Image description

বহু বছর ধরে চাঁদপুর জাতীয়তাবাদী শক্তি ও ইসলামী চেতনার ভূমি হিসেবে পরিচিত। যুগের পর যুগ এখানে রাজত্ব ছিল বিএনপির। দলটির জন্য এখনো এই জেলার মাটি উর্বর বলে লোকমুখে বলাবলি হয়। ১৯৯১ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে জেলার সবগুলো আসনই পেয়েছিল শহীদ জিয়ার অনুসারীরা।

২০০৮ সালের নির্বাচনকে পাতানো বলা হয়, তখনো এক জাতীয়তাবাদী নেতা জয় পেয়েছিলেন। মাঝে দেড় দশক ভোট ডাকাতি করে আসনগুলোর দখল করেছিল ফ্যাসিবাদীরা। তবে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন ঘিরে নতুন উদ্যমে তৎপর হচ্ছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। তবে এবার মনোনয়ন দৌড়ে দলটির হেভিওয়েট নেতাদের নিয়ে বাধতে পারে বিপত্তি। ধানের শীষ যাকেই দেওয়া হোক বিভক্তি এড়ানো কঠিন হবে বলে অভিজ্ঞ মহলের আশঙ্কা।

চাঁদপুরের আট উপজেলা নিয়ে পাঁচটি আসন গঠিত। এর মধ্যে অধিকাংশই বিএনপির শক্তিশালী দুর্গ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু ইতিহাস বলে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে প্রার্থী না করলে স্থানীয় নেতাকর্মীরা বিভিন্ন পক্ষে বিভক্ত হয়ে যান।

এমনকি অন্য দলের প্রার্থীকেও সহযোগিতা করার রেকর্ড আছে। এবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে পাল্লা ভারী হতে পারে জামায়াতে ইসলামীর। এর সঙ্গে রয়েছে ইসলামপন্থি দলগুলোর জোট গঠনের সম্ভাবনা। এটি হলে পাল্টে যেতে পারে ভোটের মাঠের পুরো হিসাব-নিকাশ। এছাড়া ইসলামী আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কয়েকজন নেতা সরব থাকলেও গণঅধিকার পরিষদ, আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) নেতাকর্মীদের তেমন তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।

চাঁদপুর-১ (কচুয়া)

এ আসনের সঙ্গে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে আছে বিএনপি নেতা সাবেক শিক্ষামন্ত্রী আ.ন.ম. এহসানুল হক মিলনের নাম। তিনি দুই মেয়াদে নির্বাচিত হন। এবারো মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন। দলের টিকেট পেলে সবচেয়ে হেভিওয়েট প্রার্থী হবেন। কিন্তু তার সঙ্গে ধানের শীষ পাওয়ার দৌড়ে প্রতিযোগিতা করছেন বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের বেশ কয়েকজন। বিষয়টি অন্তত ৩৭টি মামলার শিকার এই নেতার জন্য বিব্রতকর।

এছাড়া বিএনপির মনোনয়ন চাইবেন দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও মালয়েশিয়া শাখার সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন। তিনি ২০১৮ সালে ধানের শীষ পেয়েছিলেন। মাঠে তৎপর আছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য, কেন্দ্রীয় মহিলা দলের সদস্য ও এহসানুল হক মিলনের স্ত্রী নাজমুন নাহার বেবী। প্রচার চালাচ্ছেন উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি শরফ উদ্দিন মিয়া। এর বাইরে সরব আছেন উপজেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি আ.হ.ম. ইঞ্জিনিয়ার মনিরুজ্জামান দেওয়ান মানিক ও অস্ট্রেলিয়া শাখা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার হাবিবুর রহমান।

জামায়াত একক প্রার্থী নিয়ে বেশ স্বস্তিতে আছে। দলটির চাঁদপুর জেলা মজলিশের শূরা ও কর্মপরিষদের সদস্য মুহাদ্দিস আবু নসর আশরাফিকে বেশ আগেই মনোনয়ন দেওয়ায় তিনি প্রচারে এগিয়ে আছেন। তিনি হাজীগঞ্জ কামিল মাদরাসার শিক্ষক ও প্রশংসিত আলেম। উপজেলায় তার বেশ খ্যাতি রয়েছে। নানা কৌশলে তিনি জনগণের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছেন এবং তাদের হৃদয় জয় করছেন বলে জানিয়েছেন এই প্রার্থী। তিনি এই আসনে অন্য যে কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিযোগী বলে দাবি করেছেন।

তবে ইসলামী আন্দোলন, এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদ ও এবি পার্টি এখনো কোনো প্রার্থী দেয়নি।

চাঁদপুর-২ (মতলব উত্তর ও দক্ষিণ)

রাজনীতির উর্বর ভূমি হিসেবে পরিচিত এ আসন। এখানে অনেক বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদের জন্ম হয়েছে। তাদের মধ্যে জাতীয় সংসদের সাবেক ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী পাটওয়ারী, মেজর জেনারেল (অব.) শামসুল হক। সাবেক মন্ত্রী নুরুল হুদা, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও ড. শামসুল আলম উল্লেখযোগ্য।

সে হিসেবে এখানে বিভিন্ন দলের রাজত্ব ছিল। এবার স্থানীয় ভোটারদের অভিভাবক হতে চান বিএনপির ড. জালাল আহমেদ, বিএনপি সমর্থিত সাবেক মন্ত্রী নুরুল হুদার ছেলে জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি তানভীর হুদা, জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ও মতলব দক্ষিণ উপজেলা পরিষদের দুই বারের সাবেক চেয়ারম্যান এম এ শুক্কুর পাটওয়ারী, কৃষক দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুর রহমান টিপু, জেলা বিএনপির সদস্য ও ঢাকা মহানগর উত্তর শাখার সভাপতি ড্যাব নেতা ডা. সরকার মাহবুব আহমেদ শামীম এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও ড্যাব নেতা ডা. আনিসুল আউয়াল। তারা সবাই দলের শীর্ষ নেতাদের কাছে তদবির ও এলাকায় প্রচার চালালেও তাদের অনেকের সম্পর্ক নেই তৃণমূলের সঙ্গে।

জামায়াত মনোনীত প্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. আবদুল মুবিন দলের কুমিল্লা জেলা শাখার সহকারী সেক্রেটারি হলেও মাঠেই থাকছেন অধিকাংশ সময়। বিভিন্ন দিবস ও উপলক্ষ নিয়ে পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুনে বাড়াচ্ছেন পরিচিতি। জামায়াত নেতাকর্মীদের পাশাপাশি স্থানীয় ভোটারদেরও বেশ সহযোগিতা ও সমর্থন পাচ্ছেন বলে তার দাবি।

এদিকে ইসলামী আন্দোলনের তিন নেতা দলের মনোনয়ন পাওয়ার জন্য তৎপর আছেন। তারা হলেনÑ জেলা শ্রমিক আন্দোলনের সভাপতি মাওলানা আশরাফ উদ্দীন, ইসলামী যুব আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির সেক্রেটারি জেনারেল মুফতি মানসুর আহমেদ সাকী ও মাওলানা মুক্তার আহমেদ।

তবে এনসিপি ও গণঅধিকার পরিষদের কমিটি থাকলেও ভোটের মাঠে তাদের তেমন দেখা যাচ্ছে না।

চাঁদপুর-৩ (সদর ও হাইমচর)

স্বাধীনতার পর থেকে ২০০৮ পর্যন্ত এ আসনে কখনোই আওয়ামী লীগ জিততে পারেনি। তবে ২০০৮ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত আসনটি দখল করে রাখে দলটি। এছাড়া বিএনপির কর্মীবান্ধব প্রার্থীকে মনোনয়ন না দেওয়ায় লেগেই থাকে অন্তর্কোন্দল। এ কারণে জিএম ফজলুল হক ধানের শীষ পেলেও দলের একটি অংশ কোনোভাবেই তাকে সহযোগিতা করেনি। বরং, তাদের কেউ কেউ আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে শক্তি জুগিয়েছেন।

এবার বিএনপির তিন নেতা দলে ঝাণ্ডা কাঁধে নিতে চান। তাদের মধ্যে অন্যতম জেলা বিএনপির সভাপতি শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক। তিনি ২০১৮ সালেও বিএনপির মনোনয়ন পান। ১৬ বছর ধরে স্থানীয় বিএনপির অঘোষিত কর্ণধার তিনি। জেলা থেকে ওয়ার্ড পর্যন্ত সব কমিটিও তিনি দিয়েছেন। একচ্ছত্র আধিপত্য থাকায় এবার তিনি দলের টিকিট পাবেন বলে তার দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে।

এছাড়া জেলা বিএনপির উপদেষ্টা ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আজম খান। তার বাড়ি সদর উপজেলায় হলেও থাকেন দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে। তিনি সেখানে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। সম্প্রতি তিনি এলাকায় এসে মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে জানান দিয়ে আবার প্রবাসে চলে যান।

অপর প্রতিযোগী বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মোস্তফা খান সফরী। তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা ছিলেন। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল দৃশ্যমান। আগেও বেশ কয়েকবার তিনি ধানের শীষ চেয়েছেন। এবারো তার প্রত্যাশা আছে।

জামায়াতের প্রার্থী হয়েছেন জেলা শাখার সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট শাহজাহান মিয়া। তিনি পেশায় আইনজীবী। এক সময় তিনি চাঁদপুর সদর জামায়াতের আমির ছিলেন। ২০১৪ সালে সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। আগেও তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।

ইসলামী আন্দোলনের সম্ভাব্য প্রার্থী শেখ মো. জয়নাল আবেদীন। তিনি দলের কুমিল্লা বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক। এর আগে তিনি চাঁদপুর জেলা ইসলামী আন্দোলনের সভাপতি ছিলেন। অপরদিকে গণঅধিকার পরিষদের নেতাকর্মীরা মাঠে থাকলেও তাদের প্রার্থী চূড়ান্ত হয়নি। একই অবস্থা এনসিপির।

চাঁদপুর-৪ (ফরিদগঞ্জ)

জেলায় আয়তনে সবচেয়ে বড় এ আসন বিএনপি ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত হলেও দলের নেতাকর্মীরা তিন ভাগে বিভক্ত। ২০০৮ সালে দলটি জাতীয় সংসদে ২৭টি আসন পায়। তার মধ্যে ফরিদগঞ্জ একটি। ওই সময় এ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন বিএনপির প্রার্থী লায়ন মো. হারুনুর রশীদ। দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির রাজস্ব ও ব্যাংকিংবিষয়ক এই সম্পাদক আওয়ামী জমানায় প্রায় ১০ বছর এলাকায় তেমন ভূমিকা রাখতে পারেননি।

তবে জুলাই বিপ্লবের পর তিনি পুনরায় এলাকায় ফিরে দলীয় কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। এবার তিনি দলের টিকিট পাওয়ার জোর দাবি করছেন। এছাড়া তৎপর আছেন উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক এম এ হান্নান, জেলা বিএনপির সাবেক কোষাধ্যক্ষ ও জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মোতাহার হোসেন পাটওয়ারী, জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শরীফ মো. ইউনূস। তাদের মধ্যে হান্নান এলাকার রাজনীতিতে সক্রিয় এবং সব কমিটি তারই দেওয়া। সাবেক ছাত্রনেতা শরীফ দল গোছাতে অনন্য ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে দাবি করে এবার ধানের শীষ পাওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাসী।

জামায়াত মনোনীত প্রার্থী মাওলানা বিল্লাল হোসেন মিয়াজি এলাকায় সমধিক পরিচিত নেতা। তিনি জেলা জামায়াতের আমির। এমনকি পুরো জেলার মধ্যে এ আসনে দলটির ভোট বেশি। সেই ভোট ব্যাংক নিয়ে তিনি আগামী নির্বাচনে যেকোনো প্রার্থীর জন্য চ্যালেঞ্জিং প্রতিদ্বন্দ্বী বলে দাবি করছেন। অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট হলে তার জয় নিশ্চিত বলে তার প্রত্যাশা।

এদিকে ইসলামী আন্দোলনের মনোনয়ন প্রত্যাশী শাইখুল হাদিস আল্লামা মকবুল আহমেদ। ২০০৮ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনেও তিনি প্রার্থী ছিলেন। তবে খেলাফত মজলিস, এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদসহ অন্য দলের নেতাকর্মীদের তেমন তৎপরতা নেই।

চাঁদপুর-৫ (হাজীগঞ্জ ও শাহরাস্তি)

বিএনপির এই উর্বর ভূমিতে আগে দলটির পাঁচবার এমপি ছিল। মাঝে রাজত্ব করেছে আওয়ামী লীগ। আগামী নির্বাচনে আসনটি পুনরুদ্ধার করার চেষ্টায় আছেন ২০১৮ সালে মনোনয়ন পাওয়া জেলা বিএনপির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য লায়ন ইঞ্জিনিয়ার মমিনুল হক, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন খোকন, জেলা বিএনপির সদস্য ব্যারিস্টার কামাল হোসেন এবং যুবদল কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিল্লাল হোসেন তারেক।

জামায়াতের একক প্রার্থী হিসেবে নানা কর্মসূচির মাধ্যমে এলাকায় আলোড়ন তৈরি করেছেন অধ্যাপক মাওলানা আবুল হোসাইন। তিনি জেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি। তাকে নিয়ে হাজীগঞ্জ, শাহরাস্তি উপজেলার দলীয় নেতাকর্মীরা উঠান বৈঠক ও গণসংযোগ করছেন। প্রতিযোগিতামূলক ভোট হলে যে কোনো প্রার্থীকেই তার সামনে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হবে বলে তার বিশ্বাস।

এদিকে এনসিপির তরুণ প্রার্থী হতে পারেন দলের মুখ্য সমন্বয়ক নাসির উদ্দীন পাটওয়ারী। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা কমিটি গঠনের মাধ্যমে দল গোছানোর কাজ করছি। আমরা মনে করি, ফ্যাসিস্ট সরকারের বিচার ও মৌলিক সংস্কারের পর নির্বাচন হওয়া উচিত। অন্যথায়, আবার দেশের মানুষ নিপীড়নের শিকার হবে।’