
আয়তনে দেশের সবচেয়ে বড় জেলা রাঙামাটি। ৬ হাজার ১১৬ বর্গকিলোমিটারের এই ভূখণ্ডে তিন লাখের মতো ভোটারের বসবাস, ১০টি উপজেলা মিলে আসনও মাত্র একটি। জনসংখ্যা বিবেচনায় নির্বাচনের মাঠে এর গুরুত্ব যা-ই হোক না কেন, পর্যটন শিল্পে এই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অবদান অনন্য।
ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন উপলক্ষে এখানেও বইছে ভোটের হাওয়া। তৎপর হয়েছেন দীর্ঘদিন নির্বাচনের স্বাদ বঞ্চিত রাজনৈতিক নেতারা। যার যার অবস্থান থেকে দিচ্ছেন সরব উপস্থিতির প্রমাণ। সব মিলিয়ে এবার পাহাড়ি, জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থিদের মধ্যে ত্রিমুখী লড়াই হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে।
রাঙামাটি দেশের ২৯৯ নম্বর সংসদীয় আসন। এটি মূলত আওয়ামী লীগের ঘাঁটি ছিল। অন্তত আড়াই দশক রাজত্ব করেছে এই দল। মাঝে দু’বার শাসন করেছে বিএনপি। এবারো অন্তত দলটির ছয় নেতা টিকিট পাওয়ার আশা করছেন। পাশাপাশি পরিবর্তিত বাংলাদেশে সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ পাওয়ার স্বপ্ন দেখছে সব দল। তাই তিন দশক পর প্রার্থী দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। একক নমিনি নিয়ে আছে প্রচারের শীর্ষে। আবার বড় দুই দলের মাঝে সুযোগ খুঁজছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), ঘোষণা করতে যাচ্ছে একক প্রার্থী। তবে ইসলামী আন্দোলনসহ অন্য ইসলামী দল এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ, আমার বাংলাদেশ পার্টিসহ (এবি পার্টি) অপর দলগুলোর তেমন তৎপরতা নেই।
দেশের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তবর্তী জেলা রাঙামাটি। বাঙালি জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি এখানে রয়েছে ১৩টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস। ভৌগলিক ও রাজনৈতিক কারণে এ আসনের ভোটের হিসাব দেশের সমতলের যে কোনো জেলার চেয়ে ভিন্ন। এখানে প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী পাহাড়ি। যাদের রয়েছে বিভিন্ন নামে নিজস্ব সংগঠন। পাশাপাশি বিএনপিরও রয়েছে উল্লেখযোগ্য প্রভাব।
প্রায় সাড়ে ১৫ বছর পর নানা কর্মসূচি নিয়ে নির্বাচনের মাঠে সরব বিএনপির ছয় নেতা। তারা মনোনয়ন প্রত্যাশা করে কেন্দ্রের দিকে যেমন চেয়ে আছেন, তেমনি জনসমর্থন পেতে যাচ্ছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে। তাদের তৎপরতায় চাঙ্গা হয়ে উঠেছেন দলটির নেতাকর্মীরা। মনোনয়নপ্রত্যাশীরা হলেনÑ কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ-ধর্মবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট দীপেন দেওয়ান, সাবেক সংসদ সদস্য মনি স্বপন দেওয়ান, জেলা বিএনপির সভাপতি দীপেন তালুকদার দিপু, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মামুনুর রশীদ মামুন, জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ও রাঙামাটি পৌরসভার সাবেক মেয়র সাইফুল ইসলাম ভুট্টো এবং জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম পনির। তারা সবাই অনুসারীদের নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছেন, চেষ্টা করছেন মাঠ গরম রাখার।
সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আগে কয়েকবার দল থেকে মনোনয়ন চেয়েছি, এবারো চাইব। রাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনায় দল আমাকে টিকিট দেবে বলে জোর প্রত্যাশা রয়েছে।’
দীপু তালুকদার বলেন, ‘জেলা বিএনপি শক্তিশালী করার পেছনে আমারও ভূমিকা রয়েছে। দুঃসময়ে দলে নেতৃত্ব দিয়েছি। আশা করি, দল আমাকে মনোনয়ন দেবে। ধানের শীষ পেলে দলকে এ আসন উপহার দেব।’
অ্যাডভোকেট মামুন বলেন, ‘এবারো দলীয় মনোনয়ন চাইবে। আগেও তিনবার চেয়েছি। বিএনপি এখন তরুণ নেতৃত্বকে গুরুত্ব দিচ্ছে, সে হিসেবে আন্দোলন-সংগ্রামের ভূমিকা বিবেচনা করে দল এবার আমাকে মনোনয়ন দেবে বলে দৃঢ় বিশ্বাস আছে।’ সাইফুল পনির বলেন, ‘তৃণমূল থেকে রাজনীতি করে মাঠে আছি। আশা করি, দল আমাকে মনোনয়ন দেবে।’
জামায়াত একক প্রার্থী ঘোষণা করে প্রচারে এগিয়ে রয়েছে। ১৯৯৬ সালের পর এই প্রথম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও জামায়াত পরিচালিত সামাজিক ও শিক্ষা উন্নয়ন সংস্থা ইসলামিক সেন্টারের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মোখতার আহমেদকে মনোনয়ন দেওয়ায় জেলার বিভিন্ন প্রান্তে পড়েছে ব্যাপক সাড়া। বেশ কয়েক মাস আগেই তিনি নানা কর্মসূচি নিয়ে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন। প্রচারে কাজে লাগাচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ নানা কৌশল। ইতোমধ্যে তরুণ সমাজকে তিনি আলোড়িত করতে পেরেছেন বলে নেতাকর্মীরা দাবি করছেন।
অ্যাডভোকেট মোখতার বলেন, ‘দুর্নীতিমুক্ত ও ন্যায়-ইনসাফভিত্তিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করার জন্য আমরা নির্বাচন করছি। পার্বত্য এলাকার প্রেক্ষাপটে সব জাতি-গোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষা পূরণে আমরা কাজ করব। জুলাই বিপ্লবের পর মানুষের চিন্তার পরিবর্তন হয়েছে। মানুষ এখন সৎ ও প্রকৃতজন দরদী মানুষকে ভোট দিতে চায়। সে হিসেবে আমরা আশাবাদী আগামী নির্বাচনে এ আসনের মানুষ জামায়াত মনোনীত প্রার্থীকে বেছে নেবে।’
জেলা জামায়াতের আমির অধ্যাপক আবদুল আলীম বলেন, ৫৩ বছরের বিভিন্ন দলের শাসন দেখে দেশের মানুষ হতাশ। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে মানুষ পরিবর্তন চায়। রাঙামাটির মানুষ এবার দুর্নীতি-চাঁদাবাজমুক্ত, দেশপ্রেমিক, সৎ ও যোগ্য প্রার্থী হিসেবে জামায়াতের অ্যাডভোকেট মোখতারকে সমর্থন দেবে বলে দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে।
সন্তু লারমা নেতৃত্বাধীন পাহাড়িদের আঞ্চলিক সংগঠন জেএসএস এবারের ভোটের মাঠে অন্যতম খেলোয়াড়। প্রকাশ্যে কার্যক্রম না থাকলেও পাহাড়ের রাজনীতিতে বেশ প্রভাবশালী সংগঠনটি। ভেতরে ভেতরে নির্বাচনী মিশন নিয়ে বেশ তৎপর জেএসএস। সংগঠনের নমিনি হিসেবে সাবেক সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি উষাতন তালুকদারের নাম প্রায় চূড়ান্ত হয়ে গেছে। উষাতন ২০১৪ সালের জেএসএসের সমর্থনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এবারও বেশ সম্ভাবনা রয়েছে বলে নেতাকর্মীরা বলছেন।
জেএসএসের জেলা সভাপতি ডা. গঙ্গা মানিক বলেন, নির্বাচন নিয়ে দলের মধ্যে আলোচনা চিন্তা-ভাবনা চলছে। তবে এখনো কোনো প্রার্থীর নাম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়নি। বেশ কয়েকজনের নাম আলোচনায় থাকলেও শেষ পর্যন্ত উষাতনকেই সমর্থন দেওয়া হতে পারে।
সাধারণ ভোটাররা চান পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপন ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পক্ষে রায় দিতে। তরুণ ভোটার মোস্তফা কামাল রাজু বলেন, তিনি একবারও ভোট দিতে পারেননি। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমন প্রার্থীকে তিনি ভোট দিতে চান যিনি পাহাড়ি ও বাঙালিÑ সবার জন্য সমান উন্নয়ন করতে পারবেন। রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে অন্যায় করবেন না, বরং জনগণের ভরসায় পরিণত হবেন।
ব্যবসায়ী সুলতান মণ্ডল বলেন, ‘আমরা এমন জনপ্রতিনিধি চাই, যার মাধ্যমে পাহাড়ি-বাঙালি সবার মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে। যিনি লুটপাট না করে মানুষের কল্যাণে কাজ করবেন।’
নির্বাচন বিশ্লেষক ও লেখক অধ্যাপক হারুন অর রশীদ বলেন, রাঙামাটি আসনে ভোটের মাঠে বড় শক্তি পাহাড়িদের আঞ্চলিক সংগঠন জেএসএস। এছাড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের কিছু অংশ এবং বাঙালিদের ভোট পাবে বিএনপি ও জামায়াত। সে ক্ষেত্রে তাদের অবশ্যই পরিচ্ছন্ন, সৎ ও দেশপ্রেমিক প্রার্থী দিতে হবে। পরিবর্তিত বাংলাদেশে কোনো চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, দুর্নীতিগ্রস্ত ও টেন্ডারবাজকে জনপ্রতিনিধি হিসেবে চাইবে না জনগণ।