Image description

জাতীয় পার্টির তিন জ্যেষ্ঠ নেতাসহ ১৬ জন প্রেসিডিয়াম সদস্য এক মঞ্চে এসে বলেছেন, তাঁরা জাতীয় পার্টি ছাড়বেন না। যে প্রক্রিয়ায় চেয়ারম্যান তাঁদের অব্যাহতি দিয়েছেন, সেটি বেআইনি। তাঁরা দলের জাতীয় সম্মেলনে যাবেন।

সদ্য অব্যাহতিপ্রাপ্ত জাতীয় পার্টির কো–চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, মো. মুজিবুল হকসহ (চুন্নু) দলের প্রেসিডিয়াম সদস্যরা মঙ্গলবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন।

গুলশানে রুহুল আমিন হাওলাদারের ব্যক্তিগত কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এই সংবাদ সম্মেলনে ১৬ জন প্রেসিডিয়াম সদস্য ছাড়াও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের চার উপদেষ্টা, দুই যুগ্ম মহাসচিবসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ২১ জন নেতা উপস্থিত ছিলেন।

১৬ জন সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ বিপুলসংখ্যক কেন্দ্রীয় নেতার উপস্থিতিতে দলীয় চেয়ারম্যানের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে এই সংবাদ সম্মেলনকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীদের অনেকে। সেটি দলে ভাঙনপ্রক্রিয়ার শুরু কি না, সে প্রশ্ন উঠছে।

অবশ্য সদ্য অব্যাহতি পাওয়া মহাসচিব মুজিবুল হক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমরা জাতীয় পার্টি ছাড়ব না। আমরা জাতীয় পার্টি ভাঙতে দেব না। আমাদের অবদান দলের জন্য সবচেয়ে বেশি। আমরা কাউন্সিলে যাব।’

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, রুহুল আমিন হাওলাদার, মুজিবুল হকসহ এই অংশটির জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা দলে ভাঙন চান না। তাঁদের মূল লক্ষ্য, গঠনতন্ত্রের ২০/১(ক) ধারার সংশোধন করে সমন্বিত নেতৃত্বে দল পরিচালনা করা। এ লক্ষ্যে তাঁরা আইনি পদক্ষেপে যাবেন। তাঁরা আশা করেন, দলীয় গঠনতন্ত্রের চরম অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক ও স্বেচ্ছাচারী ধারাটির সংশোধনে এবার তাঁরা সফল হবেন।

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ দাবি করেন, জাতীয় পার্টি থেকে মহাসচিব ও দুই কো-চেয়ারম্যানকে অব্যাহতি দিয়ে দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, সেটি ‘বেআইনি’ এবং তাঁরা জাতীয় পার্টিতে ‘স্বপদেই বহাল’ আছেন। তিনি বলেন, ‘২৮ তারিখের কোরামবিহীন প্রেসিডিয়াম বৈঠকটি গঠনতন্ত্র মোতাবেক ডাকা হয়নি। সেই প্রেসিডিয়ামের মিটিংয়ের দোহাই দিয়ে যে সিদ্ধান্ত উনি (জি এম কাদের) নিয়েছেন, এই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণরূপে বেআইনি ও অবৈধ। সুতরাং আমরা সবাই পার্টিতে স্বপদে বহাল আছি এবং পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুই আছেন।’

গত সোমবার জাতীয় পার্টির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ২৮ জুন দলের প্রেসিডিয়াম সভার সিদ্ধান্তে কো–চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার ও মো. মুজিবুল হককে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

জাতীয় পার্টির নবনিযুক্ত মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিছু লোক চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে জেলা ও মহানগর কমিটির নেতারা দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ এনেছেন এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন। পরে প্রেসিডিয়াম সদস্যদের সভায় তাঁদের অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা অব্যাহতি পেয়েছেন। আমি মনে করি, এতে দলে ভাঙন নয়, এখন দল নবরূপে উন্মোচিত হবে।’

‘কাউন্সিলেই সব হবে’

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, ‘আমরা এখনো বলব, আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাউন্সিল করি। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব কে থাকবেন, কে থাকবেন না। আপনি তো পার্টির চেয়ারম্যান আছেন। কাউন্সিলে সব হবে। কাউন্সিলই দলের সর্বোচ্চ অঙ্গ।’ তিনি বলেন, কাউন্সিল ঘোষণা করার পরে কাউকে সরানো যায় না। এই সিদ্ধান্ত কাউন্সিল থেকেই আসতে হবে। কাউকেই কারণ দর্শানো নোটিশ ছাড়া অব্যাহতি দেওয়া যাবে না। এটা ‘ন্যাচারাল জাস্টিস’ বিরুদ্ধ। প্রেসিডিয়ামের সিদ্ধান্তও যদি বাস্তবায়ন করতে হয়, তাহলেও তাঁকে কারণ দর্শানো নোটিশ দিতে হবে।

আনিসুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা দুইটা বিবৃতি দিয়েছি ইতিমধ্যে। আমরা বলেছি, গঠনতন্ত্রের ২০/১/ক ধারা—এটা বাতিল করেন। আমরা পার্টির আর্থিক স্বচ্ছতা চাই এবং পার্টির বৃহত্তর ঐক্য চাই। এই তিনটা জিনিসের কথা আমরা বারবার বলে আসছি। পাবলিকলি (প্রকাশ্যে) আমরা এমন কিছু করি নাই, যেটাতে কেউ বলতে পারবে যে আমরা পার্টির স্বার্থের বিরুদ্ধে কথা বলেছি। আমরা মনে করি, আমরা স্বপদে আছি।’

চেয়ারম্যান যেসব নিয়োগ দিয়েছেন, সেগুলো অবৈধ দাবি করে আনিসুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমানে যাঁকে (শামীম হায়দার পাটোয়ারী) মহাসচিব...স্বঘোষিত বলব। পার্টির মহাসচিব একজনই, তিনি হচ্ছেন মুজিবুল হক চুন্নু। আজকে এই সংবাদ সম্মেলনে যাঁরা বসে আছেন, আমরা সবাই পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আমরা এই পার্টিতে আছি এবং আমরা আশা করি এই পার্টিতে থাকব।’

মৃত্যুর আগে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তাঁকে ‘অ্যাক্টিং চেয়ারম্যান’ ঘোষণা করেছিলেন দাবি করে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, ‘জি এম কাদের সাহেব, আমিও এই পার্টির অ্যাক্টিং চেয়ারম্যান ছিলাম। আমাকে যখন অ্যাক্টিং চেয়ারম্যান করেন, তখন এইচ এম এরশাদ সাহেব সংবাদ সম্মেলন করে আমাকে এই পদে বসিয়েছিলেন। আর জি এম কাদের কীভাবে অ্যাক্টিং চেয়ারম্যান হন? রাতের অন্ধকারে যে লোকটি (এইচ এম এরশাদ) মৃত্যুপথযাত্রী, রাত ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে তাঁকে ঘুম থেকে উঠিয়ে, জোর করে সই নেওয়া হয়।’

এটা হচ্ছে, জাস্ট মিলিটারি ক্যু যেমন হয়, ঠিক সেই রকম—এ মন্তব্য করে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, ‘আপনারা বলতে পারেন, সেই সময়ে কেন প্রতিবাদ করেননি? কারণ, আমাদের পার্টি এমনিতেই সরকারের অত্যাচারে জর্জরিত ছিল, এরশাদ সাহেব খুব অসুস্থ ছিলেন, তাঁর দিকে তাকিয়ে আমরা কিছু করিনি। একটা গণতান্ত্রিক পার্টির ক্ষমতা হস্তান্তর রাতের অন্ধকারে এভাবে হয় না। জি এম কাদেরের প্রতিটা জিনিসেই অগণতান্ত্রিক মনোভাব প্রকাশ পায়, স্বৈরাচারী মনোভাব প্রকাশ পায়।’

তাঁদেরকে জি এম কাদেরের অব্যাহতি দেওয়ার কথা উল্লেখ করে রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, ‘কোনো সুস্থ রাজনীতিবিদ এ ধরনের কাজ করতে পারেন না। আমাদের ঘামে, আমাদের পরিশ্রমে… আমাদের অব্যাহতি দিয়েছেন, সদস্য পর্যন্ত রাখেননি। এটা কি রাজনৈতিক আচরণ?’

জি এম কাদেরের প্রতি আহ্বান জানিয়ে জাতীয় পার্টির প্রবীণ নেতা রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, ‘আমরা আপনাকে বহিষ্কার করি নাই, আমরা আপনাকে ফেলে দিতে চাই না। আবারও বলব, দল ভাঙবে, দল ছোট হবে, এই রাজনীতি আমরা করব না।’

জাতীয় পার্টির রওশন এরশাদ অংশের নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘আপনারা জানেন, জাতীয় পার্টি ছোট হতে হতে আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। আমি আরেকটা জাতীয় পার্টির নির্বাহী চেয়ারম্যান। আমার সঙ্গে আরও অনেকে আছেন।’ জি এম কাদেরের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আজকে এই কী দেখতেছি? সবাইকে বের করে দেবেন? একা থাকবেন। একা একটি কোম্পানি করা যায়, ঘরসংসার করা যায়, বউয়ের সঙ্গে রাজনীতি করা যায় না।’

‘আমার দুঃখ একটাই’

জি এম কাদেরের উদ্দেশে প্রশ্ন রেখে মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘আমাকে পার্টির মহাসচিব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, কোনো আপত্তি নেই। আমি এমন কী অপরাধ করলাম, যার জন্য পার্টির প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে পর্যন্ত অব্যাহতি দিলেন?’

পার্টির গঠনতন্ত্রের ২০/১ ক ধারাকে স্বৈরতান্ত্রিক আখ্যায়িত করে তা বাদ দিতে জি এম কাদেরকে ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করেছেন জানিয়ে মুজিবুল হক বলেন, ‘এমন হয়েছে যে ২৮ জন কর্মীকে পদোন্নতি দিয়েছেন (চেয়ারম্যান), এটা মহাসচিব হিসেবে আমি জানি না। আমি বলেছিলাম, এটা একটা অগণতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক ধারা, এটা বাদ দেন। উনি পরিবর্তন করেন নাই।’

সংবাদ সম্মেলনে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার ও মো. মুজিবুল হক ছাড়াও আরও উপস্থিত ছিলেন কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, সাইদুর রহমান টেপা, শফিকুল ইসলাম সেন্টু, মোস্তফা আল মাহমুদ, এটি ইউ তাজ রহমান, নাজমা আকতার, জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া, আরিফুর রহমান খান, জহিরুল ইসলাম জহির, সোলায়মান আলম শেঠ, নাসরিন জাহান রত্না, মাসরুর মওলা প্রমুখ।

জানা গেছে, আনিসুল ইসলাম মাহমুদদের এই সংবাদ সম্মেলনের প্রতিক্রিয়া জানাবেন জি এম কাদেরের অনুসারীরা। বৃহস্পতিবার জাতীয় পার্টির বনানীর কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে তাঁরা বক্তব্য তুলে ধরবেন।