
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের চাতলপাড় ইউনিয়ন যেন এখন এক পরিত্যক্ত জনপদ। ছাত্রদল নেতা মো. সোহরাব মিয়ার হত্যাকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া সহিংসতার পর গ্রাম ছেড়েছেন শতাধিক পরিবার। প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছে ঘরবাড়ি, চলছে নির্লজ্জ লুটপাট। আতঙ্কে শুধু পুরুষ নয়, পালিয়েছেন নারী ও শিশুরাও। কেউ গেছেন আত্মীয়ের বাড়িতে, কেউ আশ্রয় নিয়েছেন খোলা আকাশের নিচে।
গত শনিবার মোল্লা ও উল্টা গোষ্ঠীর মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষে প্রাণ হারান ছাত্রদলের ইউনিয়ন নেতা সোহরাব (২৬)। ঘটনার পর থেকে পুরো এলাকায় নেমে আসে আতঙ্কের ছায়া। প্রতিপক্ষের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ চলে অবিরত। ঘটনার চারদিন পর থানায় মামলা হয়। নিহতের ভাই মোজাহিদ মিয়া বাদী হয়ে ৬০ জনকে আসামি করে নাসিরনগর থানায় মামলা করেন। আসামিদের মধ্যে রয়েছেন ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি মো. গিয়াস উদ্দিন, বিএনপির সহ-সভাপতি মো. আফসর মিয়া, ছাত্রদলের সহ-সভাপতি শরীফ মিয়া ও জাকারিয়া আহমেদ, এবং কৃষক দলের সদস্য সচিব সিরাজুল ইসলাম।
স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, চাতলপাড় ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মোতাহার মিয়া (মোল্লা গোষ্ঠী) ও যুবদলের সভাপতি গিয়াস উদ্দিন (উল্টা গোষ্ঠী)–এই দুই পক্ষের মধ্যে দীর্ঘদিনের আধিপত্য বিরোধের সূত্র ধরেই সংঘর্ষ বাঁধে। সংঘর্ষে প্রাণ হারান ইউনিয়ন ছাত্রদলের সহ-সাধারণ সম্পাদক মো. সোহরাব মিয়া। এরপর শুরু হয় প্রতিশোধপরায়ণ সহিংসতা—মোল্লা গোষ্ঠীর বাড়িঘর, দোকানপাটে হামলা, লুটপাট ও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
শুধু সংঘর্ষে জড়িত পক্ষের ঘর নয়, নিরপেক্ষরাও ছাড় পাননি। উপজেলা জাসাসের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সোহেল আহমেদের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও হামলা চালানো হয়।
এদিকে, এলাকায় অবস্থিত কাঠালকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নেমে এসেছে ভয়ের ছায়া। প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে তিন শতাধিক স্কুলে আসেনি। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির ২১ শিক্ষার্থী ভয়ে প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। এমনকি শিক্ষকদের একজনও আতঙ্কে স্কুলে হাজির হননি। প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন তাঁরা।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তুহিনা বেগম জানান, শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই আতঙ্কে রয়েছেন। শত শত শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। অভিভাবকদের ফোনেও সাড়া মিলছে না—কারণ, তারা কেউ এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন।
উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. ইসহাক মিয়া জানান, শিক্ষার্থীদের নিরাপদে বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে শিক্ষা কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গতকাল সোমবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পথে পথে ছড়িয়ে আছে পোড়া টিন, ভাঙা কাচ ও ধ্বংসস্তূপ। কিছু কিছু বাড়ি থেকে তখনও ধোঁয়া উঠছে। জমিতে আশ্রয় নিয়েছেন নারী ও শিশুরা।
ষাটোর্ধ্ব মমতাজ বেগম বলেন, ‘আমরা কোনো পক্ষ নই, তবুও আমাদের বাড়ি হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেছে মোল্লা গোষ্ঠীর লোকজন। জমিতে ঘুমাইতেছি। তিন দিন খাই নাই। ঘরের পানির টিউবওয়েল পর্যন্ত তুলে নিয়ে গেছে।’
সাফিয়া বেগম জানালেন, ‘আমার স্বামী অসুস্থ। একমাত্র ছেলে ঋণ নিয়ে ঘর তুলেছিল। সব পুড়িয়ে দিয়েছে।’
সুফিয়া নামের এক বৃদ্ধা বলেন, ‘চোখের সামনে পুড়তে দেখলাম সব। বাধা দেওয়ার কেউ ছিল না। ছেলে পালিয়ে গেছে। আমরা কোথায় যাব?’
অন্তঃসত্ত্বা কুহিনূর বেগম বলেন, ‘আমাকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে গলার সোনার হার লুটে নেয়। ওষুধ, টাকা, সব নিয়ে গেছে। হাত-পা বেঁধে রেখে গেছে।’
চাতলপাড় বাজারের ছয়টি দোকানেও হামলা ও লুটপাট হয়। এর মধ্যে রয়েছে চালের আড়ৎ, মোবাইল ও বিকাশের দোকান, রড-সিমেন্টের দোকান ও ফ্রিজের শোরুম। ক্ষতিগ্রস্তদের দাবি, এসব দোকান থেকে প্রায় ২০ কোটি টাকার মালামাল লুট হয়েছে। এমনকি ১০টি গরু ও কৃষকের গোলা থেকে প্রায় এক হাজার মণ ধানও নিয়ে গেছে হামলাকারীরা।
ব্যবসায়ী হামজা জানান, তাঁর দোকানে থাকা ২৫ লাখ টাকা নগদসহ রড-সিমেন্টের মালামাল লুটে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে বলেন, ‘আমার সব শেষ। এখন পথে বসা ছাড়া উপায় নাই।’
মোল্লা গোষ্ঠীর নেতা গিয়াস উদ্দিন অভিযোগ করে বলেন, ‘আমাদের গোষ্ঠীর বাড়িঘর ও দোকানে হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট চালানো হয়েছে। জুলহাস মিয়া, শিশু মিয়া, আলাউদ্দিনসহ পাঁচজনের বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রায় ৪০টি বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে।’
তিনি আরও জানান, স্থানীয় বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল ও জাসাস নেতাদের বাড়িও হামলা থেকে রক্ষা পায়নি।
নিহত সোহরাবের বাড়িতে চলছে মাতম। মা চান বানু বার বার বিলাপ করছিলেন, ‘তোমরা আমার ছেলেরে ফিরায়া দাও।’
সোহরাবের ভাই মোজাহিদ মিয়া বলেন, ‘আমি ভাইয়ের হত্যার বিচার চাই। তবে আমাদের পক্ষ থেকে হামলা-লুটপাটে কেউ জড়িত না।’
চাতলপাড় ফাঁড়ির তদন্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের জনবল কম, যানবাহনের ব্যবস্থাও নেই। ফলে ওই এলাকায় যাওয়া কঠিন। নিহতের স্বজনেরা টেঁটা-বল্লম ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে পাহারা দিচ্ছে, আমরাও নিরাপদ নই।’