Image description

জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে পদ-পদবি খোয়ানো নেতা-কর্মীরা মহাবিপদে পড়েছেন। যদিও কিছু দলছুট নেতাকে সঙ্গে নিয়ে তারা কাউন্সিল করার ঘোষণা দিয়েছেন, কিন্তু তাতে তারা হালে কতদূর পানি পাবেন তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ রওশন এরশাদের নেতৃত্বে এর আগে পৃথক দল করতে ব্যর্থ হয়েছেন তারা। তা ছাড়া বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক ধারার বাইরে গিয়ে বড় কিছু করার নজির কম। 

দেশের বড় দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ভাঙার চেষ্টা অনেকবার হলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। বরং ভাঙতে যাওয়া নেতারাই আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে গেছেন। এই দুটি দলের মতো জাতীয় পার্টিতেও এখন উত্তরাধিকারের রাজনীতি চলছে। জাপার প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের রক্তের উত্তরাধিকার হিসেবে জি এম কাদের দলের হাল ধরেছেন। ব্যক্তি ইমেজের পাশাপাশি দলের প্রায় সব নেতা-কর্মীর সমর্থনও তার দিকে। এমন পরিস্থিতিতে বহিষ্কৃত নেতারা অনেকটাই দিশেহারা হয়ে পড়ছেন বলে জাপার নেতা-কর্মীরা মনে করছেন।

দলটির কো-চেয়ার‌ম্যান মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, ‘আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, চুন্নু সাহেবরা যে কাউন্সিলের আয়োজন করবেন, সেখানে চেয়ারম্যানকে বাদ দেবেন কেমন করে? চেয়ারম্যানকে বাদ দিয়ে কাউন্সিল হয়? নাজিউর রহমান, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, বেগম রওশন এরশাদরা দল থেকে বের হয়ে আরেকটা দল করেছেন। তাদের দল কি প্রকৃত জাতীয় পার্টি হতে পেরেছে? সেই ব্র্যাকেটবন্দি দলই তো থেকে গেছে। যারা দল থেকে বের হয়ে নতুন দল করেছেন, লোকে তাদের ভুঁইফোঁড় রাজনীতিবিদ বলেছেন।’
 
মোস্তফার ভাষ্যে, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার ও মুজিবুল হক চুন্নুর ভোটের মাঠে কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। 

তিনি বলেন, ‘তারা ভালো করেই জানেন, সোজা পথে নির্বাচন করে তারা কখনো জিততে পারবেন না। তাই তারা নানা দুরভিসন্ধি করেছেন। এবারও ভাবছেন কোনো একটা কারিশমা করে তারা আবারও নির্বাচিত হবেন। সেই চিন্তা-ভাবনা থেকে তারা নতুন দল করার কথা ভাবছেন। কিন্তু তৃণমূলের একজন নেতা-কর্মীও তাদের সঙ্গে নেই।’

রাজশাহী, সিলেট ও খুলনা বিভাগে জাতীয় পার্টির বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মীর সঙ্গে কথা বলেও বহিষ্কৃত নেতাদের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। খুলনার একজন নেতা প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘জি এম কাদের যাদের দল থেকে বহিষ্কার করেছেন, তাদের কোনো রাজনৈতিক অবস্থান কি এখন আছে? এতদিন তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে রাজনীতি করেছেন। আওয়ামী লীগের সময় তারা এমপি হয়েছেন, মন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু এখন তাদের কোনো গতি নেই। তারা দিশেহারা হয়ে গেছেন। ষড়যন্ত্র তারা আগেও করেছেন, এখনো করছেন। আমরা অনেক দিন ধরে তাদের বিরুদ্ধে পার্টির ফোরামে প্রকাশ্যে কথা বলেছি। চেয়ারম্যান এতদিনে আমাদের দাবিতে সায় দিলেন। এখন তিনি দলটাকে নিজস্ব ধারায় পরিচালনা করবেন।’

দলে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে গত সোমবার জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কো-চেয়ার‌ম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নুকে দলের সব পদ-পদবি থেকে অব্যাহতি দেন জি এম কাদের। তাদের সঙ্গে জাপার প্রেসিডিয়ামের আরও সাতজন নেতাকে তিনি অব্যাহতি দেন। 

এই ১০ নেতা মঙ্গলবার (৮ জুলাই) সকালে রাজধানীর গুলশানে সংবাদ সম্মেলন করে জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন। 

তারা দাবি করেন, জাতীয় পার্টিকে তারা ভাঙতে দেবেন না। দ্রুত দলের দশম জাতীয় কেন্দ্রীয় সম্মেলন আয়োজন করে জি এম কাদেরের ‘অগণতান্ত্রিক’ সিদ্ধান্তের জবাব দেবেন বলে হুঙ্কারও দেন। তারা বলেন, জি এম কাদের বিধিবহির্ভূতভাবে নেতাদের পদ-পদবি থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। এই বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত তারা মানেন না।

তবে জাপার নবনিযুক্ত মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারী এ বিষয়ে খবরের কাগজকে জানান, জাতীয় পার্টিতে সম্প্রতি যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়েছে, সেগুলো সম্পূর্ণ গঠনতন্ত্র মোতাবেক করা হয়েছে। 

যেভাবে বিতর্কের সূত্রপাত

গত ২৫ মে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সভায় দলের দশম জাতীয় কাউন্সিল আয়োজন নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত হয়। জি এম কাদের তখন দলের কাউন্সিল অধিবেশন আয়োজন নিয়ে সায় দেন। তবে বাংলাদেশ চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের হল বরাদ্দ না পাওয়ায় তিনি কাউন্সিল আপাতত স্থগিত ঘোষণা করেন। এ নিয়ে তার সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ান ওই তিন শীর্ষ নেতা। একপর্যায়ে তারা জি এম কাদেরের নেতৃত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলেন। তারা নিজেরাই কাউন্সিল আয়োজনের নানা তোড়জোড় শুরু করেন। গত ২৮ জুন রাজধানীর কাকরাইলে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে তারা কাউন্সিল অধিবেশন আয়োজনের ঘোষণা দেন। তবে তৃণমূলের সমর্থন না পেয়ে তারা সেই কাউন্সিল আয়োজন করতে ব্যর্থ হন।
 
বহিষ্কৃতদের সংবাদ সম্মেলন, বললেন ‘দল ভাঙতে দেব না’

গতকালের সংবাদ সম্মেলনে ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছে আমরা গঠনতন্ত্রবিরোধী কাজ করেছি। আমরা বিবৃতি দিয়ে বলেছি, চেয়ারম্যানের একক ক্ষমতার ধারা বাতিল করতে বলেছি। আমরা হিসাবে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে এবং বৃহত্তর ঐক্যের কথা বলেছি। আমাদের এসব কাজ কোনোভাবে দলের গঠনতন্ত্রবিরোধী কাজ হিসেবে গণ্য হতে পারে না।’

তিনি দাবি করেন, জাপার দশম কাউন্সিল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে দলে কোনো কোরামের আয়োজন করা হয়নি। 

বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গুলশানে সংবাদ সম্মেলনে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, মো. মুজিবুল হক চুন্নুসহ দলটি থেকে বহিষ্কৃত নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এ সময় রওশন এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির নেতা কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, সাহিদুর রহমান টেপাও উপস্থিত ছিলেন। 

মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘আমি এমন কী অপরাধ করলাম, যার জন্য পার্টির প্রাথমিক সদস্য পদ থেকেও আমাকে অব্যাহতি দিলেন চেয়াম্যান জি এম কাদের। চেয়ারম্যানের সর্বময় ক্ষমতার ধারা কোনো রাজনৈতিক দলে নেই। আমি বললাম, এই ধারা পরিবর্তন করা দরকার। তিনি ক্ষেপে গেলেন। বিগত নির্বাচনে আড়াই কোটি টাকার মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে। সেই টাকার কোনো হিসাব দেননি। পার্টির চাঁদা এবং অনুদানের কোনো হিসাব দেননি তিনি। আমরা তার কাছে এসবের হিসাব চেয়েছি। এটাতো গঠনতন্ত্রবিরোধী হতে পারে না।’

এ সময় চুন্নু বলেন, ‘একতরফাভাবে নেতা নির্বাচিত হতে জি এম কাদের আমাদের দল থেকে বহিষ্কার করেছেন। কিন্তু আমরা জাতীয় পার্টির রাজনীতি ছাড়ব না। দলে আমাদের অবদান কোনো অংশে কম না। আমরা কোনোভাবে দল ভাঙতে দেব না।’ 

সব সিদ্ধান্ত গঠনতান্ত্রিক: শামীম হায়দার পাটোয়ারী 

বহিষ্কৃত নেতাদের সংসদ সম্মেলনের পর জাপার মহাসচিব ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী খবরের কাগজকে বলেন, ‘জাতীয় পার্টিতে সম্প্রতি যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়েছে, সেগুলো সম্পূর্ণ গঠনতন্ত্র মোতাবেক করা হয়েছে। জেলা কমিটির সভাপতি, সেক্রেটারির মতামত নেওয়া হয়েছে; সেই সিদ্ধান্ত প্রেসিডিয়াম সভায় চূড়ান্ত হয়েছে। প্রেসিডিয়াম সভার রেজল্যুশনের ভিত্তিতে চেয়ারম্যান এই পদক্ষেপগুলো নিয়েছেন, মানে নেতা-কর্মীদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।’

মহাসচিবের পদে শামীম হায়দারকে নিয়োগ করায় বিতর্ক তুলেছেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। এ বিষয়ে শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘মহাসচিবের পদ শূন্য হয়েছে। সেই শূন্য পদে সম্পূর্ণ গঠনতান্ত্রিক উপায়ে, তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে আমাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।’ 

কাউন্সিল আয়োজন নিয়ে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, চুন্নুরা যেসব অভিযোগ উত্থাপন করেছেন, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে বলে মন্তব্য করেন জাপার নতুন মহাসচিব।

তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি জাতীয় পার্টির সভায় ৭৮টি ইউনিটের মধ্যে ৬৫টি ইউনিটের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এক বাক্যে জি এম কাদেরের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছেন। তারা বিকল্প কাউন্সিল আয়োজনের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। এ নিয়ে যারা বিতর্ক তুলছেন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে চেয়ারম্যানকে তৃণমূলই অনুরোধ করেছে। সিদ্ধান্ত নিতে সভায় কোরাম না হওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, এটা সত্যি না। কোরাম ছিল। সম্পূর্ণভাবে গঠনতন্ত্র মেনে সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এখন কাউন্সিল হলে জি এম কাদেরই ফের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবেন।’