
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনটি আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। দলের একাধিক শীর্ষ নেতা বিষয়টি নিশ্চিৎ করে বলেছেন, খালেদা জিয়া দল ও জনগণের প্রাণ। তাকে ছাড়া নির্বাচনের প্রশ্নই আসে না। তিনি তিনটি আসন থেকেই নির্বাচন করবেন। জানা গেছে, ফেনী, বগুড়া ও দিনাজপুর থেকে নির্বাচনে অংশ নেবেন বেগম জিয়া। নির্বাচনের সাথে জড়িত শীর্ষ নেতারা আরও জানান, খালেদা জিয়ার বাইরে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একাধিক আসনে নির্বাচন করতে পারেন। এছাড়া কেউই একাধিক আসনে ধানের শীষের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে পারবেন না। জানা গেছে, তারেক রহমানের নির্দেশে ইতিমধ্যে কারা কোথায় নির্বাচন করবেন তার একটি সম্ভাব্য তালিকাও প্রস্তুত করা হয়েছে। তালিকায় প্রায় ২০টি জেলায় জোটের শরীকদের জন্য আসন রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে।
সূত্র মতে, সবশেষ ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি অংশ নিয়েছিল। সে নির্বাচনে বেগম জিয়া তিনটি আসনেই জয়লাভ করেছেন। অবশ্য ২০১৮ সালে তিনটি আসনে প্রার্থী হয়েও কথিত মিথ্যা মামলায় সাজা প্রাপ্ত হওয়ায় তার প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছিল। এরপরের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বিএনপিসহ দেশের অধিকাংশ দলই বর্জন করে। গেল বছর ছাত্র-জনতার গণ অভ্যূত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর বিচারাধীন সব মামলা থেকে খালাস পান বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। ফলে আগামীতে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে তার আর কোনো আইনি বাধা নেই। লন্ডন থেকে চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরা বাংলাদেশের সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীর শারীরিক অবস্থাও কিছুটা উন্নতির দিকে। দলটির নেতাকর্মীরা আশা করছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের (ত্রয়োদশ) আগেই তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবেন এবং তার নেতৃত্বেই তারা ভোটে অংশগ্রহণ করতে পারবেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, আগামী সংসদ নির্বাচনে চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আমরা নির্বাচনে অংশ নেব। তিনি নিজেও এবার নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। অপেক্ষা করছি তিনি যেন আরও সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসেন। তার দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্যে পুরো দেশ আবারো উজ্জীবিত হবে। তার নেতৃত্বে আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব। তিনি বলেন, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকার আমাদের খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করে আদালতকে ব্যবহার করে সাজা দিয়েছিল। যার কারণে তিনি ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। কিন্তু গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর আদালত স্বাধীনভাবে বিচারকাজ পরিচালনা করতে পারছে। আর এ কারণে আইনি প্রক্রিয়ায় বিগত সরকারের আমলে দায়ের করা মামলাগুলো থেকে বেকসুর খালাস পেযেছেন। ফলে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে যে আইনি বাধা তা কেটে গেছে।
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ১৭ বছরে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩০টির বেশি মামলা হয়। তবে, সাজা হয় দুটি মামলায়। এর মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ১০ বছর এবং জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় তার সাত বছর কারাদ-াদেশ হয়। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় গত ১৫ জানুয়ারি আপিল শুনানির পর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তাকে খালাস দেয়। এরপর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় আপিল বিভাগের রায়ে খালাস পান তিনি। একই সঙ্গে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বিচারের পর্যায়ে থাকা সব মামলায় খালাস কিংবা অব্যাহতি পেলেন তিনি। মামলা, সাজা, উন্নত চিকিৎসা নিয়ে কয়েক বছর ধরে নানা ঘটনা ও নাটকীয়তার পর গত ৮ জানুয়ারি চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান বিএনপির চেয়ারপার্সন। বেশ কিছুদিন চিকিৎসা শেষে তিনি দেশে ফিরেছেন।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী বলেন, ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে আমরা চেয়ারপার্সনের নেতৃত্বে অংশ নিয়েছি। এবার আগামী সংসদ নির্বাচনে আবার তার নেতৃত্বে অংশ নেওয়ার প্রতীক্ষায় রয়েছি। আমরা আশা করছি, জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন আবার দেশের হাল ধরবেন।
সূত্র মতে, দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর দীর্ঘ ৯ বছর স্বৈরাচার এরশাদ সরকার বিরোধী আন্দোলন করেন খালেদা জিয়া। ১৯৯১ সাল থেকে শুরু করে ২০০১ সাল পর্যন্ত চারটি সংসদ নির্বাচনে খালেদা জিয়া প্রতিবারই পাঁচটি আসনে প্রার্থী হয়েছেন এবং সবগুলো আসনে তিনি জয়লাভ করেন। এর মধ্যে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনেও খালেদা জিয়া প্রার্থী ছিলেন। এরপর ২০০৮ সালে খালেদা জিয়া তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনটিতে জয়ী হন। ২০১৪ সালে বিএনপি সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। ২০১৮ সালে নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়। ২০২৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। খালেদা জিয়ার নির্বাচনের গৌরবময় ইতিহাস ধরে রাখতে এবারো দলের পক্ষ থেকে তিনটি আসেনেই নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি।
বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরে আসার পর থেকে বেগম খালেদা জিয়াকে ছাড়া কোন নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। বেগম খালেদা জিয়া নিজ দলের নেতৃত্বে যেমন দিয়েছেন, তেমনি নির্বাচনের মাঠেও তার সাফল্য শতভাগ। গত প্রায় তিন দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়া অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে সবচেয়ে খারাপ ফলাফল করেছিল বিএনপি। সে নির্বাচনে বিএনপি মাত্র ৩০টি আসন পেলেও বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনে জয়লাভ করতে কোনো অসুবিধা হয়নি। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও বেগম খালেদা জিয়া তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিলেন। সেগুলো হচ্ছে - ফেনী ১. বগুড়া ৬ ও বগুড়া ৭। কিন্তু কথিত দুর্নীতির মামলায় দ-িত হবার কারণে নির্বাচনে অযোগ্য হয়ে পড়েন তিনি।
খালেদা জিয়ার অতীত নির্বাচনগুলো পর্যালোচনা দেখা যায়, তিনি বগুড়া, ফেনী, লক্ষ্মীপুর এবং চট্টগ্রামের আসন থেকে বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। এছাড়া ১৯৯১ সালে ঢাকার একটি আসন থেকে এবং ২০০১ সালে খুলনার একটি আসন থেকে ভোটে লড়েছেন তিনি। নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শুধু জয়লাভ করাই নয়, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সাথে বেগম খালেদা জিয়ার ভোটের ব্যবধানও ছিল অনেক বেশি।
শারীরিকভাবে সুস্থ থাকলে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবেন বলে জানিয়েছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বিষয়াবলী নিয়ে সম্প্রতি ভারতীয় একটি সম্প্রচার মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি একথা বলেন। খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে মির্জা ফখরুল বলেন, তিনি খুবই অসুস্থ। হাসপাতালে আছেন। তিনি মাল্টিডিসপ্লিনারি রোগে ভুগছিলেন। দেশে তার ভালো চিকিৎসা হচ্ছিল না। আমরা আদালত এবং ফ্যাসিস্ট সরকারকে বারবার অনুরোধ করেছিলাম উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে যেন বিদেশে পাঠানো হয়। কিন্তু সেটি তারা দেয়নি। ফ্যাসিস্টরা পালিয়ে যাবার পর ম্যাডাম জিয়া বিদেশে চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফিরেছেন। তিনি এখন মোটামুটি সুস্থ। মানসিকভাবেও শক্ত আছেন। দেশে প্রয়োজনে তিনি আবারো জনগণের পাশে ফিরে আসবেন। তিনি যদি শারীরিকভাবে ফিট থাকেন তাহলে অবশ্যই নির্বাচনে অংশ নেবেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির নির্বাচনী কার্যক্রমের সাথে জড়িত দলের এক ভাইস চেয়ারম্যান দৈনিক সংগ্রামের এ প্রতিবেদককে বলেন, এতদিন বলা হচ্ছিল, বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। এখন সিদ্ধান্ত হচ্ছে, তিনি তিনটি আসন থেকে নির্বাচন করবেন, এটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। এর মধ্যে ফেনী-১ এবং বগুড়া -৬ অথবা ৭ আসন অনেকটা নিশ্চিৎ। অন্য আসনটি দিনাজপুরে হতে পারে। তিনি জানান, সারাদেশে বিএনপি এখন নির্বাচনমুখি। ফলে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে সারাদেশে এক ধরণের গ্রুপিং পাল্টা গ্রুপিং চলছে। মনোনয়ন পেতে অনেকেই শীর্ষ নেতাদের কাছে ধরণা দিচ্ছেন। এই অবস্থায় দলের মধ্যে একটা বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরী হতে পারে। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া যদি প্রার্থী হন, নির্বাচনের মাঠে থাকেন, তাহলে সেই গ্রুপিং অনেকটা থাকবে না। নির্বাচনে বাড়তি উৎসাহ উদ্দীপনা থাকবে। তাই সিদ্ধান্ত হচ্ছে, বেগম জিয়া তিনটি আসনেই নির্বাচন করবেন।
নির্বাচনী কার্যক্রমের সাথে জড়িত অপর এক শীর্ষ নেতা এ প্রতিবেদককে বলেন, এবার খালেদা জিয়া ছাড়া কেউই একাধিক আসনে প্রতিদ্বন্ধিতার সুযোগ পাবে না। তবে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও মহাসচিব প্রয়োজনবোধে দুটি করে আসনে নির্বাচন করতে পারেন। সেই দুইটি আসনের একটি রাজধানীতেই হতে পারে বলে তিনি ইঙ্গিত করেন।