Image description
 অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার এগার মাসের মাথায় নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে নতুন বিতর্কে পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো।

গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর সম্প্রতি সংবিধান সংস্কার কমিশন দ্বিকক্ষবিশিষ্ট জাতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছে।

যেখানে সংসদের নিম্নকক্ষে আসন থাকবে ৪০০, নির্বাচন হবে বর্তমান পদ্ধতিতে। এর মধ্যে ১০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। তারা নির্বাচিত হবেন সরাসরি ভোটে।

আর উচ্চকক্ষে আসন থাকবে ১০০টি। এখানে নির্বাচন হবে সংখ্যানুপাতিক অর্থাৎ প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন বা পিআর পদ্ধতিতে। সংসদের দুই কক্ষ মিলিয়ে মোট আসন হবে ৫০০টি।

এই পিআর পদ্ধতি নিয়ে শুরুতে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মতামত জানিয়ে আসছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে পিআর নাকি সরাসরি ভোট—তা নিয়ে দলগুলোর পাল্টাপাল্টি অবস্থান আরও দৃশ্যমান হয়েছে।

দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং এর মিত্র কিছু দল সংসদীয় আসনে সরাসরি ভোটের বিদ্যমান ব্যবস্থার পক্ষে কঠোর অবস্থান নিয়েছে।

বিপরীতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি ইসলামন্থী ও বামপন্থী দল এবং সদ্যগঠিত এনসিপিও সংসদের দুই কক্ষেই পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের জোর দাবি জানিয়ে আসছে।

প্রশ্ন হলো—নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি কীভাবে কাজ করে? এর সম্ভাবনা-সমস্যার জায়গা কোনগুলো? যে রাজনৈতিক দলগুলো এর পক্ষে কিংবা বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে—তার কারণগুলোই বা কী কী?

প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন পদ্ধতি কী?

বাংলাদেশে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে যে পদ্ধতিটি চালু আছে তা পরিচিত 'ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট' নামে। এই পদ্ধতিতে নির্বাচনি এলাকায় প্রার্থীদের মধ্যে যিনি সর্বোচ্চ ভোট পান, তিনিই নির্বাচিত হন। বাংলাদেশে সংসদসহ অধিকাংশ নির্বাচনে দীর্ঘদিন ধরে চর্চিত হয়ে আসছে এই পদ্ধতিটি।

অন্য আরেকটি পদ্ধতি হল এই সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা বা 'প্রপোরশনাল রিপ্রেজেনটেশন' পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে আসনভিত্তিক কোনো প্রার্থী থাকেন না। ভোটাররা ভোট দেন দলীয় প্রতীকে। একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে সংসদে তাদের আসন সংখ্যা নির্ধারণ হবে।

বিশ্বের ৯১টি দেশে আনুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থা প্রচলিত। এ অঞ্চলে নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় এ পদ্ধতি চালু রয়েছে। আবার অনেক জায়গায় এ দুটি পদ্ধতির মিশ্র ব্যবস্থাও চালু আছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলনীতিতে এক হলেও একেক দেশের 'পিআর' একেক রকম। একটির সঙ্গে অন্যটির তেমন মিল নেই। এই পদ্ধতিতে নির্বাচন ব্যক্তি-প্রার্থীদের মধ্যে হয় না। নির্বাচন হয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে।

খুব সহজবোধ্যভাবে বলতে গেলে, এই পদ্ধতির নির্বাচনে যে দল মোট প্রদত্ত ভোটের মধ্যে যত শতাংশ ভোট পাবে, সেই অনুপাতে সংসদেও তত ভাগ আসন পাবে। যেমন—বাংলাদেশের ৩০০ আসনের সংসদে ১ শতাংশ ভোট পাওয়া দল ৩টি আসন পাবে। ১০ শতাংশ ভোট পেলে আসন পাবে ৩০টি।

সুবিধা-অসুবিধা: যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে নির্বাচন বিশ্লেষক ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদের সঙ্গে। তারা দুজনেই সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষে কথা বলেছেন। তবে তাদের বক্তব্যে এই পদ্ধতির অসুবিধার দিকগুলোও উঠে এসেছে।

তোফায়েল আহমেদ যেমন বলছেন, 'ভোটের প্রচলিত যে পদ্ধতি বাংলাদেশে চালু আছে, তাতে তো এ দেশের মানুষ কতগুলো পরিবার, কতগুলো ব্যাবসায়ী, কতগুলো প্রভাবশালীদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। পিআর পদ্ধতিও যে এখান থেকে বের হওয়ার একমাত্র উপায় তাও না। তবে সেই সুযোগ এখানে আছে।'

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে এই স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ বলেন, 'রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো রিফর্ম হচ্ছে না। পার্টিগুলো যদি রিফর্ম হতো তাহলে এটা একটা পথ হতো। তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত তারা যদি একটা ডেমোক্রেটিক সিস্টেমে যেত, তাহলে একটা উপায় হতো।

'এগুলো না করে পিআর পদ্ধতি চালু করেও সহজে এখান থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। কারণ, পিআর করলে তাদের সুবিধাটা বেড়ে যাবে। কারণ লোকে তো পার্টিকে ভোট দেবে। তখন পার্টি তার ইচ্ছেমতো প্রার্থী দিয়ে দিতে পারবে। তখন সেটা তাদের জন্য আরও সুবিধার হয়ে যাবে।'

এ পর্যায়ে পিআর পদ্ধতির সুবিধার দিক সম্পর্কে এই নির্বাচন বিশ্লেষকের ভাষ্য, 'এই পদ্ধতিতে এক দলের মনোপলি হবে না। ধরা যাক, পিআর পদ্ধতিতে ১ শতাংশ ভোট যারা পাবে, তাদের থেকে শুরু হবে আসন বণ্টন। এতে সব দল হয়তো কোনো না কোনো আসন পাবে। তাতে একটা প্লুরালিজম হতে পারে।'

আবার পিআর পদ্ধতিতে যেহেতু ভোটাররা তাদের এলাকায় সরাসরি প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারবেন না, সেহেতু দলের নির্বাচিত প্রতিনিধি দিয়ে সংশ্লিষ্ট সংসদীয় আসনে এলাকাবাসীর স্বার্থ কীভাবে রক্ষিত হবে সে প্রশ্ন কিংবা সংশয়ের জায়গাও আছে।

এ ব্যাপারে তোফায়েল আহমেদ বলছেন, 'সংসদীয় পদ্ধতিতেও তো প্রার্থীর মনোয়ন দেয় দল। সেখানেও তো ভোটারের কিছু করার থাকে না।'

এছাড়া পিআর পদ্ধতির পক্ষে থাকার আরেকটি যুক্তিও তুলে ধরেন এই লেখক। বলেন, 'আমাদের এখানে তো সিঙ্গেল পার্টি ডমিন্যান্ট সিস্টেম। টু পার্টি সিস্টেম যেটা ছিল সেটা ভেঙে গেছে। আগের আওয়ামী লীগ আমলেও এটা সিঙ্গেল পার্টি সিস্টেমে পরিণত হয়েছিল। এখনো বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সবকিছু মিলিয়ে আমরা আবার সেই সিস্টেমের দিকে চলে যাচ্ছি বলে মনে হচ্ছে। এখান থেকে বের হওয়ার জন্য পিআর সিস্টেমটা কিছুটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখলেও রাখতে পারে।'

তোফায়েল আহমেদ 'সংস্কার সংলাপ (সূচনা সূত্র): রাষ্ট্র, নির্বাচন, শাসন-প্রশাসন ও সংবিধান' শিরোনামের একটি বই লিখেছেন। সেখানে এই পিআর পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলাপ আছে।

পিআর পদ্ধতির আরেকটি অসুবিধার দিক নিয়ে এই বিশ্লেষক বলছেন, 'এই পদ্ধতিতে দলগুলোর ইচ্ছাকৃতভাবে স্বামী-স্ত্রী-আত্মীয়স্বজনকে মনোনয়ন দেওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। কারণ ভোটার তো পার্টিকে ভোট দেবে। ব্যক্তিকে ভোট দেবে না। আগে তালিকা দিলেও মানুষের চয়েসটা এখানে থাকবে না।'

তবে সবমিলিয়ে এই মুহূর্তে সীমিত পরিসরে এ নীরিক্ষাটা করা যেতে পারে বলে মত দেন তোফায়েল আহমেদ। বলেন, 'নেপালে এটা হয়েছে। এটা বেশ জটিল একটা পদ্ধতি। আমাদের দেশের মানুষের জন্য বোঝা একটু কঠিন হবে। তাই উচ্চকক্ষের অর্ধেক আসনের জন্য এই পদ্ধতি কার্যকর করা যেতে পারে কিনা সেটা ভাবা যেতে পারে। যেহেতু বিষয়টা নিয়ে আলাপ উঠেছে এবং কিছু লোক এটাকে সাপোর্ট করছে।'

এ সংক্রান্ত আলাপে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদও তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন। প্রচলিত সংসদীয় পদ্ধতিই কেন রেখে দিতে হবে—এমন প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, 'পিআর এমন একটা পদ্ধতি যাতে ছোট ছোট দলগুলো যে ভোট পায়, তার ভিত্তিতে তাদেরও প্রতিনিধিত্ব থাকবে সংসদে। যে বড় দলগুলো মনে করে যে তারা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে পারে, তারাই এটার বিরোধিতা করছে। কারণ এখানে তারা কোনো শেয়ারহোল্ডার চায় না।'

ভোটের প্রচলিত পদ্ধতির সমালোচনা করে এই লেখক আরও বলেন, 'ধরা যাক (প্রচলিত পদ্ধতিতে) একজন হয়তো ৩৫ শতাংশ ভোট পেয়ে সিঙ্গেল মেজরিটি পেল। বাকি ৬৫ শতাংশ ভোট বিভিন্ন প্রার্থী পেল। তখন দেখা যাবে ৩৫ শতাংশের প্রতিনিধি শতভাগ ভোটারের প্রতিনিধিত্ব দাবি করছে। এটাকে তো চ্যালেঞ্জ করা যেতেই পারে।'

মহিউদ্দিন আহমদের ভাষ্য, 'রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার ব্যবস্থা যেসব দেশে আছে, সেগুলোর অনেকখানেই দেখা যায় যে, কেউ যদি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়, অন্তত ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পায়, তাহলে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া দুইজনের ভেতর আবার রিপোল হয়।

'অর্থাৎ তাকে অন্তত সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারের প্রতিনিধি হতে হবে। সমর্থন থাকতে হবে। এটাই হচ্ছে পিআর পদ্ধতির পেছনের যুক্তিটা। আমাদের সংসদীয় ব্যবস্থায় তো সেটা নাই।'

এই রাজনৈতিক বিশ্লেষকের পরামর্শ হলো—'এমনও হতে পারে যে নিম্মকক্ষের ৩০০ আসনে সরাসরি ভোট হলো। আর সংরক্ষিত নারী আসনের মধ্যে ৫০টির ভোট পিআর পদ্ধতিতে হলো। সেইসঙ্গে উচ্চকক্ষের সবগুলো আসনের ভোটও পিআর পদ্ধতিতে হতে পারে। অর্থাৎ সরাসরি ভোট এবং পিআর পদ্ধতি—দুটোর সংমিশ্রনেই একটা ব্যবস্থা করা যায়।'

পিআর পদ্ধতি নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের মুখোমুখি অবস্থান কেন?

সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনি ব্যবস্থা দেশে ঐক্যের পরিবর্তে বিভক্তিমূলক সমাজ এবং অস্থিতিশীল সরকার সৃষ্টির কারণ হয়ে উঠতে পারে কিনা তা ভেবে দেখতে সব রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

এছাড়া এই নির্বাচনি ব্যবস্থার আড়ালে দেশের রাজনীতিতে সবার অগোচরে আবার পরাজিত অপশক্তির পুনর্বাসনের পথ সুগম করে দেওয়া হচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি।

বিপরীতে পিআর পদ্ধতি ছাড়া জনগণ কোনো নির্বাচন মেনে নেবে না বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার।

বিএনপি ২০১৮ সালে তাদের ইতিহাসের সর্বনিম্ন ১৩ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতেছিল ছয়টি আসন। পিআর পদ্ধতির নির্বাচনে ওই হারে ভোট পেলে তাদের আসন হবে ৩৯টি।

বর্তমান পদ্ধতিতে ২০০১ সালে ৪১ শতাংশ ভোট পেয়ে দলটি ১৯৩টি আসন জিতেছিল। আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনে ওই হারে ভোট পেলে এবার তাদের আসন হবে ১২৩টি। আবার ২০০৮ সালে ৩২ শতাংশ ভোট পেয়ে ৩০টি আসন পাওয়া এ দল পিআর পদ্ধতিতে একই হারে ভোট পেলে আসন হবে ৯৬টি।

এদিকে জামায়াতে ইসলামী ১৯৯১ সালে পেয়েছিল ১২ শতাংশ ভোট, সেটাই তাদের সর্বোচ্চ। সেবার সংসদে তাদের আসন ছিল ১৮টি।

এবার আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন হলে এবং আবারও দলীয় ইতিহাসের সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ ভোট পেলে জামায়াতের আসন দ্বিগুণ হয়ে ৩৬টিতে দাঁড়াবে।

সুতরাং বিএনপি ও জামায়াত কেন পিআর পদ্ধতি নিয়ে দুই রকম অবস্থান নিয়েছে, তা এই সরল অংকেই স্পষ্ট।