Image description

৫ আগস্টের ঐতিহাসিক ছাত্রগণঅভ্যুত্থানের পর নতুনভাবে আলোচনায় এসেছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয়তা কাটিয়ে সংগঠনটি ব্যানার-ফেস্টুনসহ সক্রিয়ভাবে মাঠে ফেরে। তবে এ প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সহিংস সংঘর্ষও বেড়েছে। গত ১০ মাসে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অন্তত ১৬টি বড় ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, যাতে আহত হয়েছে ৬৯ জন। এদের মধ্যে ২৫ জন শিবিরকর্মী, বাকি ৪৪ জন ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, বামপন্থি সংগঠনের কর্মী ও সাধারণ শিক্ষার্থী।

শিবিরের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, তারা একটি আদর্শনিষ্ঠ, নৈতিক ও শৃঙ্খলাবদ্ধ ছাত্রসংগঠন। তাদের সংগঠন ক্ষমতা বা আধিপত্য নয়, বরং আদর্শ ও চরিত্রনির্ভর নেতৃত্বে বিশ্বাস করে। সেই জায়গা থেকেই তারা ক্যাম্পাসে ফের সক্রিয় হচ্ছে। শিবিরের ভাষ্য, রাজনৈতিক বিরোধের কারণে বিভিন্ন সংঘর্ষে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে সংগঠনের নাম টেনে আনা হচ্ছে, যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত ১০ মাসে শিবিরের সঙ্গে অন্যন্যা ছাত্রসংগঠন এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে অন্তত ১৬টি বড় ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এর বেশির ভাগই সংঘটিত হয়েছে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, নোয়াখালী, সিরাজগঞ্জ, সিলেট, জয়পুরহাট ও ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এসব ঘটনার কেন্দ্রে রয়েছে ক্যাম্পাসে নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক প্রতিশোধ এবং ব্যক্তিগত বিরোধকে রাজনৈতিক স্বার্থ হাছিল।

হামলাগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই শিবিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে সংবাদ করা হয়েছে। তবে বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীদের দাবি শিবির নিজস্ব ব্যানারে এখনও ক্যাম্পাসগুলোতে রাজনৈতিক কার্যক্রম না করায় তাদের শনাক্ত করা কঠিন।

এ বিষয়ে সংগঠনটির ভাষ্য হচ্ছে, যে ঘটনাগুলো সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে সংঘটিত হয়েছে। তার দায় ছাত্রশিবিরের ওপর চাপানো অনৈতিক এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সংঘর্ষ যদি ছাত্রশিবিরের সাথে হয়ে না থাকে, তাহলে সেটির দায় আমাদের ওপর আরোপ করাকে আমরা সরাসরি অন্যায় ও জুলুম হিসেবে দেখি। বহুক্ষেত্রে দেখা গেছে, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদেও শিবিরের নাম টেনে এনে দায় চাপানোর অপপ্রয়াস চালানো হয়। 

এদিকে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম কলেজে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের ওপর ছুরিকাঘাতসহ হামলা করেছে শিবির। কলেজ ছাত্রদলের নেতারা অভিযোগ করেন, শিবির ক্যাম্পাস দখলে নিলেও কাউকে দাঁড়াতে দিচ্ছে না। অন্যদিকে শিবির দাবি করে, তারা কোনো হামলায় জড়িত নয়, বরং সাধারণ ছাত্রদের প্রতিরোধে তাদের নাম জড়ানো হচ্ছে। একই ধরনের সংঘর্ষ দেখা গেছে চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ, চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে পাল্টাপাল্টি সংঘর্ষে ছাত্রদলের এক নেতা গুলিবিদ্ধ হন। এই হামলার অভিযোগ উঠে শিবিরের বিরুদ্ধে।

এমনকি পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগও এসেছে জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে। বিয়ানীবাজারে দুই পুলিশ সদস্য আহত হয়ে পাঁচ ঘণ্টা জিম্মি থাকার পর উদ্ধার হন। চট্টগ্রামে জোড়া খুনের ঘটনায়ও শিবিরের এক নেতাকে আসামি করা হয়েছে।

চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক ছাত্রজোটের মশাল মিছিলেও হামলার অভিযোগও উঠে শিবিরের বিরুদ্ধে। হামলায় আহত হন চারজন ছাত্রনেতা ও একজন সাংবাদিক। সিলেটের এমসি কলেজ, রংপুরের ভর্তি কেন্দ্র, পিরোজপুর, কুয়েট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়—প্রায় প্রতিটি ঘটনায় একাধিক পক্ষ শিবিরকে দায়ী করলেও সংগঠনটি তা অস্বীকার করেছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক আজিজুর রহমান আজাদ দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমাদের স্পষ্ট বক্তব্য—যদি কেউ সংগঠনের নামে এমন কোনো কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকে এবং তার বিরুদ্ধে ন্যূনতম প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়, তাহলে ছাত্রশিবির তাৎক্ষণিকভাবে যথাযথ সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, এ ধরনের অভিযোগ প্রায়শই প্রমাণহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটি একটি মহলের রাজনৈতিক চক্রান্ত, যারা ইসলামী ছাত্রশিবিরের আদর্শিক কর্মকাণ্ড ও ছাত্রজনতার অকুণ্ঠ সমর্থনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়। প্রকৃত চিত্র হলো—গত ১০ মাসে যেসব গোষ্ঠী আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে, তাদের হাতেই খুন হয়েছে প্রায় ১২৬ জন মানুষ—যাদের মধ্যে বেশিরভাগই তাদের নিজেদের দলীয় কর্মী।

যদিও কিছু ঘটনায় সংগঠনটির নেতাকর্মীদের ও হামলার শিকার হতে দেখা যায়। এ ঘটনাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় ছাত্রদলের নেতার হামলায় আহত হন ছাত্রশিবিরের একজন কলেজ শাখা নেতা। জয়পুরহাটে ভিজিএফ কার্ড বিতরণ নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতপন্থী কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে শিবিরের একজন সভাপতিসহ আহত হন আরও ছয়জন।

বিশ্লেষকদের মতে, শিবিরের এই রাজনৈতিক পুনর্গঠনের প্রক্রিয়াকে প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনগুলো সহজভাবে নেয়নি। ফলে সংঘাত ও পাল্টা সংঘাতের ঘটনা বেড়েছে। কোথাও শিবিরের কর্মীরা প্রতিপক্ষের হামলার শিকার হয়েছেন, কোথাও আবার শিবিরের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আগ্রাসী ভূমিকায় নামার অভিযোগ উঠেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি যখন অস্থিরতায় ভুগছে, তখন ছাত্র রাজনীতির এই সহিংস প্রবণতা ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত। কারণ, সংঘর্ষ শুধু দলীয় রাজনীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, এতে জড়াচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীরাও।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস বলেন, ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রধান দায়িত্ব হওয়া উচিত শিক্ষার্থী এবং সাধারণ মানুষের কাছে নিজেদের আদর্শ ও লক্ষ্য পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করা। তিনি মনে করেন, এসব সংগঠনের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তাদের আদর্শ, নৈতিকতা ও শিক্ষার্থীবান্ধব মনোভাব স্পষ্টভাবে ফুটে উঠা উচিত।

ড. মাহবুবুর রহমান বলেন, ছাত্রসংগঠনগুলো যেন ব্যক্তিস্বার্থ নয়, বরং সাধারণ শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজ করে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। ক্যাম্পাসে তারা যেন সহশিক্ষা, অধিকার এবং গণতান্ত্রিক চর্চার পরিবেশ তৈরি করে। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রসংসদ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব নির্বাচনের সময় ছাত্র সংগঠনগুলোর কার্যক্রম যেন শিক্ষার্থীদের মাঝে তাদের আদর্শ ও কর্মসূচি তুলে ধরার একটি মাধ্যম হয়ে ওঠে, সেটিই কাম্য।’

স্থানীয় ও জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য, সরেজমিন অনুসন্ধান এবং দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশ সহিংসতা ঘটেছে রাজনৈতিক প্রতিশোধ এবং ব্যক্তিগত বিরোধ থেকে রাজনৈতিক স্বার্থ হাছিলকে কেন্দ্র করে।  

ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক আজিজুর রহমান আজাদ বলেন, গত ১০ মাসে মধ্যে ২৭টি ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ঘটনাও ঘটেছে তাদের ছত্রছায়ায়। পক্ষান্তরে, ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে এমনকি দলীয় কোন্দলে একজন আহত হয়েছে—এমন একটি তথ্যও কেউ তুলে ধরতে পারবে না। আমরা দৃঢ়ভাবে বলতে চাই—ছাত্রশিবির একটি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ, আদর্শনিষ্ঠ এবং জাতীয় স্বার্থে নিবেদিত ছাত্রসংগঠন। অপপ্রচার করে আমাদের অগ্রযাত্রা থামানো যাবে না। বরং সত্য ও ন্যায়ের পথেই আমরা এগিয়ে যাব।

তিনি বলেন, চট্টগ্রামে গতবছরের অক্টোবরে সংঘটিত একটি ঘটনা। সেই ঘটনায় কথিত জড়িত একজনকে, কোনো রকম প্রমাণ ছাড়াই, ‘শিবিরের কর্মী’ হিসেবে প্রচার করা হয়। সংশ্লিষ্ট সংবাদে ছাত্রশিবিরের নাম টেনে আনা হলেও কোথাও উল্লেখ নেই যে ওই ব্যক্তি ছাত্রশিবিরের সংগঠনিক স্তরে কীভাবে যুক্ত ছিলেন, কী দায়িত্বে ছিলেন বা আদৌ কোনো সংযোগ ছিল কিনা। আমরা সঙ্গে সঙ্গেই সেই সংবাদ প্রতিবেদনকে প্রত্যাখ্যান করে স্পষ্টভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম—অভিযুক্ত ব্যক্তি ছাত্রশিবিরের কোনো পর্যায়ের কর্মী নন এবং তার সাথে ছাত্রশিবিরের কোনো সম্পর্ক নেই। 

আজিজুর রহমান আজাদ আরও বলেন, আমাদের অবস্থান বরাবরই পরিষ্কার—একজন শিক্ষার্থী ছাত্রশিবিরে কর্মী হন প্রশিক্ষণ, চরিত্র, আদর্শ ও সংগঠনিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। সংগঠনের বাইরে কেউ যদি কোথাও কোনো ঘটনার সাথে যুক্ত হন, সেটি ছাত্রশিবিরের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সম্পূর্ণ অনৈতিক, অযৌক্তিক এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমি অনুরোধ করব, সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর যারা হামলা করে তাদের পরিচয়ও জাতির সামনে উম্মোচিত হোক। আমরা বারবার বলেছি—ছাত্ররাজনীতি হোক যুক্তির মাধ্যমে, নৈতিক নেতৃত্বে; সহিংসতা দিয়ে নয়। শান্তিপূর্ণ, আদর্শিক, ও দায়িত্বশীল ছাত্রসমাজ গড়ে তুলতেই ইসলামী ছাত্রশিবির নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে।