
রাজধানীর মহাখালীর একটি মদের বারে গত মঙ্গলবার রাতে যুবদল নেতা মনির হোসেন ভিআইপি রুম না পাওয়ায় কর্মীদের নিয়ে ভাঙচুর চালান। এ সময় নারীদের লাঞ্ছিত করার অভিযোগও ওঠে তার বিরুদ্ধে। বিষয়টি নজরে এলে শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও সংগঠনের আদর্শবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য মনিরকে সংগঠনের সব ধরনের পদ থেকে অব্যাহতি এবং প্রাথমিক সদস্যপদও প্রত্যাহার করে নেয় যুবদল। নেতা-কর্মীদের তার সঙ্গে দলীয় সম্পর্ক ছিন্ন এবং মনিরের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নিতে পুলিশের প্রতি আহ্বান জানায় সংগঠনটি।
শুধু মনির হোসেন কিংবা যুবদল নয়-মূল দল বিএনপি থেকে শুরু করে প্রতিটি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন শৃঙ্খলা রক্ষায় দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। কারণ হিসেবে দলটির দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলছেন, ৫ আগস্টের পর থেকে সারা দেশে বিএনপির কিছু উচ্ছৃঙ্খল নেতা-কর্মী নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন। এসব ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা চালানো হয়। ফলে দেশে-বিদেশে বিএনপির ইমেজ ক্ষুণ্ন হতে থাকে। এতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তাই শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও ইমেজ নষ্টকারীদের বিরুদ্ধে বিএনপি জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গতকাল কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, অনৈতিক ও অপরাধমূলক কাজের বিষয়ে বিএনপির অবস্থান জিরো টলারেন্স। অপরাধ করলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে সারা দেশে বেশ কয়েকজন নেতাকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ৪-৫ হাজার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে দেশের বৃহত্তম এই রাজনৈতিক দলটি। অপরাধে জড়ালে কোনো ছাড় নয়, সাফ জানিয়ে দিয়েছেন দলটির শীর্ষনেতা। জানা যায়, লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠকের পর বিএনপি পুরোপুরি নির্বাচনি আমেজে রয়েছে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আরও কঠোর হচ্ছে দলটি। চলতি সপ্তাহে দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সংগঠনের ভাবমূর্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষায় আরও কঠোর অবস্থানে থাকতে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নির্দেশনা দিয়েছেন। বলেছেন, যত বড় ত্যাগী নেতাই হোন না কেন, অপরাধ করলেই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তারেক রহমান নেতাদের জানিয়েছেন, সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে দলের শীষস্থানীয় নেতাদের ঐক্যবদ্ধ ও শক্ত অবস্থানে থাকতে হবে। অনেক জায়গায় নেতা-কর্মীরা ‘আধিপত্য রক্ষায়’ নিজেরা দ্বন্দ্বে জড়াচ্ছেন। এতে ঘটছে খুনাখুনি ও হানাহানির ঘটনা। এসব কারণে যে কোনোভাবে বিশৃঙ্খলা এড়াতে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কঠোর হতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৯ মাসে ৫ হাজারের বেশি নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে দলীয় বিশৃঙ্খলার অপরাধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে দলটি। বিএনপি সাংগঠনিকভাবে এসবের বিরুদ্ধে থাকলেও তৃণমূল নেতারা মবের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। যার কারণে দেশব্যাপী সমালোচনার শিকার হচ্ছে দলটি। নেতাদের দাবি, সরাসরি এসবের বিরুদ্ধে কাজ করছে বিএনপি। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় অটোস্ট্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিএনপির দুই পক্ষের দ্বন্দ্বে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে দুই ব্যক্তি খুন হন। এ ঘটনায় দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও ফৌজদারি অপরাধে যুক্ত থাকায় বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন এবং অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় বেশ কয়েকজনকে অব্যাহতিসহ সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে বিএনপি।
এদিকে গত ২৮ মে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষে কলিম উদ্দিন নামে স্বেচ্ছাসেবক দলের এক নেতা নিহত হন। আহত হন শাখাওয়াত নামে যুবদলের এক কর্মী। তাদের ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়। এ ঘটনায় যারা জড়িত ছিলেন, বিএনপি তাৎক্ষণিকভাবে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে। এভাবে যখনই ঘটনা ঘটছে, দল থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, রাজধানী থেকে শুরু করে দেশের সর্বত্রই কঠোর দৃষ্টি রাখছেন তারেক রহমান। রেখেছেন শক্তিশালী মনিটরিংয়ের ব্যবস্থাও। তারই অংশ হিসেবে অভিযোগ পাওয়ামাত্রই র্যাপিড অ্যাকশনে যাচ্ছে দলের কেন্দ্রীয় দপ্তর। পাশাপাশি প্রমাণ মিললে করা হচ্ছে বহিষ্কার, না হয় পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে শোকজ নোটিস। বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য কিংবা জাতীয় নির্বাহী কমিটির নেতা, কেউই এ তালিকা থেকে বাদ যাচ্ছেন না। রাজধানী থেকে শুরু করে সর্বত্রই কঠোর দৃষ্টি রাখছেন তারেক রহমান। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। এরপর সারা দেশে বিচ্ছিন্নভাবে শুরু হয় সহিংস কর্মকাণ্ড। এতে জড়িত থাকা ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো তাদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া অব্যাহত রেখেছে। একই সঙ্গে নৈরাজ্য প্রতিরোধ করে জনমনে স্বস্তি ফেরাতে তৎপরতা চালাচ্ছে বিএনপি। পাশাপাশি ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে সহায়তা ও আহতদের সুচিকিৎসার জন্য কাজ করছে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দলটি।
এ প্রসঙ্গে দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দীর্ঘদিনের একজন কর্মীকে সহজেই কেউ দল থেকে বহিষ্কার বা তার সদস্যপদ স্থগিত করতে চায় না। যখন একজন নেতা বা কর্মীর বিরুদ্ধে বহিষ্কারাদেশ দেওয় হয়েছে, তখন সবকিছু দেখেশুনে এবং জেনেবুঝে যৌক্তিকভাবেই সেটা দেওয়া হয়। যা অন্যদের জন্য একটা সতর্কতাসংকেত। আশা করি, এতে অন্যরা সতর্ক হবেন।’