
গত বুধবার (৯ জুলাই) রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে হত্যার ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে। এই ঘটনার প্রতিবাদে সরব হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ।
তবে প্রতিবাদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট এবং ইডেন মহিলা কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের’ নামে অনুষ্ঠিত মিছিলে উচ্চারিত নানা স্লোগান রাজনৈতিক মহলের দৃষ্টি কেড়েছে। এসব মিছিলের স্লোগানে বিএনপিকে আক্রমণ করা হয়। বিশেষ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে টার্গেট করে স্লোগান দেওয়া হয়- ‘চাঁদা তোলে পল্টনে, ভাগ যায় লন্ডনে’, ‘যুবদল খুন করে, তারেক রহমান কী করে?’
শুক্রবার (১১ জুলাই) রাতে সংগঠিত এসব মিছিলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে এ ধরনের স্লোগান ছাড়া কিছু অশ্লীল ও অশোভন ভাষার বাক্য উচ্চারণ করতেও দেখা যায়। স্লোগানের এমন ভাষা নিয়ে যেমন একদিকে বিতর্ক এবং সমালোচনা চলছে; অন্যদিকে জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী ইতিবাচক ভাবমূর্তি নিয়ে আবির্ভূত তারেক রহমানকে রাজনৈতিকভাবে হেনস্তা করতেই এসব মিছিলের আয়োজন কি না, এমন প্রশ্নও উঠেছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ভিডিও বিশ্লেষণ ও নানা সূত্রে জানা যায়, শুক্রবার রাতে বিশেষ দুই-একটি দলের ছাত্র সংগঠনের সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওইসব মিছিলে অংশ নেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। সেসব মিছিলেই শোনা যায় এসব আপত্তিকর স্লোগান। ফলে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা এসব মিছিল এবং মিছিলে দেওয়া স্লোগানের পেছনে রাজনৈতিক কোনো চক্রান্তের সন্দেহকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না।
৫ আগস্ট আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পতনের পর রাজনীতিতে সহনশীলতা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত করার জন্য দলের প্রতি বারবার নির্দেশনা দিতে দেখা গেছে তারেক রহমানকে। ওই সময় দেশজুড়ে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। ইতোমধ্যে এসব অভিযোগে দলের প্রায় দুই হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে বিএনপি থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। সর্বশেষ মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে সোহাগকে হত্যার ঘটনায় জড়ানোয় জাতীয়তাবাদী যুবদল থেকেও পাঁচজনকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছে।
দলের স্থায়ী কমিটির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর থেকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ অথবা কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বা চাঁদাবাজির সঙ্গে সম্পৃক্ততার ঘটনায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কাউকেই বিন্দুমাত্র ছাড় না দিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই সাংগঠনিক পদক্ষেপ নিয়েছেন, বহিষ্কার করেছেন।
এই পরিস্থিতিতে তার বিরুদ্ধে এমন অশোভন স্লোগান ও অপপ্রচারের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা। তারা এই ঘটনাকে রাজনৈতিক চক্রান্তের অংশ হিসেবেই দেখছেন। তাদের অভিমত, নিঃসন্দেহেই চক্রান্তকারীরা বিএনপি ও তারেক রহমানকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করার জন্য টার্গেট করেছে। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপিকে চাপে ফেলার কৌশল হিসেবেও এসব ঘটনাকে দেখছেন বিএনপির নেতারা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপির দ্রুত নির্বাচনের দাবিকে কেউ কেউ ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারছে না। নির্বাচন নিয়ে কোনো ইতিবাচক ইঙ্গিত পাওয়া গেলেই তারা সক্রিয় হয়ে ওঠে। আর এতে ঘি ঢালছে সারা দেশে ছড়ানো-ছিটানো বিএনপির উচ্ছৃঙ্খল ও ‘দুধের মাছি’ কিছু নেতা-কর্মী। তাদের অতি উৎসাহী কিছু কর্মকাণ্ড বিএনপির বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর পক্ষে রসদ জোগাচ্ছে।
তারা বলছেন, ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের পতনের পর থেকেই বিএনপিকে ‘চাঁদাবাজ’ রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রমাণের প্রচেষ্টা ছিল কিছু কিছু রাজনৈতিক দলের। বিভিন্ন সময় তাদের দলের নেতাদের বক্তব্যতেও এমন ইঙ্গিত বহুবার পাওয়া গেছে। যেহেতু এখন সবকিছু সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রকাশিত হলেই ভাইরাল হতে সময় লাগে না, তাই বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে জনরোষ তৈরি করারও সুযোগ তৈরি হয়েছে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এসব চক্রান্তের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই দলীয় নেতা-কর্মীদের সতর্ক করে আসছিলেন। তবু একের পর এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিএনপিকে যেভাবে কোণঠাসা করা হচ্ছে, তাতে আবারও উদ্বেগ প্রকাশ করে শনিবার (১২ জুলাই) জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের এক অনুষ্ঠানে দলের নেতা-কর্মীদের সতর্ক করে তারেক রহমান বলেন, ‘ধীরে ধীরে অদৃশ্য শত্রু দৃশ্যমান হচ্ছে। ষড়যন্ত্র এখনো শেষ হয়ে যায়নি। ’
মিটফোর্ডের ঘটনায় কড়া অবস্থানে বিএনপি
সূত্রগুলো বলছে, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন, সংস্কার, জুলাই ঘোষণাপত্রসহ কয়েকটি বিষয়ে যখন অন্য দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির মতবিরোধ চলছে, ঠিক সে সময়ে পুরান ঢাকার এ হত্যাকাণ্ড বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে বেশ চাপে ফেলেছে। এ হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এ ঘটনার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশের পর তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) বিভিন্ন দল ও সংগঠন।
বিএনপি নিজেও এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়েছে। শুক্রবার (১১ জুলাই) রাতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলনে পতিত আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর এই নির্মম ঘটনাটি দেশের মানুষের বিবেককে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। এর দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি সমাজকে আরও গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত করবে।
কতিপয় দল ও রাজনৈতিক নেতা ‘বিএনপি এ ঘটনার দায় এড়াচ্ছে’ বলে অভিযোগ করলেও তা নাকচ করে দিয়েছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘বিএনপি কোথায় দায় এড়ালো? আমরা তো অভিযোগ পাওয়া মাত্রই বহিষ্কার করেছি। এরপর তো কাজ সরকার আর প্রশাসনের। তাদের আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করছি। এরপরও বিভিন্ন মহল এটা নিয়ে যে নোংরা রাজনীতির চেষ্টা করছে, তা দুঃখজনক। ’
তারেক রহমানকে টার্গেট করে স্লোগানের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তারেক রহমান কি সরকার চালাচ্ছেন? ওনার বিরুদ্ধে স্লোগান কেন?’
‘অপ্রতিদ্বন্দ্বী’ তারেক রহমানের ইমেজ নষ্টের চক্রান্ত?
রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টদের মতে, তারেক রহমান এখন বাংলাদেশের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করায় একটি গোষ্ঠী তার ইমেজ নষ্ট করতে উঠেপড়ে লেগেছে। তাকে সরিয়ে দিতে পারলেই এই গোষ্ঠীর পক্ষে ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে, যে চক্রান্ত আলোচিত ‘এক-এগারো’র ফখরুদ্দিন-মইন উদ্দিনের আমল থেকেই চলছিল। তাদের মতে, এসব স্লোগান থেকে স্পষ্ট—হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি বা বিচার চাওয়ার চেয়ে বিএনপি এবং তারেক রহমানকেই মূলত টার্গেটে পরিণত করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের পতনের পর তারেক রহমানের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও সিদ্ধান্তে দেখা গেছে আমূল পরিবর্তন। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ও শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর তিন দিন দেশে কার্যত কোনো সরকার দায়িত্বে ছিল না। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে অস্ত্র তাক করা পুলিশ সদস্যরাও প্রাণভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। থানাগুলো ছিল নিষ্ক্রিয়। মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ এমন অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছিল যে পুলিশের অবর্তমানে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল পুরো দেশ।
এমন পরিস্থিতিতে ৭ আগস্ট নয়াপল্টনে বিএনপির জনসভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তারেক রহমান প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, শক্ত হাতে আইনশৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে। এ সময় তিনি ধর্ম-বর্ণের কারণে কেউ যেন নিরাপত্তাহীনতায় না থাকে, তা নিশ্চিত করতেও আহ্বান জানান। মুসলমান, হিন্দু ,খ্রিস্টান বৌদ্ধ যাই হোক না কেন, সবার নিরাপত্তায় ঢাল হয়ে দাঁড়াতে বলে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘আমাদের প্রথম পরিচয় আমরা বাংলাদেশি। ’
একই বক্তৃতায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘সারা দেশে বিএনপির যে নেতা-কর্মীরা রয়েছেন, তারা জনগণের নিরাপত্তায় এগিয়ে আসুন। যার যেমনই বিশ্বাস হোক না কেনো, তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব আপনারা নেবেন। বুক পেতে জনগণকে রক্ষা করবেন। ’
সেসময় তিনি এ বিজয়কে চূড়ান্ত রূপ দিতে হলে দেশের মানুষকে নিরাপত্তা দিতে হবে বলে জানিয়েছিলেন। যারা দুর্বৃত্ত-লুটতরাজ, তাদের সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, প্রতিটি পাড়ায় মহল্লায় মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টানসহ সবার নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতে হবে।
তারেক রহমানের ওই বক্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন বার্তা দিয়েছিল। দলীয় নেতাকর্মীদের শপথ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘চলুন শপথ নিই- এমন কোনো কাজ করবো না যা জনসাধারণের আস্থা নষ্ট করে। ’ এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি সুস্পষ্ট বার্তা দিতে চেয়েছিলেন—রাজনীতি জনগণের আস্থা অর্জনের মাধ্যম, ক্ষমতা দখলের নয়।
এছাড়া দলীয় নেতা-কর্মীদের সতর্ক করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেছিলেন, ‘যদি কেউ মনে করেন, যাদের আমরা প্রধান প্রতিপক্ষ মনে করতাম, তারা আর নেই বা দুর্বল হয়ে পড়েছে, আর আমরা সহজেই ক্ষমতায় চলে যাব, তাহলে এই চিন্তা পরিহার করুন। ’ তিনি মনে করিয়ে দিয়েছিলেন,‘ রাজনীতিতে প্রতিপক্ষকে ছোট করে দেখা ভুল। বরং, সংগঠনের ভিত শক্ত করা এবং জনগণের আস্থা অর্জন করাই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। ’ এই সতর্কবার্তায় তার দূরদর্শিতা প্রমাণিত।
এরপর গত নভেম্বর মাসে নিজের জন্মদিনকে সামনে রেখে তিনি দলীয় নেতা-কর্মীদের তার জন্মদিন পালনেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। ওই নির্দেশনা অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও দলীয় এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছিল। নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে নিজের নামের আগে ‘দেশনায়ক’ বা ‘রাষ্ট্রনায়ক’ উপাধি ব্যবহার করতে নিষেধ করেন তিনি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই দলের অভ্যন্তরে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত, বিভিন্ন সভা-সমাবেশে ভার্চুয়ালি যুক্ত থেকে তিনি বক্তব্য দিয়েছেন, দলীয় নেতাকর্মীদের কথাও মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন।
দীর্ঘ ১৭ বছর দেশে বাকস্বাধীনতাকে যেভাবে দমন করে রাখা হয়েছিল, গণঅভ্যুত্থানের পর ১১ আগস্ট স্বাধীন মতপ্রকাশের ব্যাপারে উৎসাহিত করতে তারেক রহমান তাকে নিয়ে আঁকা কার্টুনিস্ট মেহেদি হাসানের একটি কার্টুন ফেসবুক পেজে শেয়ার দিয়ে মেহেদি হাসানের প্রশংসা করেন। ওই কার্টুনটি শেয়ার করে তিনি লেখেন, ‘বাংলাদেশে রাজনৈতিক কার্টুন আঁকার স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ায় আমি অত্যন্ত খুশি। ’
রাজনীতিকদের চোখে পরিপক্ক তারেক রহমান
পরিবর্তিত সুষ্ঠু রাজনীতির এই ধারা প্রবর্তনের চেষ্টা এবং তারেক রহমানের রাজনৈতিক পরিপক্কতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘তারেক রহমান এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিবর্তিত ও যোগ্য নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। ১৫ বছর আগের তারেক রহমান এবং বর্তমানের তার মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। ’
তিনি আরও বলেন, ‘১৫ বছর আগে তার বক্তব্য শুনেছি, তাকে দেখেছি। এখন আমি তাকে অনেক বেশি পরিপক্ব ও যোগ্য মনে করি। তার মধ্যে এখন নম্রতা এসেছে, তবে তিনি কঠোর সিদ্ধান্তও নিতে পারেন, এটা দলের জন্য প্রয়োজন। লিডার হতে হলে এমনই হওয়া উচিত– যার ভেতরটা স্বচ্ছ, আবার প্রয়োজনে কঠোরতা দেখাতে পারে। এই পরিবর্তন আমাকে আশাবাদী করে তোলে। ’
ব্রিটিশ সাপ্তাহিকী ‘দ্য উইক’ নিউজ ম্যাগাজিন চলতি বছর এপ্রিলের সংখ্যায় তারেক রহমানকে নিয়ে ‘ডেসটিনি’স চাইল্ড’ বা ‘নিয়তির সন্তান’ শিরোনামে একটি কাভার স্টোরি করেছিল। দ্য উইক ম্যাগাজিনের নয়াদিল্লি ব্যুরো চিফ নম্রতা বিজি আহুজা’র লেখা ওই শীর্ষ প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সরকারকর্তৃক বিএনপি ভাঙার চেষ্টার বিপরীতে তারেক রহমানের নেতৃত্বেই দল ঐক্যবদ্ধ রয়েছে এবং তারেক রহমান পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথে রয়েছেন, কারণ দিন দিন তার জনপ্রিয়তা বাড়ছে।
চক্রান্ত দীর্ঘদিনের
তারেক রহমানের বিরুদ্ধে একটি মহল এক-এগারোর সময় থেকেই নানা ধরনের প্রচার চালিয়ে আসছে। সেসময়ের কিছু পত্রিকা তারেক রহমানের চরিত্র হরণে এবং তাকে চাঁদাবাজ প্রমাণে হাওয়া ভবনকে জড়িয়ে নানা খবর নিয়মিত পত্রিকার শিরোনাম করতে থাকে। এর পেছনে একটি বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকার তথ্যপ্রমাণ যেমন পাওয়া যায়, দেশীয় গোয়েন্দা সংস্থাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, ‘মাইনাস টু’ বাস্তবায়নের জন্য তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উদ্দিন আহমেদের সরাসরি নির্দেশে তারেক রহমানের নামে বিভিন্ন দুর্নীতির মামলা করা হয়। মইন তার নিজের লেখা বই ‘এক এগারো’তেও এই বর্ণনা দিয়েছেন। যদিও তখনকার এনবিআর বা দুদক কেউই তারেক রহমানের বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির প্রমাণ পায়নি।
তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সেসব মামলা করতে মইন উ আহমেদ বাধ্য করেছিলেন বলে জানা যায়। সেসময় ব্যবসায়ীদের তুলে নিয়ে বিভিন্ন রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে মামলা করতে বাধ্য করা হতো বলেও জানা গেছে। তারেক রহমানের নামে এ যাবতকালে সিমেন্স দুর্নীতি, হারবিন দুর্নীতি, বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতি, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের অর্থ আত্মসাত কিংবা ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার যেসব অভিযোগ এসেছে, সেগুলো কোনোটাই প্রমাণিত না। শেখ হাসিনার আমলেও গত সাড়ে ১৫ বছরে এসব কোনো অভিযোগই প্রমাণিত হয়নি।
গত এগারো মাসে চাঁদাবাজি, দখলদারিত্বে সবচেয়ে বেশি বিএনপির নামই উচ্চারিত হচ্ছে। তবে দলীয় হাইকমান্ড থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে সেগুলো দমন করার। কিন্তু তারেক রহমান সশরীরে দেশে উপস্থিত না থাকায় দলের লাগাম টেনে ধরা কঠিন হয়ে পড়ছে।
রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বিএনপির এখনকার নেতিবাচক কর্মকাণ্ডগুলো দলীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণের চেয়ে বড় সমস্যা আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গুর। পুলিশ-প্রশাসনের নীরবতা, বিএনপিতে কর্মীর চেয়ে নেতা বেশি থাকা, বিএনপি চেয়ারপাসন বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশের বাইরে থাকা, শীর্ষ নেতৃত্বে গ্রুপিং- সব মিলিয়ে জুলাই পরবর্তী রাষ্ট্র বিনির্মাণের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে বলেও আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এই অবস্থায় বিএনপি বা তারেক রহমানকে টার্গেট করা আরেকটি ষড়যন্ত্র বলে তাদের কাছে প্রতীয়মান হচ্ছে।
এ বিষয়ে রোববার (১৩ জুলাই) বিকেলে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আজকে যে প্রচার হচ্ছে, অপপ্রচার হচ্ছে এর পেছনে কিন্তু একেবারে সুনির্দিষ্ট চক্রান্ত রয়েছে। সেই চক্রান্ত হচ্ছে বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী শক্তিকে ধ্বংস করে দেওয়া; সেই চক্রান্ত হচ্ছে যার একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে সেই তারেক রহমান সাহেবকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া, তাকে খারাপ জায়গায় ফেলে দেওয়ার চেষ্টা। ’
অভ্যুত্থানের শক্তিতে ফাটল ধরানোর কিছু না করার পরামর্শ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান বাংলানিউজকে বলেন, ‘মিটফোর্ডে যে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। অভ্যুত্থানের পর এ ধরনের ঘটনা আমরা আশা করি না। সরকারের উচিত কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই অপরাধী যে পরিচয়ের, যে দলেরই হোক না কেন, আইনের আওতায় এনে বিচার নিশ্চিত করা। ’
এ ঘটনায় এক তরফাভাবে বিএনপি এবং তারেক রহমানের ওপর দায় দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের মনে রাখতে হবে, সবাই মিলেই আমরা একটা অভ্যুত্থান করেছি। কেউ কেউ হয়তো এই অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তির মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির চেষ্টা করছে। অপরাধীর পরিচয়, সে অপরাধী। একটা দলের সবাইকে যদি আমরা খারাপ বলি, তাহলে জেনারালাইজড করা হয়ে যাবে। এটা ঠিক হবে না। সব জায়গাতেই ভালো-মন্দ মানুষ আছেন। কোনো এক পক্ষকে দায় না দিয়ে প্রকৃত অপরাধীকে শাস্তির আওতায় আনা উচিত। ’
তারেক রহমানকে উদ্দেশ্য করে দেওয়া স্লোগান প্রসঙ্গে অধ্যাপক কামরুল আহসান বলেন, ‘শব্দের ব্যবহারে আমাদের সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। আবেগে হয়তো এমন শব্দ প্রয়োগ করে ফেলেছে, কিন্তু স্লোগান হওয়া উচিত ছিল দ্রুত বিচার চেয়ে। শাস্তি নিশ্চিত করার স্লোগান হওয়া উচিত ছিল। আমরা এমন কিছু করবো না যাতে অভ্যুত্থানের শক্তিতে ফাটল ধরে। ’