
রাজধানীর পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে প্রকাশ্যে পিটিয়ে ও পাথর মেরে নৃশংস হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশের রাজনীতিতে ঝড় বইছে। ওই ঘটনায় বিএনপির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। কোনো কোনো বিক্ষোভ মিছিল থেকে তারেক রহমানকে জড়িয়েও স্লোগান দেওয়া হয়।
সামাজিক যোগোযোগমাধ্যমেও বিএনপির বিরুদ্ধে প্রচার চালানো হচ্ছে। ঘটনায় সরকারের ব্যর্থতাকেও দায়ী করা হয়। ওই ঘটনায় বিএনপির ভেতরে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তাদের সংগঠনের নীতি, আদর্শ ও রাজনীতির সঙ্গে সন্ত্রাস ও বর্বরতার কোনো সম্পর্ক নেই। অপরাধী যেই হোক, তার স্থান কখনোই আইন ও ন্যায়বিচারের ঊর্ধ্বে হতে পারে না।
বিএনপি ও তারেক রহমানকে টার্গেট করে মহলবিশেষের তৎপরতা উদ্দেশ্যমূলক। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, দলীয় অবস্থান থেকে যা যা করা দরকার, বিএনপি তা করেছে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেন বসে আছে? সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন?
গত বুধবার মিটফোর্ড (স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ) হাসপাতালের সামনে ব্যস্ত সড়কে প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় লাল চাঁদ সোহাগকে। সোহাগ হত্যার ঘটনায় পাঁচজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে সরকার। আদালতে এক আসামি হত্যার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। অরেক আসামিকে আদালত থেকে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণের কথা ঘোষণা করেছেন। ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, নিহত সোহাগ যুবদলের কর্মী। এ ঘটনায় নাম আসায় তিন সংগঠনের পাঁচজনকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
সোহাগ হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ, মামলার এজাহার, নিহতের স্বজন ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বর্ণনা থেকে জানা যায়, হত্যার আগে ডেকে নিয়ে তাকে পিটিয়ে এবং ইট-পাথরের টুকরা দিয়ে আঘাত করে মাথা ও শরীরের বিভিন্ন অংশ থেঁতলে দেওয়া হয়। একপর্যায়ে তাকে বিবস্ত্র করা হয়। তার শরীরের ওপর উঠে লাফায় কেউ কেউ। ওই ঘটনায় যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠছে। নিহত লাল চাঁদ যুবদলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
প্রকাশ্যে পিটিয়ে ও পাথর দিয়ে থেঁতলে মারার মতো নারকীয় তাণ্ডবে উত্তাল হয়ে উঠেছে সারা দেশ। বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাধারণ শিক্ষার্থীরা মাঠে নেমে ওই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির দাবি করেছেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চালায় কেÑপ্রশ্ন তারেক রহমানের
মিটফোর্ডে সোহাগ হত্যার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতাকে দায়ী করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ওই ঘটনার পেছনে সরকারের কোনো মদত রয়েছে কি না, সে প্রশ্নও ছুড়ে দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। গতকাল জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান, শোক ও বিজয়ের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অনলাইনে যুক্ত হয়ে তারেক রহমান বলেন, যারা মব তৈরি করছে তারা কেন গ্রেপ্তার হচ্ছে না-সে প্রশ্ন তুলে তাদের প্রতি সরকারের প্রচ্ছন্ন মদত আছে কি না জানতে চান। তিনি বলেন, দলীয় অবস্থান থেকে যা যা করা দরকার, বিএনপি তা করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাহলে কেন বসে আছে? এ বাহিনী তাহলে চালায় কে? বিএনপি তো চালায় না। চালাচ্ছে তো সরকার।
তাহলে কেন সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তারেক রহমান বলেন, অন্যায়কারী যেই হোক না কেন, বিএনপি তাকে সমর্থন করে না। ষড়যন্ত্র শেষ হয়নি; বরং তা আরো জোরেশোরে শুরু হয়েছে।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমরা বারবার বলেছি অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। এরপরও কেন সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে না, তা সরকারের কাছেই প্রশ্ন। যুবদলের এক কর্মীকে রগ কেটে হত্যা করা হয়েছে, তা নিয়ে কেউ কথা বলছে না। অথচ এ নিয়ে কথা বললে বলা হয় আমরা লাশের রাজনীতি করছি।
একটি দল নিজের কর্মীদের নৃশংসভাবে খুন করছে : জামায়াত
জামায়াতে ইসলামী গতকাল বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে। উত্তরা পশ্চিম জোনের উদ্যোগে ১১নং সেক্টরের জমজম টাওয়ার থেকে বিক্ষোভ মিছিলটি শুরু হয়ে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে মুগ্ধ মঞ্চে সমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগর দক্ষিণের বিক্ষোভ মিছিল এবং তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তা মোড়ে মহানগর উত্তরের বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়।
এতে বলা হয়, দিন-দুপুরে প্রকাশ্যে একজন মানুষ আরেকজনকে এভাবে হত্যা করতে পারে, এটা বিশ্বাস করা যায় না। এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুবদলের যারা জড়িত, তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। অল্প সময়ের মধ্যে বিচার শেষ করে প্রকাশ্যে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
বিক্ষোভপূর্ব সমাবেশে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বলেন, আওয়ামী লীগের মতোই আরেকটি দল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও চাঁদাবাজি শুরু করেছে। বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, নিজেরাই নিজেদের দলীয় নেতাকর্মীদের নৃশংসভাবে খুন করছে। তারা প্রতিদিন নির্বাচন চাইলেও সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কথা বলছেন না। সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজদের কাছে জামায়াতে ইসলামী দেশ ছেড়ে দেবে না। জামায়াতে ইসলামী জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ, দুর্নীতিবাজ, খুনি, ধর্ষক, লুটেরা ও নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের প্রতিহত করবে।
সরকারকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, জাতির সঙ্গে তামাশা করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে ক্ষমতায় বসানো হয়নি। জনগণের জানমাল ও ইজ্জত রক্ষা করতে না পারলে অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া উচিত।
বিএনপি অন্যায়কে সমর্থন করে না : মির্জা ফখরুল
মিটফোর্ডে ব্যবসায়ী হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ টেনে গতকাল ছাত্রদলের এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ঘটনাগুলো ঘটছে, সরকারকে আহ্বান জানাব অতিদ্রুত তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীদের বের করে শান্তির ব্যবস্থা করুন। না হলে জাতি আপনাদের ক্ষমা করবে না।
বিএনপি কোনোদিন অন্যায়কে সমর্থন করে না দাবি করে দলটির নেতাকর্মীদের উদ্দেশ করে মির্জা ফখরুল বলেন, আপনারা যারা গণতন্ত্রের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন, আর কিছুদিন অপেক্ষা করুন এবং সবাইকে বিরত রাখুন কেউ যেন অন্যায় কাজ করতে না পারে। বিএনপি কোনোদিন কোনো অন্যায়কে সমর্থন করেনি, কখনো করবেও না।
এ সময় দ্রুত নির্বাচন চাই উল্লেখ তিনি আরো বলেন, নির্বাচন নেই বলে আজ দেশে এ ধরনের ঘটনাগুলো ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত ঘটনাগুলো ঘটছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে, মৃত্যু বাড়ছে, দুর্বৃত্তরা সুযোগ নিচ্ছে। কারণ তাদের পেছনে জনগণের সমর্থন নেই। কিন্তু একটি নির্বাচিত সরকার এলে নিঃসন্দেহে সেটা শক্তিশালী সরকার হবে।
রাজনৈতিক পরিচয়ের আড়ালে অপরাধীরা বেপরোয়া : সিপিবি
সিপিবির সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স গতকাল যৌথ বিবৃতিতে ঢাকা, খুলনা ও চাঁদপুরে ঘটে যাওয়া একাধিক নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও সহিংস ঘটনার তীব্র নিন্দা ও দেশের এ অবস্থায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ বলেন, রাজধানীর মিটফোর্ডে চাঁদা না দেওয়ায় ভাঙারি ব্যবসায়ী সোহাগকে পাথর দিয়ে মাথা থেঁতলে হত্যা করে যুবদলের মঈন ও তার সহযোগীরা।
এটি আবারও প্রমাণ করে, রাজনৈতিক পরিচয়ের আড়ালে অপরাধীরা কীভাবে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। খুলনায় যুবদল নেতা মাহবুবকে গুলি করে ও পায়ের রগ কেটে হত্যার ঘটনা আমাদের রাজনৈতিক পরিবেশে সহিংসতার ভয়াবহ রূপকে তুলে ধরেছে। চাঁদপুরে জুমার নামাজের পর মসজিদের ইমাম মাওলানা নূরুর রহমানকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে কুপিয়ে জখম করার ঘটনা ধর্মীয় উন্মাদনা ও উগ্র মনোবৃত্তির বিপজ্জনক রূপ। নেতৃবৃন্দ বলেন, এ তিনটি ঘটনাই দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটের চিত্র তুলে ধরেছে। এতে বোঝা যায় সহিংসতা, বিচারহীনতা ও উগ্রতা আমাদের সমাজকে কতটা গ্রাস করেছে। বিবৃতিতে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে উদ্যোগী ভূমিকা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, অবিলম্বে এসব ঘটনার সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও দ্রুত তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সন্ত্রাস ও অপরাধের জায়গা তৈরি হওয়া বন্ধ করতে হবে।
বিএনপি দলীয় চাঁদাবাজ-খুনিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ : ইসলামী আন্দোলন
গতকাল দেশব্যাপী চলমান সব ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, সহিংসতা ও ঢাকার মিটফোর্ডে সংঘটিত সোহাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের উত্তর গেট এলাকায় অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ অনুষ্ঠানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রিন্সিপাল মাওলানা সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল-মাদানী বলেন, মিটফোর্ডের নারকীর, পৈশাচিক হামলা আইয়ামে জাহেলিয়াতকেও হার মানিয়েছে। দেশব্যাপী খুন, ধর্ষণ, লুটতরাজ ও চাঁদাবাজিতে একটি দলের নাম বারবার উঠে আসছে। ধরা খেলে বহিষ্কার ছাড়া অপরাধের বিরুদ্ধে তারা কার্যত সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে না। বিএনপি দলীয় চাঁদাবাজ ও খুনিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা ক্ষমতায় যাননি, আপনাদের ক্ষমতায় পাঠানো হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আপনারা বারবার ব্যর্থতার প্রমাণ দিয়েছেন। কঠোর হস্তে চাঁদাবাজদের দমন করুন। চব্বিশের বাংলায় কোনো চাঁদাবাজ, ধর্ষক, ও খুনির ঠাঁই হবে না।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্লিপ্ততা হতাশাজনক : খেলাফত মজলিস
মিটফোর্ডে বীভৎস খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনের রাস্তায় প্রতিবাদ মিছিল করে খেলাফত মজলিস। এতে দলটির মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের বলেন, মিটফোর্ডে যে লোমহর্ষক ও বীভৎস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, তা জাহেলি যুগের বর্বরতাকে হার মানিয়েছে। একজন জীবন্ত মানুষকে প্রকাশ্য দিবালোকে তিলে তিলে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করা হচ্ছে আর লোকজন দাঁড়িয়ে তা দেখছে। ঘাতক যতই প্রভাবশালী হোক, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। হত্যাকাণ্ড-পরবর্তী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্লিপ্ত ভূমিকা হতাশাজনক। ইতোমধ্যে মূল অপরাধীদের বাদ দিয়ে মামলা করার অভিযোগ এসেছে। যৌথবাহিনীর টহল চললেও এখন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির দিকে। এভাবে একটি দেশ চলতে পারে না।
ইসলামী ঐক্যজোট
ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান ও নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি মাওলানা আব্দুর রকিব অ্যাডভোকেট, যুগ্ম মহাসচিব ও দলীয় মুখপাত্র মাওলানা মো. ইলিয়াস আতহারী যৌথ বিবৃতিতে ব্যবসায়ী সোহাগকে হত্যার ঘটনায় দোষীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে বিচারের দাবি করেন। এ ধরনের হত্যাকাণ্ড দেশের কোনো জায়গায় আর যেন না হয়, সেজন্য যৌথবাহিনীর দ্রুত অভিযানের আহ্বান জানান তারা।
এবি পার্টি
ঢাকায় পৈশাচিকভাবে ভাঙারি ব্যবসায়ী হত্যা প্রসঙ্গে গণঅভ্যুত্থানের অংশীদার রাজনৈতিক পক্ষগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, প্লিজ আর যাই করেন, হাসিনার আমলের গুম-খুনের কথা ভুলিয়ে দেওয়ার মতো নৃশংস আচরণ করবেন না। একই রকম খুন-খারাবি এবং পাশবিক আচরণ চলতে থাকলে আওয়ামী-হাসিনার আমলের নৃশংস গুম-খুনের কথা মানুষ ভুলে যাবে।
মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, কদিন আগেও আমরা সব রাজনৈতিক দল এক দাবিতে ঐক্যবদ্ধ ছিলাম। তাহলে আজ কেন এত বিভেদ? কেন আমরা একে অপরের দিকে আঙুল তুলছি?
বেপরোয়া চাঁদাবাজি ও দখলবাজির উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোনো সংস্কার দিয়ে আমাদের এ রোগ সারবে বলে মনে হয় না। ক্ষমতা পেলেই অন্যের অধিকার হরণের প্রবণতা পেয়ে বসলে কোনো দলের পক্ষেই দেশ পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।
হেফাজতে ইসলাম
পুরান ঢাকার মিটফোর্ডে এক ভাঙারি ব্যবসায়ীকে নৃশংসভাবে হত্যার তীব্র নিন্দা ও খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে যৌথ বিবৃতিতে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ও মহাসচিব আল্লামা সাজেদুর রহমান রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে দেশবাসী ও জুলাইয়ের বিপ্লবী ছাত্র-জনতাকে আবারও রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
শায়খ আহমাদুল্লাহ
এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের কঠোর শাস্তির দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন ইসলামি বক্তা ও আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শায়খ আহমাদুল্লাহ। গত শুক্রবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি লেখেনÑকিসাসই এসব কসাইয়ের একমাত্র সমাধান।
তিনি বলেন, যেভাবে যতটুকু জুলুম হবে, ঠিক সেভাবে ততটুকু প্রতিকারই হলো কিসাস। কেন কোরআনে কিসাসের কথা বলা হয়েছে, তা আমরা দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে উপলব্ধি করি। এ ধরনের চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের বিচার সর্বোচ্চ দুই মাসের মধ্যে শেষ করতে পারলে অপরাধের প্রবণতা কমে আসবে। প্রচলিত পদ্ধতিতে বিচারকাজ চললে অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে। তখন এ ধরনের অপরাধ কখনোই কমবে না।
যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের যৌথ সংবাদ সম্মেলন
প্রকাশ্যে মাথা থেঁতলে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিএনপির তিন সংগঠন জাতীয়তাবাদী যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল এবং ছাত্রদল গতকাল যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে। সেখানে মামলার এজহার থেকে মূল তিন আসামিকে বাদ ও আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়নি দাবি করে বিষয়টিকে রহস্যজনক বলে প্রশ্ন তোলা হয়।
তিন সংগঠনের পক্ষে জাতীয়তাবাদী যুবদলের সভাপতি এম মোনায়েম মুন্না এ প্রশ্ন তুলে বলেন, এ ঘটনায় যারা সরাসরি সংশ্লিষ্ট, ভিডিও ফুটেজ ও সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে যাদের দেখা গেছে, আশ্বর্যজনকভাবে তাদের মামলার প্রধান আসামি করা হয়নি। যারা প্রাণঘাতী আঘাতগুলো করেছে, তারা অদ্যাবধি গ্রেপ্তারও হয়নি।
এর কারণ আমাদের বোধগম্য নয়। তিনি বলেন, মামলার এজাহারে উল্লিখিত বাদীর মেয়ে বলেছেন, মামলার এজাহারে খুনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত তিন খুনিকে পুলিশ কৌশলে বাদ দিয়ে নিরাপরাধ তিনজনকে আসামি করেছে। ঘটনার ৬০ ঘণ্টার বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও খুনের প্রমাণাদি হাতে থাকা সত্ত্বেও অদ্যাবধি মূল আসামিদের গ্রেপ্তার করা গেল না… এটি একটি বিরাট প্রশ্ন ও রহস্য। কারা কেন এ তিন আসামিকে বাদ দিয়ে নতুন করে অন্যজনকে আসামি করলÑএটা আমরা জানতে চাই। বুধবারের ঘটনা শুক্রবার ব্যাপকভাবে প্রচার হয়েছে। দুদিন আগের ঘটনা কেন দুদিন পর প্রচার হলো, এর পেছনে কারা জড়িত, সেটাও খুঁজে দেখা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।
যুবদল সভাপতি মুন্না বলেন, এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ইন্ধনদাতা হিসেবে যাদের নাম এসেছে, মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে, তার মধ্যে পাঁচজনকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করেছি। সাংগঠনিক দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহির জায়গা থেকে ব্যবস্থাগুলো নিয়েছি।
তিনি বলেন, গত কয়েক মাসে সারা দেশের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেলেই চূড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। গত প্রায় এক বছরে আমরা আমাদের হাজারো নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করেছি।
শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ
ভাঙারি পণ্যের ব্যবসায়ী লাল চাঁদ সোহাগকে নৃশংসভাবে হত্যার সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। গতকাল ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে বিক্ষোভে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী অংশ নেন। ‘ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষার্থী সমাজ’ ব্যানারে এ বিক্ষোভ হয়। বিক্ষোভ চলাকালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘কণ্ঠে আবার লাগা জোর, চাঁদাবাজের কবর খোঁড়, ‘চাঁদাবাজ চাঁদা তোলে, ইন্টেরিম কী করে?’, ‘চব্বিশের হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার’, ‘কে দিল রে জানোয়ার, মানুষ মারার অধিকার’ ইত্যাদি স্লোগান দেন। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় (এনএসইউ), ইডেন কলেজ এবং ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বিক্ষোভ করেন।
এর আগে শুক্রবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেন বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। নিজ নিজ ক্যাম্পাসে তারা গভীর রাত পর্যন্ত বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এসব বিক্ষোভে হত্যায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করা হয়।
ছাত্রদলের বিক্ষোভ
রাজধানীর চকবাজারের মিটফোর্ডে ব্যবসায়ীকে নৃশংসভাবে হত্যার প্রতিবাদ এবং দোষীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) ছাত্রদল। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কাঁঠালতলা এলাকা থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। মিছিলটি পুরো ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে রায়সাহেব বাজার মোড় ঘুরে এসে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকায় কুপিয়ে হত্যার ঘটনা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি এবং সরকারদলীয় আশ্রয়ে বেড়ে ওঠা অপরাধীদের দৌরাত্ম্যের প্রতিফলন। ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা দেশের মানুষের নিরাপত্তাহীনতার চিত্র তুলে ধরেছে। তারা এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানান এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে দায়ী করে অবিলম্বে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।
শিবিরের বিক্ষোভ
সারা দেশে চাঁদাবাজি, হত্যা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে ইসলামী ছাত্রশিবির বিক্ষোভ মিছিল করেছে। শনিবার বেলা ১১টায় এ বিক্ষোভ মিছিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে গিয়ে শেষ হয়। কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক সিবগাতুল্লাহ বলেন, বুধবারের হত্যাকাণ্ড মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষকে এভাবে কেউ হত্যা করতে পারে না। সারা দেশে যেন চাঁদাবাজির মহোৎসব চলছে। ইতোমধ্যে দলীয় কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দেড় শতাধিক খুন হয়েছে। একটি দল ইতিহাস ভুলে আবারও ফ্যাসিবাদী আচরণে লিপ্ত হচ্ছে।
দেশকে প্রস্তরযুগে নিয়ে এসেছে অন্তর্বর্তী সরকার : ইনকিলাব মঞ্চ
গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদি বলেন, দেশটাকে প্রস্তরযুগে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরাসরি দায়ী এই অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকার পুলিশ সংস্কার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ন্যূনতম মনোযোগ দেয়নি।
তিনি বলেন, যেখানে প্রকাশ্যে পাথর দিয়ে মানুষ খুন হয়, সেখানেও পুলিশ মামলা নেয় না যতক্ষণ না ভিডিও ভাইরাল হয়। এটা রাষ্ট্রযন্ত্রের সম্পূর্ণ ব্যর্থতা। বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি দেখে মনে হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে দেশে একটি মাৎস্যন্যায় পরিস্থিতি তৈরি করছে, যার লক্ষ্য আরেকটি এক-এগারো বাস্তবায়ন।
আইন উপদেষ্টা
মিটফোর্ডের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচারে সরকার বদ্ধপরিকর উল্লেখ করে শনিবার সকালে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত পাঁচজনকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। পাশবিক এ হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হবে। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইন ২০০২-এর ধারা ১০- এর অধীন দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারের ব্যবস্থা করা হবে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ব্যবসায়ী লাল চাঁদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। এ ঘটনায় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বলেন, শুধু মিটফোর্ড নয়; সারা দেশে সংঘটিত এ ধরনের ঘটনায় পুলিশ তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছে। তবে মিটফোর্ডের ঘটনাটি বড়ই দুঃখজনক। একটি সভ্য দেশে এমন একটি ঘটনা কখনোই আশা করা যায় না। কোনো ঘটনা ঘটলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানাতে ও আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, বিভিন্ন ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অ্যাকশনে যাচ্ছে।