
জাতীয় পার্টিতে আবার দেখা দিয়েছে বিবাদ। শুরু হয়েছে ‘প্লাস-মাইনাসের’ রাজনীতি।
দলটির একাংশ পার্টির চেয়ারম্যানকে ‘মাইনাস’ করে সমঝোতার মাধ্যমে আসন্ন নির্বাচনে বৃহৎ কোনো জোটের অংশ হতে চাইছে বলে অভিযোগ স্বয়ং পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদেরের। যদিও দলের একাধিক সিনিয়র নেতার ভাষ্য, গঠনতন্ত্রের একটি ধারা সংশোধনের প্রস্তাবকে ঘিরে বিরোধের জেরে চেয়ারম্যান ঘোষিত কাউন্সিল স্থগিত করায় এই অবস্থা তৈরি হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলছেন, কাউন্সিলে কাউন্সিলররা সিদ্ধান্ত নেবেন কারা নেতৃত্বে থাকবেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, এই বিরোধ এক প্রকারের 'নাটক'। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি বিরোধী জোটে যুক্ত হওয়ার জন্য জাতীয় পার্টি এই নাটক শুরু করে থাকতে পারে। কারণ প্রায় সব নির্বাচনের আগেই জাতীয় পার্টিতে বিবাদ-বিরোধের এ ধরনের নাটক বহুবার মঞ্চস্থ হয়েছে।
জানা গেছে, গত ২০ মে জাপার শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে আগামী ২৮ জুন সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। আকস্মিক এই সম্মেলন স্থগিত করেন পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। এর পেছনে সম্মেলনের জন্য বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র পাওয়া যায়নি কারণ দেখান তিনি। তার আগে নীতি-নির্ধারকদের বৈঠকে জাপার গঠনতন্ত্রের একটি ধারা সংশোধনের প্রস্তাব ওঠে। আলোচিত ২০(ক) ধারা অনুযায়ী, দলের চেয়ারম্যান যে কোনো সময় যে কোনো পদবির নেতাকে অব্যাহতি দিতে পারেন।
কিন্তু চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের স্থগিত করা ২৮ জুনেই সম্মেলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন দলের জ্যেষ্ঠ কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলার, মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ও তাদের সমর্থক নেতারা। সূত্র মতে, কাউন্সিলে চেয়ারম্যান প্রার্থী হচ্ছেন ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও মহাসচিব প্রার্থী হচ্ছেন রুহুল আমিন হাওলাদার। দুজনেই গণঅভ্যুত্থানে বাতিল হওয়া বিগত সংসদের সদস্য (এমপি) ছিলেন।
এছাড়া ২০২৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে অংশ নেওয়া বেশিরভাগ প্রেসিডিয়াম সদস্যও রয়েছেন আনিস-হাওলাদার-চুন্নু অংশে। এমনকি বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের মনোনয়ন বঞ্চিত ঢাকা মহানগরের কয়েকজন সাবেক এমপি ও নেতাও যুক্ত হচ্ছেন নতুন এই অংশে।
এই পরিস্থিতিকে ষড়যন্ত্র মনে করছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের। তার সন্দেহ, দলটিকে ভেঙে একাংশকে নির্বাচনে নিতেই এই অবস্থা তৈরি করা হয়েছে।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমি শুনেছি, আমাকে নেতা-কর্মীরা বলেছে, ওরা (আনিস-হাওলাদার) নেতা-কর্মীদের বলছে—সরকারের ঘনিষ্ঠদের পক্ষ থেকে নাকি বলা হয়েছে, ওদের সঙ্গে থাকলে ওদের এয়াপোর্টে আটকানো হবে না। যে যার মতো ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিদেশ ভ্রমণ করতে পারবে। ওরা নাকি পার্টির লোকদের এও বলছে, জি এম কাদেরকে কিছুদিনের মধ্যেই জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। আর নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকেও ওদের লাঙল প্রতীক দেওয়া হবে। আমাকে মাইনাস করে ওদের দিয়ে নির্বাচন করাতেই পার্টির ভেতরে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হচ্ছে। কেননা, জাতীয় পার্টি ছাড়া নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না।
গঠনতন্ত্র সংশোধনের আলাপের বিষয়ে জি এম কাদের বলেন, ওরা (আনিস-হাওলাদার) সংস্কার করতে চায়। পার্টির চেয়ারম্যানের ক্ষমতা হ্রাস করতে চায়। এটার জন্য তো প্রেসিডিয়ামের ফোরাম আছে। আমি তো শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে দিয়ে গঠনতন্ত্র সংশোধনের কমিটিও করে দিয়েছি। ফোরামে আলোচনা না করে ওরা যা করছে তা ষড়যন্ত্র ও নেতা-কর্মীদের বিভ্রান্ত করার জন্য।
জাতীয় পার্টিতে এই বিরোধ তৈরির পেছনে একটি বড় দলের ইন্ধন রয়েছে বলেও অভিযোগ জিএম কাদেরের। তিনি বলেন, একটি বড় রাজনৈতিক দলের ইন্ধন রয়েছে ওদের পেছনে। এজন্যই ওরা আমাকে মাইনাস করতে চাচ্ছে। ক্ষমতাহীন করতে চাচ্ছে। ওই দলের সঙ্গে থাকলে ওরা হয়তো ২/৪টা সিট পাবে। এজন্য কাউন্সিলের নামে আমার হাত-পা বেঁধে আমাকে ক্ষমতাহীন করতে চাচ্ছে।
জি এম কাদের অভিযোগ করে বলেন, ওরা এখন যা করছে ২০১৪ সালে আমার ভাইয়ের (প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ) সঙ্গে ও ২০২৪ সালে আমার সঙ্গে শেখ হাসিনাও তাই করেছিল। ওরা আমাকে শেখ হাসিনার মতো ব্ল্যাকমেইল করতে চাচ্ছে। তাহলে ওদের সঙ্গে শেখ হাসিনার পার্থক্য কোথায়?
কাউন্সিল নিয়ে এই অচলাবস্থায় সমঝোতার কোনো সম্ভাবনা রয়েছে কি না জানতে চাইলে জি এম কাদের বলেন, ওদের সঙ্গে সমঝোতার কিছু নেই। আমরা কাউকে বহিষ্কার করি না। যারা থাকার থাকবে না থাকলে চলে যাবে। পার্টির কর্মীরা আমাদের সঙ্গে আছে, থাকবে।
দলের চেয়ারম্যানের এমন অভিযোগের বিষয়ে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বাংলানিউজকে বলেন, সম্মেলনের তারিখ তো ২০ মে প্রেসিডিয়াম বৈঠকে ঠিক হয়েছে। প্রেসিডিয়ামের সিদ্ধান্ত ছিল যদি চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে ২৮ জুন বুকিং না করা যায় তাহলে কাকরাইল পার্টি অফিসে সম্মেলন হবে। কিন্তু চেয়ারম্যান একক সিদ্ধান্তে সম্মেলন স্থগিত করেছেন। এমনকি আমাকেও জানানোর প্রয়োজন মনে করেননি। আর সম্মেলন তো কাউকে বাদ দেওয়ার জন্য হচ্ছে না। সেখানে দুটি প্যানেল হবে, যারা জয়ী হবেন, তারাই নেতৃত্বে আসবেন।
জিএম কাদেরের পক্ষ থেকে ‘সরকার ও বড় একটি দলের ইন্ধনে জাপা ভাঙার ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগ সম্পর্কে চুন্নু বলেন, আমি দলের মহাসচিব। আমার সঙ্গে তো কেউ যোগাযোগ করেননি। হয়তো বা আমি ছোট মানুষ। তেমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ না। এজন্য কেউ যোগাযোগ করেননি। আর আমাদের নেওয়ার জন্য কেউ তো বসে নাই। আমরা এমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠিনি যে আমাদের নেওয়ার জন্য কেউ টানাটানি করবে। আসলে দলের গঠনতন্ত্র সংশোধনের জন্য সম্মেলন হচ্ছে। যেটা প্রেসিডিয়ামের সিদ্ধান্ত ছিল।
আপনি সম্মেলনে থাকছেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে চুন্নু বলেন, সম্মেলনের তারিখ তো প্রেসিডিয়ামের সিদ্ধান্ত। প্রেসিডিয়ামের সিদ্ধান্তে তো সম্মেলন স্থগিত হয়নি।
তাহলে দল ভাঙছে কি না জানতে চাইলে জাপা মহাসচিব বলেন, আমরা চাই না দল ভাঙুক। কাউকে তো বহিষ্কার করা হয়নি। সবাই দলে আছেন। আমিও চাই সবাই মিলেই দলটা করি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় পার্টির একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য বাংলানিউজকে বলেন, আসলে এখন যা হচ্ছে তা প্লাস-মাইনাস নয়। দলই তো নেই। এখানে ভাঙা-গড়ার কী আছে। যা হচ্ছে দলকে বাঁচিয়ে রাখার 'কৌশল'। জাতীয় পার্টির একাংশের সঙ্গে সরকার ঘনিষ্ঠ নতুন কিছু দলের যোগাযোগ হয়েছে বা হচ্ছে। যদি বিএনপি বিরোধী বৃহৎ কোনো জোট হয় তাহলে জাতীয় পার্টিকে সেই জোটে রাখার জন্যও আলোচনা হচ্ছে। বিএনপির তো আর জাতীয় পার্টিকে এখন দরকার নেই। বিএনপি বিরোধী ওই সম্ভাব্য জোট মনে করছে, ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগ যেমন ক্ষমতায় আসবে ধরে নেওয়া হলেও আসতে পারেনি। এবারও বিএনপির ক্ষেত্রে তাই হতে পারে। এজন্য জাতীয় পার্টিকে বৃহত্তর রংপুর ও উত্তরাঞ্চলের জন্য প্রয়োজন।
'নির্বাচনের পূর্বে সবসময় জাপার ভাঙন-বিবাদ পরিকল্পিত', প্রচলিত এমন অভিযোগের বিষয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মঈনুর রাব্বি চৌধুরী রুমনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আসলে দলের প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও জি এম কাদের ছাড়া বাংলাদেশের কেউ জাতীয় পার্টি মেনে নেবে না। জাতীয় পার্টি মানেই এই দুইজন। আমাদের সিনিয়ররাও এটা বোঝেন। এজন্য এটা নাটক হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে।
স্বৈরাচার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি বিভিন্ন সময়ে ভাঙনের শিকার হয়েছে। ২০১৯ সালে এরশাদের মৃত্যুর পর দলের কর্তৃত্ব নিয়ে তার ভাই জি এম কাদের ও স্ত্রী রওশন এরশাদের মধ্যে প্রকাশ্য বিরোধ হয়েছে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন পতিত ফ্যাসিবাদী সরকারের সঙ্গে উভয়পক্ষেরই সখ্য থাকার বিষয়টি ছিল প্রকাশ্য। এমনকি সংসদীয় বিরোধীদলের পাশাপাশি তাদের অনেকে হাসিনার সরকারের মন্ত্রিসভায়ও ছিলেন।