Image description

খুলনার দৌলতপুর থানা যুবদলের সাবেক সহসভাপতি মাহবুবুর রহমান মোল্লা হত্যাকাণ্ডে একাধিক বিষয় নিয়ে তদন্ত করছে পুলিশ। হত্যাকারীদের চিহ্নিত করা গেছে বলে দাবি করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ওই ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পর গতকাল শনিবার নিহত মাহবুবের বাবা থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।

পুলিশের একাধিক সূত্র বলছে, ঘটনাটির পেছনে কিছু তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে, যার ভিত্তিতে হত্যাকারীদের বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া গেছে। তবে হত্যার মূল কারণ এখনো স্পষ্ট নয়। এ সম্পর্কে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার আবু রায়হান মুহাম্মদ সালেহ্ বলেন, ‘বিষয়টি তদন্তাধীন। এ মুহূর্তে কিছু বলা সম্ভব নয়। তবে অনেক তথ্য আমরা পেয়েছি, যা যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। হত্যাকাণ্ডে একাধিক অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে। তিনজন খুনি একটি মোটরসাইকেলে করে আসে। তাদের একজনের মাথায় হেলমেট ছিল। আশপাশের ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে।’

নিহত মাহবুবুর রহমানের বাড়ি খুলনার দৌলতপুর পশ্চিম মহেশ্বরপাশা এলাকায়। গত শুক্রবার দুপুরে বাসার সামনে নিজের প্রাইভেট কার পরিষ্কার করছিলেন তিনি। এ সময় একটি মোটরসাইকেলে তিনজন দুর্বৃত্ত এসে মাহবুবুরকে গুলি করে এবং দুই পায়ের রগ কেটে হত্যা করে। স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁকে উদ্ধার করে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। এ সময় চিকিৎসক তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।

এদিকে হত্যাকাণ্ডের পেছনে নানা সন্দেহ, পুরোনো-নতুন দ্বন্দ্ব ও আধিপত্যের সংঘাতের বিষয়গুলো আলোচনায় এসেছে। ছায়া তদন্তে যুক্ত এক পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের, চাঁদাবাজি, দলীয় কোন্দল, মাদক ব্যবসা, চরমপন্থীদের সঙ্গে সম্পর্ক, কুয়েটের সংঘর্ষের ঘটনাসহ বিভিন্ন দিক মাথায় রেখে তদন্ত চলছে।

পুলিশ, স্থানীয় বাসিন্দা ও রাজনৈতিক সূত্র জানায়, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এলাকায় বেপরোয়া আচরণ, দখল, জমি বিক্রির সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণসহ নানা বিষয়ে মাহবুবের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। বিএনপির এক প্রভাবশালী নেতার ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। পাশাপাশি এক চরমপন্থী নেতা ছিলেন মাহবুবের আত্মীয়। এসব কারণে এলাকায় মাহবুবের প্রভাব ছিল। আধিপত্য নিয়ে স্থানীয় কয়েকটি সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে তাঁর বিরোধ ছিল। মাদক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ও চাঁদাবাজির কারণেও মাহবুব একাধিক গ্রুপের টার্গেটে পরিণত হন। আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে পারেন, এ আশঙ্কায় পুলিশের নজরদারির তালিকায়ও ছিলেন তিনি। মাহবুব যে গাড়ি ব্যবহার করছিলেন, কিছুদিন আগে সেটি এক যুবলীগ নেতার কাছ থেকে অল্প দামে কিনেছিলেন।

নিহত মাহবুবুর রহমানের বাবা আবদুল করিম মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাহবুব প্রতিবাদী ছিল। কেউ চাঁদা চাইলে সে প্রতিবাদ করত। কয়েকটা সন্ত্রাসী গ্রুপ আশপাশে ঘুরছে। তারাই এই ঘটনা ঘটিয়েছে।’

মাহবুবের স্ত্রী এরিন সুলতানা বলেন, ‘কুয়েটের ঘটনায় সে দলের নির্দেশে গিয়েছিল, নিজের স্বার্থে না। মানিকতলায় যুবদলের সুধী সমাবেশের ঘটনায় ওর বন্ধু জাকির মামলা করার পর মাহবুবুরের কাছে নিয়মিত হুমকি আসত, কিন্তু কারা দিচ্ছে, তা বলত না। এখন আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।’

মহানগর শ্রমিক দলের সাবেক প্রচার সম্পাদক ও মাহবুবের শ্বশুর আজাদ বেগ বলেন, ‘কুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরের সঙ্গে ছাত্রদলের সংঘাতে যুবদলের নেতা হিসেবে মাহবুব পাশে দাঁড়িয়েছিল। এ ঘটনাও একটি কারণ হতে পারে। ৫ আগস্টের পর দলীয় অফিস ভাঙচুরের ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বাদী হয়ে মামলা করেন মাহবুব। এ ছাড়া মানিকতলার যুবদলের একটি সুধী সমাবেশে মারামারির ঘটনায় তাঁর বন্ধু জাকির মামলা করলে আসামিরা মাহবুবের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। নিয়মিত তাঁকে হুমকি দেওয়া হতো।’

আজাদ বেগ আরও বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডে জড়িত আসামিরা আওয়ামী লীগের নেতাদের আত্মীয়স্বজন। তারা কুয়েট এলাকায় আরিফকে হত্যা করেছে, চাঁদাবাজিও করছে। কিছুদিন আগে দিলীপ মাস্টারকে গুলি করেছে। খানাবাড়ি এলাকায় হাউসবিল্ডিংয়ের একটি বাড়ির মালিকানা নিয়ে ঝামেলা তৈরি হওয়ায় মাহবুবকে উদ্দেশ করে গুলি ছোড়া হয়েছিল।’

পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দৌলতপুর, দেয়ানা ও তেলিগাতি এলাকায় চরমপন্থী দলগুলোর আধিপত্য নিয়ে একাধিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। গত ১৫ মার্চ চরমপন্থী নেতা শেখ শাহীনুল হককে (বড় শাহীন) গুলি করে হত্যা করা হয়। একসময় তাঁর দলে ছিলেন মহেশ্বরপাশার হুমায়ুন কবির (হুমা), ক্রসরোডের কাজী রায়হান, ঘোষপাড়ার আসিফ মোল্লা, বুচিতলার ইমন হাওলাদার, হোসেন ঢালী ও আরমান। বর্তমানে দলটি দুটি ভাগে বিভক্ত। হুমায়ুনের নেতৃত্বে আছেন রায়হান, আসিফ ও ইমন। অন্য পক্ষে আছেন হোসেন ঢালী ও আরমান।

সম্প্রতি বাগেরহাটের একটি অস্ত্র মামলায় হুমায়ুন, রায়হান, আসিফ ও ইমন গ্রেপ্তার হন। রায়হান ও ইমন জামিনে মুক্ত হলেও অন্য দুজন কারাগারে আছেন। অপর একটি মামলায় হোসেন ঢালী ও আরমানও কারাগারে রয়েছেন।

 

সূত্রগুলো জানায়, আরমান মাহবুবের আত্মীয়। হোসেন ঢালী ও আরমানের মামলার দেখভাল করতেন মাহবুব। এ নিয়ে হুমা গ্রুপের সঙ্গে বিরোধ তৈরি হয়।

নিহত মাহবুবের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মী প্রথম আলোকে বলেন, ‘হুমা গ্রুপ মনে করত, মাহবুব তাদের ধরিয়ে দিয়েছে। মাহবুব বারবার বুঝিয়েছিলেন, এটা ভুল–বোঝাবুঝি। কিন্তু তারপরও কারাগার থেকেই তাঁর হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।’

দৌলতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর আতাহার আলী বলেন, হত্যার নেপথ্যের কারণগুলো সামনে রেখে তদন্ত চলছে। আমরা সজল নামের একজনকে গ্রেপ্তার করেছি। মাহবুবের অবস্থানের বিষয়ে তিনি হত্যাকারীদের তথ্য দিয়েছিলেন। কারা এটা করছে, আমরা মোটামুটি শনাক্ত করতে পেরেছি। শিগগিরিই আমরা হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও হত্যার রহস্য উদ্‌ঘাটন করতে পারব বলে আশা করছি।’