হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তবে তার বিরুদ্ধে মিডিয়া ট্রায়াল চলছে বলে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে অভিযোগ করেছেন তিনি। 

ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে জাকিরকে ছাত্রলীগ নেতা দাবি করা হলেও তার রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। ছাত্রলীগের পাশাপাশি ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের নেতাদের সঙ্গে তার ছবি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের হাতে এসেছে। তার ফেসবুক প্রোফাইলেও এসব ছবি রয়েছে। ছাত্র অধিকার পরিষদের এক শীর্ষ নেতাও তাকে নিয়ে পোস্ট। জাকির সক্রিয় ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়ও। সে সময় ছররা গুলি তার শরীরে বিদ্ধ হয়।

যদিও তার কাছে কোনও বোমা পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ। পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলম বলেন, ‘সচিবালয় থেকে সন্দেহজনক অনেককেই আটক করা হয়েছে। পরবর্তীতে পরিচয় শনাক্ত করে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।’

বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জাকির মাহমুদ হাসান। তার ছাত্রদলের অনেক নেতার ভালো সম্পর্ক রয়েছে। কলেজের ছাত্রদল নেতারাই এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। পাশাপাশি শিবির ও ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গেও তার ছবি রয়েছে। যদিও জাকির দাবি করছেন, সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকলেও তিনি কোনও সংগঠনের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয় নন।

ঢাকা মহানগর পূর্ব ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল হান্নান মজুমদারের সঙ্গে একক শোডাউনে জাকির মাহমুদ হাসান

একটি ছবিতে দেখা যায়, ঢাকা মহানগর পূর্ব ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল হান্নান মজুমদারের সঙ্গে একক শোডাউনে রয়েছেন জাকির। আরেকটি ছবিতে হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের শিক্ষার্থী রোহানসহ কয়েকজনের সঙ্গে তাজে পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। রোহান আগে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও কমিটি না হওয়ায় পদ পাননি বলে জানিয়েছেন কলেজের একাধিক শিক্ষার্থী। ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবু সাদিক কায়েমের সঙ্গেও তার ছবি পাওয়া গেছে।

এদিকে ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি তসলিম হাসান অভি ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘জাকির মাহমুদ হাসান আমার খুব কাছের ছোট ভাই এবং যথেষ্ট প্রতিবাদী ও দেশপ্রেমিক ছেলে! গতকাল যে হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করার পরেও এইচএসসি পরীক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানানোর ক্ষেত্রে দায়িত্বে অবহেলার কারণে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভের তৈরি হয়!’

আবু সাদিক কায়েমের সঙ্গে জাকির মাহমুদ হাসান

তিনি বলেন, ‘সেই ক্ষোভ প্রকাশের ক্ষেত্রে কতটুকু উচিত ছিল এবং কতটুকু উচিত হয়নি সেটা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হতে পারে। কিন্তু জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যে ছেলেটা গুলি খেয়েছে, বহুবার মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে, সেই ছেলেটাকে ছাত্রলীগ ট্যাগ দেওয়ার মতো দুঃসাহস দেখাচ্ছে, যারা তারাই মূলত আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সচিব সিদ্দিক জুবায়ের, উপসচিব শাম্মী আক্তারসহ অন্যান্য ফ্যাসিবাদের স্পষ্ট দোসর!’

হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের এক শীর্ষ ছাত্রদল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জাকির ছাত্রদলের নেতাদের সঙ্গে বেশ সক্রিয়। আবার ছাত্রলীগ, শিবির, ছাত্র অধিকার পরিষদ, বৈষম্যবিরোধীদের সঙ্গেও আছে। সে যেই সংগঠনই করুক, সেটা প্রকাশ্যে করুক। এভাবে সবার সঙ্গে চলার বিষয়টি রহস্যজনক। 

আগে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা রোহানের সঙ্গে জাকির মাহমুদ হাসান

ঘটনার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে জাকির ফেসবুকে একটি দীর্ঘ স্ট্যাটাস দিয়েছেন। এতে মিডিয়া ট্রায়ালের অভিযোগ তুলে তিনি লিখেছেন, ‘আজকের ঘটনা এবং মিডিয়া ট্রায়াল! আজকে যে ঘটনা হয়েছে তার অনেক আলোচনা সমালোচনা থাকতেই পারে। প্রথমত,আজকে আমি গিয়েছিলাম, আমার এইচএসসি পরীক্ষার্থী দুইটা ছোট ভাই। তারা দুজন আহত এবং রক্তাক্ত ছিল। তখন পুলিশ আক্রমন করছিল। আমি হাত মেলে ধরে গিয়েছিলাম, পুলিশ এর সঙ্গে কথা বলতে এই পরিস্থিতি নিয়ে।’

তারা রাস্তায় ফেলে মারধর করে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি এসবের বাইরে গিয়ে সবচেয়ে কষ্ট পেয়েছি, যখন দেখেছি আমি মিডিয়া ট্রায়াল এর শিকার। নিউজ করা হয়েছে আমার কাছে নাকি বোমা পাওয়া গিয়েছে! দেখলাম ছাত্রলীগ ট্যাগ দেয়া হয়েছে অনেক পেজ থেকে ভিডিও বানিয়ে। একটা সময় ছিল যখন এমন মিডিয়া ট্রায়াল এর মাধ্যমে অনেক নিরপরাধ মানুষকে অপরাধি বানিয়ে দেয়া হয়েছে।’

২৪ এর গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়েও এমনটা হয়ে আসছে, যা দুঃখজনক উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তখন বলা হতো শিবির জবাই জায়েজ। এখন এমনটাই হচ্ছে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে সাংবাদিকদের নৈতিকতা নিয়ে। আসলে এদের কাজ কি ভাইরাল নিউজ বানানো নাকি সত্য সংবাদ তুলে ধরা। শুধু আমার সাথে হয়েছে বিষয়টা এমন না। আরও অনেকের সাথেই হচ্ছে, যার কারণে একটা মানুষের সাধারন জীবন ব্যাহত করে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি গত বছর জুলাই এ ছাত্র জনতার আন্দোলনে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলাম। আমার সারা শরীরে ঠিক কতগুলো ছোট পুতি টাইপ গুলি লেগেছে, তা আমি নিজেও জানি না। আমার চোখের একটু উপরেও লেগেছিল। ভাগ্য ভালো ছিলো না হয় আজ হয়তো চোখে দেখতে পারতাম না। আজকে যখন দেখছি লীগ ট্যাগ দেয়া হচ্ছে! আমাকে নিয়ে নানান ধরনের বানোয়াট কথা বলা হচ্ছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক।’

এসবের নিন্দা জানিয়ে জাকির বলেন, ‘মিডিয়া অনেক সময় সত্য না জেনে যে কাউকে অপরাধী বানিয়ে দেয়। আর এই অপসাংবাদিকতায় আপনি ভাইরাল হলে আপনার সত্য আপনার আদর্শ সব ধুয়ে মুছে যাবে। আপনি হবেন একটা পোস্ট, একটা হেডলাইন। এখনো অনেক গনমাধ্যম সত্যের চেয়ে ভিউ, রিচ, আর ভাইরালিটির পেছনে ছুটে বেড়ায়! একটা ক্লিকবাইট হেডলাইন দেয় আর আপনাকে অপরাধী বানিয়ে দেবে। মানুষের মূল্য নেই,মূল্য আছে শুধুমাত্র শিরোনামের!’

তিনি বলেন, ‘আমি শুধুমাত্র আমার রক্তাক্ত দুই ভাইকে বাঁচাতে এবং তারপর পুলিশকে অনুরোধ করতে গিয়েছিলাম, যেন তারা এভাবে আক্রমণাত্মক না হয়। আর মিডিয়া প্রচার করল ভিন্নভাবে। মিডিয়ার কাজ সত্য প্রচার করা। মিথ্যা সংবাদ দিয়ে বিভ্রান্ত করা নয়!’

বুধবার (২৩ জুলাই) দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে আলাপকালে জাকির মাহমুদ হাসান বলেন, ‘আমি মূলত দুই ছোট ভাইকে রক্ষা করতে সেখানে গিয়েছিলাম। তাদের এইচএসসি পরীক্ষার্থী বলে পুলিশকে ছেড়ে দিতে বললে তারা আমাকে মারধর ও আটক করে। এরপর আমার কাছে বোমা আছে বা ছাত্রলীগ নেতা বলে প্রচার চালানো হয়েছে। এগুলো মিথ্যা, আমার বিরুদ্ধে মিডিয়া ট্রায়াল হয়েছে। আমি জুলাই আন্দোলনে সক্রিয়া ছিলাম। গুলিও খেয়েছি। চোখের পাশে গুলি লেগেছে, সামান্যর জন্য দৃষ্টিশক্তি হারাইনি।’

তিনি কোনও রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত নন দাবি করে জাকির বলেন, ‘বিভিন্ন সংগটনের নেতাদের সঙ্গে ছবি আছে, তাদের সবার সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক। কিন্তু আমি রাজনীতি করি না। রোহান আমার বন্ধু ও ক্লাসমেট। সে ছাত্রলীগ করে, তার কোনও প্রমাণ নেই। জুলাই আন্দোলনে সক্রিয়া থাকায় সাদিক কায়েমের সঙ্গেও ছবি আছে। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে যেসব তথ্য ছড়ানো হচ্ছে, তার কোনও সত্যতা নেই।’