
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বেশির ভাগ সংস্কার প্রস্তাবেই একমত হয়েছে বিএনপি। চারটি কমিশনের মোট ৫৮৭ প্রস্তাবের মধ্যে ৪৩৬টিতেই একমত দলটি। এর মধ্যে দুদক সংস্কার কমিশনের ৪৭ সুপারিশের মধ্যে ৪৬টিতে, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ২০৮ সুপারিশের মধ্যে ১৮৭টিতে, বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের ৮৯ সুপারিশের ৬২টিতে এবং নির্বাচনিব্যবস্থা বিষয়ক সংস্কার কমিশনের ২৪৩ সুপারিশের মধ্যে ১৪১টিতে একমত বিএনপি। এছাড়া আরও ২৮টি প্রস্তাবে আংশিক একমতও পোষণ করেছে দলটি।
ছয়টি সংস্কার কমিশনের মধ্যে পুলিশ সংস্কার কমিশনের বিষয় এখনো চূড়ান্ত আলোচনা হয়নি। তবে এ কমিশনের প্রস্তাবে থাকা র্যাব বিলুপ্তিসহ প্রায় সব বিষয়েই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে। আর সংবিধান সংস্কার কমিশনের ১৩১টি সুপারিশে বিএনপি দফাওয়ারি মতামত দিয়েছে। এতেও অধিকাংশ সুপারিশে একমত দলটি।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ৭০ অনুচ্ছেদ ও প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, জাতীয় সংসদে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদ বিরোধী দলকে দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চারটিসহ আসন সংখ্যার অনুপাতে সভাপতির পদ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাসংক্রান্ত আর্টিকেল ৪৯ পরিবর্তনে একমত দলটি। আরও একমত পোষণ করেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন, ন্যায়পাল আইন যুগোপযোগী করা, জাতীয় সংসদের নির্বাচনি এলাকার সীমানা বিন্যাসে সংস্কার আনার জন্য সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ সংশোধন ও আইনের মাধ্যমে বিশেষায়িত কমিটি গঠন, উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালত সম্প্রসারণ, জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধান পরিবর্তন ও সংশোধনও। বিএনপি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংস্কার নিয়ে কাজ করছেন-বিএনপির এমন দুজন স্থায়ী কমিটির সদস্য অভিন্ন তথ্য দিয়ে জানান, ছয়টি সংস্কার কমিশনের মধ্যে পুলিশ সংস্কার কমিশনের বিষয় এখনো আলোচনায় আসেনি। তবে ওই কমিশনে দলের প্রতিনিধিদের কাছে যতটুকু জেনেছেন তাতে র্যাব বিলুপ্তিসহ প্রায় সব বিষয়েই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে। দুদক সংস্কার কমিশনে কিছু ছাড় দিয়ে ৪৭টি সুপারিশের ৪৬টিতেই সম্মতি জানিয়েছেন। শুধু ২৯নং সুপারিশে আইনের মাধ্যমে করার পরিবর্তে আদালতের অনুমতি নেওয়ার বিদ্যমান বিধান অব্যাহত রাখার কথা বলেছে দল। এটা না হলে দুদকের কার্যক্রমকে অহেতুক বিলম্বিত করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ২০৮টি সুপারিশের মধ্যে ১৮৭টি প্রস্তাবে একমত হয়েছে এবং ৫টিতে আংশিক একমত হয়েছে। পাঁচটি সুপারিশে ভিন্নমত প্রদান করেছে। ১১টি প্রস্তাবে একমত হতে পারেনি-যেগুলো দেশে প্রদেশ সৃষ্টি, পদোন্নতি ও অন্যান্য প্রশাসনিক অসংগতির বিষয়ে। এর মধ্যে পদোন্নতির বিষয়ে আপিল বিভাগের রায় কার্যকর রয়েছে।
তারা বলেন, বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ৮৯টি সুপারিশের মধ্যে ৬২টি সুপারিশে একমত হয়েছে এবং ৯টিতে আংশিকভাবে একমত হয়েছে। ১৮টিতে ভিন্নমত পোষণ করে যুক্তিসহ পরামর্শ দিয়েছে। এর মধ্যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাবিষয়ক সব প্রস্তাবে একমত হয়েছে। তবে এর কিছু বিষয়ে নির্বাচিত সংসদে আইন প্রণয়ন কিংবা ইতোমধ্যে কোনো অধ্যাদেশ হলে তা সংসদে রেটিফাই ও সাংবিধানিক সংশোধনীর প্রয়োজন হবে।
নেতারা জানান, নির্বাচনিব্যবস্থা বিষয়ক সংস্কার কমিশনের ২৪৩টি সুপারিশের মধ্যে ১৪১টিতে বিএনপি একমত হয়েছে এবং ১৪টিতে আংশিকভাবে একমত হয়েছে। ৬৪টিতে ভিন্নমতসহ একমত হয়েছে। অর্থাৎ এসব বিষয়ে পরিবর্তনে একমত হয়ে বিভিন্ন আইনে ও বিধিতে সংশোধনী অধিকতর কার্যকর হবে, তা প্রস্তাব করেছে। ২৪টি বিষয়ে একমত হতে পারেনি। এর মধ্যে নির্বাচনিব্যবস্থা সংক্রান্ত ১২টি আইন ও ছয়টি নীতিমালা আছে। এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় সংবিধানেও নির্দিষ্ট বিধান আছে। এসব প্রস্তাবের বেশ কয়েকটি বাস্তবায়নযোগ্য নয় এবং কয়েকটি নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনে স্পষ্টতই বাধা সৃষ্টি করে তাদের সাংবিধানিক স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করবে।
এছাড়া দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সংবিধান সংস্কার কমিশনের ১৩১টি সুপারিশে বিএনপি দফাওয়ারি মতামত দিয়েছে। অধিকাংশ সুপারিশে একমত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ৭০ অনুচ্ছেদ ও প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ। দুই বিষয়ে বিএনপিই ছাড় দিয়েছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্দিষ্ট করে দেওয়ার বিধান বিশ্বের কোথাও না থাকার পরেও ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে দলটি সম্মত হয়েছে। প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়েও নিজেদের প্রস্তাব থেকে সরে এসে একমত হয়েছে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাসংক্রান্ত আর্টিকেল ৪৯ পরিবর্তনে বিএনপি সম্মত হওয়ায় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে। সব বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সম্মত হয়ে তা বিচার বিভাগের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বাস্তবায়নে বিএনপি পরামর্শ দিয়েছে। কারণ ইতোপূর্বে ১৯৮৮ সালে এমন উদ্যোগকে উচ্চ আদালত বাতিল করে দিয়েছিলেন। এছাড়া জরুরি অবস্থা ঘোষণাসংক্রান্ত সংবিধানে যে বিধান আছে সেখানে পরিবর্তন ও সংশোধনের বিষয়ে একমত বিএনপি। দলটি বলছে, যেহেতু জরুরি অবস্থা অতীতে অপব্যবহার হয়েছে বলে সবাই মত দিয়েছেন, তাই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে কোনোভাবেই তা যেন রাজনৈতিকভাবে অপব্যবহার করা না হয়। উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালত সম্প্রসারণেও একমত দলটি। তবে এক্ষেত্রে কিছু বিষয় সুনির্দিষ্ট করে মত দেওয়া হয়েছে।
দলটি বলছে, এমন বহু সংস্কার প্রস্তাবে শুধুই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে বিএনপি একমত হয়েছে। যেগুলো বাস্তবায়ন অত্যন্ত দুরূহ এবং যে উদ্দেশ্যে এসব প্রস্তাব তা অর্জনের সাফল্য প্রশ্নসাপেক্ষ। রাষ্ট্র পরিচালনার এবং সংসদীয় কার্যক্রম দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে বিএনপি যুক্তিগ্রাহ্য মতামত দিয়ে দায়িত্ব পালন করেছে।
দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলেন, বিভিন্ন বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছার জন্য বিএনপির প্রতিনিধিরা সভায় অংশগ্রহণকারী অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা এবং অনেক বিষয়ে ছাড় দিয়ে হলেও একমত হয়ে কমিশনের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াসকে সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু দীর্ঘ আলোচনার পর সংস্কার কমিশনগুলো যেসব প্রস্তাব পেশ করেছেন, তার বিপরীত কিংবা নতুন নতুন প্রস্তাব উত্থাপন এবং তা নিয়ে অনেক সময় অচলাবস্থা সৃষ্টির কারণে কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে। ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী বলেই বিএনপির প্রতিনিধিরা ধৈর্য ধরে আলোচনা শুনছেন এবং তথ্যপ্রমাণ ও যুক্তি দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে কমিশনকে সহযোগিতা করছেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, ‘রাষ্ট্র পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার নামে জনগণের নির্বাচিত সংসদ, নির্বাচিত সরকার তথা রাষ্ট্র কাঠামোকে দুর্বল ও অকার্যকর করার কোনো প্রস্তাবের যুক্তিসংগত বিরোধিতা সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বলে আমরা মনে করি। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনগণের কাছে দায়বদ্ধ এবং জনগণকে জবাবদিহি করতে বাধ্য কোনো সরকারকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় দুর্বল ও অকার্যকর করা অবশ্যই সংস্কারের মূল আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ফলে এমন কোনো প্রয়াসে সমর্থন জানানো সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যের পরিপন্থি বলে তা থেকে বিরত থাকার অর্থ সংস্কার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা নয় বরং এই প্রক্রিয়াকে সহযোগিতা করা।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থান রোধে বিএনপিই সবচেয়ে সক্রিয়। ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানকে অধিক ক্ষমতা দিলে যেমন ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়, ঠিক তেমনি নির্বাচিত সরকার এবং সংসদকে ক্ষমতাহীন করলে রাষ্ট্র দুর্বল, ভঙ্গুর ও অকার্যকর হয়। আমরা যেন দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে হাজারো শহীদের রক্তে অর্জিত পরিবর্তনের এই সুযোগকে গঠনমূলকভাবে কাজে লাগাই। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ, ’৯০-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং চব্বিশের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে একটি বৈষম্যহীন, মানবিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ না হই।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘দেশে যাতে পুনর্বার কোনো স্বৈরাচারের উৎপত্তি না হয়, ফ্যাসিজমের উৎপাদনের ব্যবস্থা না থাকে, সেজন্য পৃথিবীর কোনো দেশে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্ধারিত থাকার কোনো নজির নেই। তারপরও আমরা বলেছি, কোনো ব্যক্তি ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রীর আসনে বহাল থাকবে না। প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ নির্বাহী বিভাগের কার্যকরভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার স্বার্থে আমরা এনসিসি জাতীয় কোনো ধারণার সঙ্গে একমত হইনি। এটাই ছিল আমাদের শর্ত। আশা করি, একটি ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারব। আলাপ-আলোচনা হচ্ছে, তবে দীর্ঘ আলোচনা কাম্য নয়।’
বিএনপির আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘জুলাই সনদের মতামত আমরা বহু আগে দিয়েছি। যারা করছে না, এটা তো আমাদের দায়িত্ব নয়। যাদের দায়িত্ব তারা যদি কোনো কারণে বিলম্ব করে তার দায় বিএনপি নেবে না। এই দায় বিএনপির নয়।’