
আগামী ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে পারে—এমন প্রত্যাশায় দেশজুড়ে ভোটের প্রস্তুতি চলমান। প্রতি আসনেই বিএনপির একাধিক প্রার্থী। শেষ পর্যন্ত দলের মনোনয়ন কে পাবেন তা নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা। জামায়াতে ইসলামী গত বছরই দুই শতাধিক আসনে তাদের প্রার্থী চূড়ান্ত করে মাঠে নামিয়ে রেখেছে।
তাঁরা বলছেন, নির্বাচনের আগেই গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী সংস্কার দরকার। এগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলো যত দ্রুত একমত হবে, তত দ্রুত নির্বাচন হবে। এ অবস্থায় নির্বাচন কবে হবে তা নিয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। কেউ বলছেন, নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার ইচ্ছাটি পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন : নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার গতকাল শনিবার কালের কণ্ঠের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘সংস্কারের প্রস্তাবগুলোর অনেক বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে, আবার অনেক বিষয়ে হয়নি। আমরা আশাবাদী আরো কতগুলো বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হবে এবং আশা করছি যথাসময়ে জাতীয় সনদে দলগুলো সই করবে এবং তা প্রণয়ন হবে।
সে ক্ষেত্রে রোজার আগেই নির্বাচন সম্ভব। কিন্তু শুধু নির্বাচন হলেই হবে না। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে হবে; যার মাধ্যমে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ প্রশস্ত হবে। সুষ্ঠু নির্বাচন আগেও হয়েছে, কিন্তু তাতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সে কারণে জুলাই অভ্যুত্থান ঘটেছে। আমাদের কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী সংস্কার দরকার। এগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলো যত দ্রুত একমত হবে, তত দ্রুত নির্বাচন হবে।’
তাহলে তো নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় নিয়ে ‘যদি, কিন্তু’ থেকেই যাচ্ছে—এ প্রশ্নে তিনি বলেন, অবশ্যই। ‘যদি-কিন্তু’ থাকবেই। কারণ নির্বাচন তো এক পক্ষের না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বীর আহমেদও মনে করেন, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে সংশয়, সন্দেহ দূর হয়নি। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা কী চাচ্ছেন তা এখনো আমাদের কাছে পরিষ্কার না। উনাকে ঠিক বুঝতে পারছি না। গত ১৩ জুন লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকে তিনি বলেছেন, ‘সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে।’ এখানেই অস্পষ্টতা রয়েছে। সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি বলতে কতটা অগ্রগতি তিনি চেয়েছেন তা স্পষ্ট না। রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার প্রস্তাবগুলোর কতভাগ একমত হলে তিনি নির্বাচন দিতে যাবেন সেটিও বলেননি। তাঁর ইচ্ছাটি পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে না। প্রধান উপদেষ্টা একেক সময় একেক কথা বলেন। আগামী রোজার আগেই নির্বাচন হবে কি না সে নিশ্চয়তা উনিই দিতে পারেন। আমার মনে হচ্ছে, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন করার ইচ্ছা প্রধান উপদেষ্টার নেই। এনসিপিকে প্রস্তুত হতে সময় দেওয়া হতে পারে। এ ছাড়া ভোটার তালিকা নিয়েও সমস্যা হতে পারে। বিদ্যমান ভোটার তালিকা আইন অনুসারে প্রতিবছর ২ মার্চ চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করতে হয়। ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন করতে হলে ডিসেম্বরের মাঝামঝি নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে ভোটার তালিকাও সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। আবার ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন না হয়ে এপ্রিলে নির্বাচন হবে সে নিশ্চয়তাও নেই। আরো অনেক সমস্যা সামনে চলে আসতে পারে। তবে প্রধান উপদেষ্টা চাইলে যেকোনো সময় নির্বাচন সম্ভব। সব কিছুই উনার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। রাজনৈতিক দলগুলোও মুখে যতই বলুক, বাস্তবে উনার প্রতি দলগুলোর মনোভাব নরম।”
নির্বাচন কমিশন এখনো নিশ্চিত নয় : ভোট কবে হবে সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশন এখনো নিশ্চিত নয়। গত ১৬ জুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, “আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে, সে বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের এখনো আলোচনা হয়নি বা সরকারের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো বার্তা পাওয়া যায়নি। জাতীয় নির্বাচনের সময় নিয়ে যে বিষয়টি এসেছে, যখনই হোক—ফেব্রুয়ারিতে হোক অথবা এপ্রিলে হোক, আমাদের তো প্রস্তুত থাকতে হবে। আগে ডিসেম্বর থেকে জুনের কথা বলা হয়েছিল; এখন আবার নতুন ডাইমেনশন আসছে। লন্ডনে যা আলোচনা হয়েছে এর বাইরে আমার কোনো নলেজ নেই। সরকারের সঙ্গে আমাদের এখনো আলোচনা হয়নি। সরকারের সঙ্গে আলোচনা হলে সরকারের ‘ভাব’ বুঝতে পারব।”
গতকালও সিইসি বলেন, সরকারের সহযোগিতা নিয়ে নির্বাচন করতে হবে। নির্বাচনের সময় আসলে আপনারা সবাই জানতে পারবেন। এ বিষয়ে পরিকল্পনা করে, ঘোষণা দিয়ে সরকারের সঙ্গে দেখা করতে হবে এমন না।
দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য : লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের পর রোজার আগেই নির্বাচনের সম্ভাবনা নিয়ে যৌথ বিবৃতি ভালোভাবে নেয়নি জামায়াতে ইসলামী। দলটির অভিযোগ, এতে প্রধান উপদেষ্টার নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হয়েছে। জামায়াতের এই প্রতিক্রিয়া কেবল বিবৃতির মধ্যে থেমে থাকেনি। এ বিষয়ে প্রতীকী প্রতিবাদ জানাতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফার প্রথম দিনের সংলাপে যোগ দেয়নি দলটি। পরে গত ১৮ জুন দ্বিতীয় দিনের সংলাপে যোগ দিয়ে দলটির পক্ষে জানানো হয়, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফোন করে নিরপেক্ষ থাকার আশ্বাস দেওয়ায় সংলাপে যোগ দিয়েছেন তাঁরা। দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার পর নির্বাচনের তারিখ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে পরিবর্তন হলে সমস্যা ছিল না। বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল। তাদের দাবি থাকতে পারে। তবে এটা ভালো হতো যদি প্রধান উপদেষ্টা দেশে ফিরে টেলিভিশনে ঘোষণার মাধ্যমে তারিখটা পরিবর্তন করতেন। সেটা তিনি করেননি। আমরা খুব বিস্মিত হয়ে দেখলাম একটি দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে তাঁরা যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন। এ দেশে ১০০টিরও বেশি রাজনৈতিক দল আছে। তাহলে তো এমন কালচার তৈরি হবে, উনি (প্রধান উপদেষ্টা) যাঁদের সঙ্গেই কথা বলবেন, জয়েন্ট স্টেটমেন্ট দিতে হবে। এই যৌথ বিবৃতিতে আমাদের আপত্তি।’
আর জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, বিদেশের মাটিতে নির্বাচন নিয়ে বৈঠক করে ‘দেশকে পেছনের দিকে’ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ প্রথমে লন্ডন বৈঠককে স্বাগত জানালেও পরে এক বিবৃতিতে জামায়াতের মতোই যৌথ বিবৃতির বিষয়ে আপত্তি জানায়। তবে দেশের বেশির ভাগ দল লন্ডন বৈঠকের বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবেই মূল্যায়ন করে।
এদিকে লন্ডন বৈঠকে যেসব দল নাখোশ তাদের বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত ১৮ জুন দলের এক অনুষ্ঠানে বলেন, ভোট হলে যাদের আর গুরুত্ব থাকবে না, তারাই এখন ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচনের ঘোষণায় নাখোশ হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এখন নির্বাচন নেই সুতরাং তাদের অনেক গুরুত্ব আছে। যেই নির্বাচন হয়ে যাবে, জনগণের যারা ভালোবাসার দল, তারাই তো ক্ষমতায় আসবে। তখন তাদের গুরুত্ব কতটুকু থাকবে কী থাকবে না, তখন নির্ধারিত হবে।’
তিনি বলেন, ‘এখন নির্বাচন নেই সুতরাং তাদের অনেক গুরুত্ব আছে। যেই নির্বাচন হয়ে যাবে, জনগণের যারা ভালোবাসার দল, তারাই তো ক্ষমতায় আসবে। তখন তাদের গুরুত্ব কতটুকু থাকবে কী থাকবে না, তখন নির্ধারিত হবে।’
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপেও এ ধরনের বিভাজন স্পষ্ট। রাষ্ট্র ক্ষমতার ভারসাম্য আনার লক্ষ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের বিষয়টি নিয়ে বিএনপি বিরোধিতা করেছে। বিএনপির সমমনা ১২ দলীয় জোট, সিপিবি, গণফোরামসহ বেশ কয়েকটি দল এনসিসি গঠনের বিরুদ্ধে। তাদের যুক্তি, এনসিসি গঠন হলে বিভক্ত হবে নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা, যা অস্থিতিশীলতা তৈরি করবে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ পার্টিসহ (এবি পার্টি) কয়েকটি দল এনসিসি গঠনের পক্ষে মত দিয়েছে। তবে তারা এনসিসির গঠনপ্রক্রিয়া নিয়ে কিছু ভিন্নমতের কথা বলেছে। এ ধরনের আরো কিছু সংস্কার প্রস্তাব বিষয়ে দলগুলো পক্ষে- বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি নিয়েও দলগুলো ঐকমত্যে আসতে পারেনি। ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধিদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডার পর বাম নেতাদের সংলাপ বয়কট করে আবারও যোগ দেওয়ার ঘটনা ঘটে।
সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে এনসিপির সর্বশেষ অবস্থান জানতে চাইলে দলটির সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা সব সময় স্পষ্ট করে বলেছি, রাষ্ট্রের যে শাসনব্যবস্থা রয়েছে এবং যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি রয়েছে, সেটার মৌলিক সংস্কার আমরা চাই। এটি একটি অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা। সেই জায়গা থেকে আমরা বারবার বলে এসেছি, মৌলিক সংস্কার ছাড়া নির্বাচন কিংবা যা কিছু করা হবে সেটা আসলে ফলপ্রসূ হবে না। এখনো আমরা এই জায়গাতেই অবস্থান করছি। আমরা মৌলিক সংস্কারের পথেই রয়েছি।’