Image description
বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির সঙ্গে বৈঠক । মৌখিক আশ্বাস পেলে এখনই কাজ শুরু করতে চান নির্বাচনি আসনে।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত নয়। তবে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনি সময়সীমা টার্গেট করে প্রস্তুতি নিচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। সে লক্ষ্যে আসনভিত্তিক এলাকায় মাঠেও নেমেছেন নেতারা। তবে বিগত সময়ে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা মিত্র দল ও জোটনেতাদের অনেকেই নিজের আসন নিয়ে দোদুল্যমান অবস্থায় পড়েছেন। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে সক্রিয় ভূমিকা থাকলেও নির্বাচনি আসন নিয়ে অনেকটা অনিশ্চয়তায় তারা। এজন্য এখনই বিএনপির কাছ থেকে ‘আসন সমঝোতার’ নিশ্চয়তা চায় মিত্ররা। অন্ততপক্ষে মৌখিক আশ্বাস পেলেও নির্বাচনি আসনে তারা কাজ শুরু করতে পারবেন বলে জানিয়েছেন মিত্র দলগুলোর একাধিক শীর্ষ নেতা।

যদিও বিএনপি রাজনৈতিক মাঠে পরীক্ষিত মিত্র দলগুলোকে সঙ্গে নিয়েই নির্বাচনি বৈতরণি পার হতে চায়। সেক্ষেত্রে সমঝোতার ভিত্তিতে ঢাকাসহ সারা দেশে বেশকিছু আসন ছাড় দেওয়ার চিন্তা করছে দলটি। আর যুগপৎ আন্দোলনের নেতারা চান ‘সম্মানজনক’ আসন। পাশাপাশি উচ্চকক্ষ কিংবা ক্ষমতায় গেলে জাতীয় সরকারেও থাকতে চান। এ নিয়ে বিএনপির সঙ্গে মিত্রদের আসন নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে অনেকটাই নীরবে। বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির সঙ্গে মিত্রদের চলমান ধারাবাহিক বৈঠকেও এ বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী জানান, নির্বাচনি তফশিল ঘোষণার পর হতে পারে আসন ভাগাভাগি। নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর নির্বাচনের কার্যক্রম শুরু হলে তো এই প্রক্রিয়া হবে। আমরা সে জায়গায় এখনো আসিনি। যখনই নির্বাচনি কার্যক্রম, তফশিল ঘোষণা হবে-এ বিষয়গুলো উঠে আসবে। সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা হবে।

বুধবার লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠক শেষে আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, যারা বিএনপির সঙ্গে রাজপথে ছিল, তাদের সঙ্গে আবার কথাবার্তা বলছি। আমাদের ঐক্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু নির্বাচন বলে কথা নয়, ৩১ দফা ও সংস্কারের বিষয়ে যে ঐকমত্য, তা কীভাবে আগামী দিনে বাস্তবায়ন করব; নির্বাচনে জনগণ যদি আমাদের রায় দেয়, সবাই মিলে এটি বাস্তবায়ন করতে হবে।

২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শরিকদের ৫৮টি আসন ছেড়ে দেয় বিএনপি। অবশ্য সেই নির্বাচনে আগের রাতে ভোট হওয়ায় ভোটের দিন সকালেই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয় বিএনপিসহ মিত্ররা। এরপর সর্বশেষ ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনও বর্জন করে বিএনপিসহ মিত্ররা। এই পুরো সাড়ে ১৫ বছর বিএনপির সঙ্গে মিত্র দলগুলো আন্দোলন-সংগ্রামে মাঠে ছিল। গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়।

ফ্যাসিবাদবিরোধী ওই গণ-অভ্যুত্থানের আন্দোলনেও বিএনপির সঙ্গে মিত্ররা সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়।

মিত্র দল ও জোটনেতারা বলছেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে সারা দেশে নির্বাচনি প্রস্তুতি চলছে। বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা সব আসনেই নির্বাচনি প্রস্তুতি চালাচ্ছেন। যুগপৎ আন্দোলনের মিত্র দল ও জোটগুলোর শীর্ষ নেতাদের নিজ এলাকায়ও বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা তোড়জোড় চালাচ্ছেন। এতে অনেকে প্রতিবন্ধকতা দেখছেন। এজন্য এখনই আসন সমঝোতা না হলেও মৌখিক আশ্বাসে নির্বাচনি মাঠে থাকতে চান তারা। সাংগঠনিক প্রস্তুতি ও গণসংযোগ করার মতো কর্মসূচি পালনে ইতিবাচক বার্তাও প্রত্যাশা করেন নেতারা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলমান পরিস্থিতি, সংস্কার কার্যক্রম ও জাতীয় নির্বাচন ইস্যুতে মিত্রদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করছে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটি। এখন পর্যন্ত নেওয়া বিএনপির বেশির ভাগ সিদ্ধান্তে সমমনা দল ও জোটগুলো তাদের আত্মবিশ্বাসের কথা জানায়। একই সঙ্গে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দলগুলোকে ইতিবাচক বার্তাও দিয়েছে বিএনপি। আগামী দিনে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন কিংবা আসন সমঝোতার মাধ্যমে অংশগ্রহণের কথাও আলোচনায় উঠে আসে। তবে কৌশলের অংশ হিসাবে আসন ভাগাভাগির বিষয়টি এখনই সামনে আনতে চাচ্ছে না বিএনপি। দলটি সমমনাদের জানিয়েছে সবকিছু ঠিক থাকলে নির্বাচনি তফশিল ঘোষণার পরপরই আসন নিয়ে তাদের সঙ্গে চূড়ান্ত আলাপ করবে। কেউ কেউ বিষয়টি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন বলেও লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। যদিও সমমনাদের সম্ভাব্য আসনগুলোয় বিএনপি নেতাদের প্রচারণায় চাপা ক্ষোভ আছে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের। নেতারা মনে করেন, আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে-এমনটা বিশ্বাস করলেও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারেন তারা। এজন্য নানা কৌশলে, হিসাবনিকাশ করে পা ফেলছে বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনের শরিকরা। নির্বাচনের দিনক্ষণ আরও ঘনিয়ে এলে পরিস্থিতির আলোকে আসন সমঝোতার কৌশল নির্ধারণ করবেন তারা। তবে এ সময়ে বিএনপির সঙ্গে নানা ইস্যুতে আরও গভীরভাবে আলোচনা চালিয়ে যাবেন। নির্বাচনের আগে সব ধরনের বৈরিতা কেটে যাবে বলেও মনে করছেন নেতারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা যুগান্তরকে বলেন, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিএনপির পাশে থাকা দল ও জোটকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে। এমনকি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করলে ‘জাতীয় সরকারেও’ তাদের কেউ কেউ থাকবেন।

জানতে চাইলে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক যুগান্তরকে বলেন, আসন সমঝোতার বিষয়ে বিএনপি যেটা জানিয়েছে, তারা দলেও এ নিয়ে কোনো কিছু চূড়ান্ত করেনি। শরিকদের সঙ্গেও আলোচনা শুরু করেনি। এ বিষয়টি বিএনপি ফরমালি আমাদের জানিয়েছে। ফলে দলগুলোর একধরনের প্রস্তুতি, সেটা তো আছে। রাজনৈতিক প্রস্তুতি, সাংগঠনিক প্রস্তুতি, গণসংযোগ-সেগুলো আছে। এটা (আসন সমঝোতা) আরও সময় নেবে। নির্দিষ্ট আলোচনা, নির্দিষ্ট বোঝাপড়া হতে আরেকটু সময় নেবে-এটা আমার ধারণা।

তিনি বলেন, বৈঠকে বিএনপি বলেছে, যুগপৎ আন্দোলনে যারা ছিলেন, তাদের নিয়ে যেমন সরকার গঠন করতে চায়, তেমনই তাদের নিয়ে নির্বাচনও করতে চায়। এটা হচ্ছে বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান। সুনির্দিষ্টভাবে এটার রূপ কিংবা ধরন, কোন মোর্চার জন্য কতখানি আসনে সমঝোতা হবে, সেটা আরও পরে আলোচনা হবে। আমরা বলেছি, সরকার গঠন তো পরের প্রশ্ন। আগে তো আন্দোলনের প্রতিনিধিত্ব হবে নির্বাচন ও সংসদে। তারপর না সরকার গঠনের প্রশ্ন। ওনারা (বিএনপি) আরেকটু বোঝাপড়া বাড়াতে চান গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে।

১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, আমরা যুগপৎ আন্দোলনসহ নানা ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে ছিলাম। ভবিষ্যতেও থাকব। আশা করছি, বিএনপিও এর মূল্যায়ন করবে।

গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, বিএনপি বলছে যথাসময়ে এসব বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হবে। এবং মোটামুটি শরিকদের সম্মানজনকভাবে আসন ছাড় দেওয়া হবে। তিনি বলেন, আসন নিয়ে আমরা কোনো আশঙ্কা দেখছি না। নির্বাচন ও জাতীয় সরকার-এ দুটি বিষয়ে তারেক রহমানের অবস্থানটা হচ্ছে, যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোকে বিএনপির অংশীদার করতে চায়।

জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, আসন নিয়ে হালকা (অল্প) আলাপ হয়েছে। আসল আলাপ হবে নির্বাচনি শিডিউল ঘোষণার পর। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন জোটকে সর্বোচ্চ ছাড় দেবেন। যারা আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলেন, তাদের নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করবেন। একই কথা বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও বলেছেন। আশা করি, বিএনপি আমাদের যে কথা দিয়েছেন, তা রক্ষা করবে। সেক্ষেত্রে যদি কাউকে আসন দিতে না পারে, তাহলে উচ্চকক্ষ তো আছেই। সেটার ব্যাপারে তো আলোচনা চলছে।