Image description

আমাদের রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য মহানগরে শব্দদূষণ বলতে বুঝি মোটরযানে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ও অপ্রয়োজনে হর্ন বাজানোর ফলে নাগরিকদের শ্রবণশক্তির পক্ষে ক্ষতিকর অতিরিক্ত আওয়াজ। রাজনীতিতে শব্দদূষণের যে আলোচনা এখন তুলছি তা হচ্ছে ভাষা ও বিষয়বস্তুর দিক থেকে শব্দের অপপ্রয়োগ ও কদর্থ করা, কখনো না বুঝে, কখনো অসদুদ্দেশ্যে, বিশেষ কোনো মতলবে। ছাত্রদের আন্দোলন-অভ্যুত্থানের ফলে সদ্য বিদায়ী বছরের ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনার সাড়ে পনের বছরের একচ্ছত্র স্বৈরশাসন উৎখাত হয়ে বিদায় নেয়ার পর কিছু পুরনো ও নতুন রাজনৈতিক শব্দ বারংবার উচ্চারিত হচ্ছে, সেগুলোর উৎপত্তি, অর্থ-কদর্থ একটু খতিয়ে দেখা যাক। পুরনো শব্দগুলোর ইতিহাস ও অর্থ আমাদের জানা, কিছু কিছু তর্ক থাকতে পারে যা একাডেমিক পরিসরে আছে ও থাকবে। কিছু শব্দ ও শব্দগুচ্ছ নতুনভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে বা এই প্রথম শোনা যাচ্ছে স্পষ্ট-অস্পষ্ট কিছু ধারণা ব্যক্ত করতে। সেই ধারণাগুলো নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছে। পুরনো-নতুন শব্দ ও শব্দগুচ্ছগুলোর মধ্যে আছে ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট, ফ্যাসিবাদের দোসর, গণহত্যা, জেনোসাইড, বিপ্লব, দ্বিতীয় স্বাধীনতা, নতুন বাংলাদেশ বা আরও স্টাইলিশ বাংলাদেশ ২.০, জুলাই বিপ্লবের স্পিরিট, জুলাই বিপ্লবের অভিপ্রায়, মুজিববাদ, প্রোক্লেমেশন অফ রিপাবলিক ইত্যাদি।


২০২৪ সালের পহেলা জুলাই ছাত্রদের একটি নতুন প্ল্যাটফরম ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামে আত্মপ্রকাশ করে ছাত্র-তরুণদের জনপ্রিয় দাবি চাকরির কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবির আন্দোলনটি নতুনভাবে জোরদার করে তোলে। ২০১৮ সালে এই দাবি উঠলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা ব্যবস্থার সংস্কার না করে সব কোটা বাতিল করে দিয়েছিলেন অনেকটা রাগ করে, যা একজন অভিজ্ঞ সরকারপ্রধানের পক্ষে সঙ্গত নয়। পুরো বাতিল করায় নাগরিকদের অনগ্রসর অংশের বিশেষ সুবিধা দেয়ার সংবিধানের বিধান লঙ্ঘিত হয়। তাই রিট হলে কয়েক বছর পরে সরকারের সিদ্ধান্তটি হাইকোর্ট অবৈধ বলে রায় দেয়। তখনই ওই নতুন ছাত্রনেতারা কোটা ফিরে আসতে পারে আওয়াজ তুলে রাজপথে নামার ডাক দেন। সরকার এ অবস্থা মোকাবিলায় ব্যর্থ হয় ও ভুল পদক্ষেপ নেয়। সরকারি দলের পেটোয়া বাহিনী ছাত্রলীগের দ্বারা পিটিয়ে আন্দোলন দমনের কৌশল বুমেরাং হয়ে যায় এবং পুলিশি ব্যবস্থায় গেলে রাজপথ শত শত মানুষের রক্তে রঞ্জিত হয়ে ওঠে। আন্দোলনকারীদের তরফেও স্পষ্টত গোপন পরিকল্পনায় আক্রমণে অনেক পুলিশেরও প্রাণ যায়। আন্দোলনটি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শান্তিপূর্ণ ছাত্র-গণআন্দোলন নয়; ছাত্রদের ব্যাপক সমর্থন থাকলেও রাজপথে রহস্যজনক কিছু মহলের তৎপরতা ছিল তা এখন স্পষ্ট। নিষিদ্ধ ঘোষিত আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন হিজবুত তাহরীরের সদস্যদের মিছিলে পতাকা নিয়ে অংশ নেয়ার সংবাদচিত্র মিডিয়ায় রয়েছে। আন্দোলনে শহীদদের সকলেই পুলিশের গুলিতে নয়, অজ্ঞাতপরিচয় বন্দুকধারীদের গুলিতেও নিহত হয়েছে বলে সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে। এই সন্দেহের নিষ্পত্তি সম্ভব যথাযথ তদন্ত হলে। তবে সন্দেহ নেই যে, মাত্র তিন সপ্তাহের রাজপথের তীব্র আন্দোলনে  শেখ হাসিনার পতনের কারণ হলো তিনটি জাতীয় নির্বাচনে নগ্ন কারচুপি করে ক্ষমতা আঁকড়ে থেকে ঘৃণ্য দুর্নীতিযুক্ত শাসনের ফলে জনসমর্থনের ভিত্তি একেবারে নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। 


এই অপশাসনের পতনের পরে জনগণের স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী দেশের রাজনীতির যৌক্তিক গতিপথ হওয়া উচিত ছিল গণতন্ত্রের পথে ফিরে আসা, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা, যার শুরু হবে হাসিনার দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত নির্বাচন সঠিকভাবে আয়োজন করে এবং জনগণকে ভোটের অধিকার প্রয়োগ করতে দিয়ে। কিন্তু ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের মুহূর্ত থেকেই দেশে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের সকল নিদর্শন, স্মারক, স্থাপনা ও ব্যক্তি, পরিবার, প্রতিষ্ঠানের উপরও এমন হিংস্র আক্রমণ শুরু হলো যে, এই আন্দোলনের পেছনে ছাত্রসমাজ ও গণতান্ত্রিক শক্তি ছাড়াও ছদ্মবেশে পরিকল্পিতভাবে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি রয়েছে বলে ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকলো এবং বিশ্বখ্যাত নোবেলবিজয়ী, গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বে একটি দলনিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকার দেশ চালনার দায়িত্ব নিলেও পরিস্থিতি ঘোলাটে, অনৈক্য ও সংঘাতের আশঙ্কাপূর্ণ হয়ে উঠলো। সরকার সদুদ্দেশ্যে যেসব সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন সেগুলোর অজুহাতে এবং অতিরিক্ত দাবি তুলে নির্বাচনকে পিছিয়ে দেয়ার জন্য কিছু মহল তৎপর আছে। এই মহলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক মহল কৌশলগতভাবে কিছুটা নিম্নস্বরে থাকলেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক পরিচয়ের গ্রুপটি ১৯৭২ সালে বলবৎ দেশের সংবিধানকে ‘কবর দেয়ার’ মতো আওয়াজ ও আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার আগ্রাসী দাবি তুলছে। এই পটভূমিতেই ওই রাজনৈতিক শব্দদূষণ বিচার্য।  


‘ফ্যাসিবাদ’, ‘বিপ্লব’, ‘গণহত্যা’ প্রভৃতি শব্দগুলোর ভাষিক অর্থ, ব্যুৎপত্তি, সংজ্ঞা ও সংজ্ঞার্থ না বুঝে বেধড়ক ব্যবহার করা হচ্ছে। উচ্চপদস্থ জ্ঞানী লোকেরাও তা করছেন। এর ফলে বিষয়বস্তুর প্রকৃত অনুধাবন এবং ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রদের জ্ঞান অর্জনের পথে অন্তরায় ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে।  


তিরিশ বছর ধরে প্রবাসী বাংলাদেশের কবি, বিশ্বে খ্যাতি অর্জনকারী তীক্ষ্ণধী মানবতাবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিন সর্বপ্রথম এই দিকটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তার ফেসবুক পোস্টে গত ২রা নভেম্বর ২০২৪-এ যা লিখেছিলেন সেটি আমি প্রায় সবটুকু উদ্ধৃত করতে চাই বিষয়টি প্রাঞ্জলভাবে তুলে ধরার জন্য। দেশের ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর আক্রমণের মুখে প্রাণ রক্ষার্থে এই লেখিকা দেশত্যাগে বাধ্য হলেও  দেশে আসতে চান এবং বাইরে থেকে প্রতিনিয়ত দেশের পরিস্থিতি গভীর মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ ও প্রকাশ করেন। ওই পোস্টে তিনি লেখেন: “সেই যে আগস্ট থেকে ফ্যাসিস্ট শব্দটি  উচ্চারিত হচ্ছে, আজও বন্ধ হচ্ছে না। ফ্যাসিস্ট মানে কী, তা ভালো করে না জেনেই সমন্বয়করা  এই শব্দটি আমদানি করেছে। এখন এমন হয়েছে হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট না বলা মানে হাসিনাকে সমর্থন করা। আমি হাসিনার সরকারকে ফ্যাসিস্ট সরকার বলি না, আমি তাকে ‘গণতান্ত্রিক সরকার হয়েও সুষ্ঠু গণতন্ত্রের চর্চা না করা, দুর্নীতি করবে না শপথ করেও দুর্নীতি করা, বাকস্বাধীনতা মানবে কথা দিয়েও বাকস্বাধীনতা না মানা, ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে বলার পরও ইসলামকে সব ধর্মের উপরে রাখা, বিরোধী দলের ক্ষতি করছে না বলেও ক্ষতি করা, মানবাধিকার লঙ্ঘন করবে না কথা দিয়েও লঙ্ঘন করা  সরকার’ বলি। এইসব প্রতারণা, ছলচাতুরী, এইসব স্বার্থপরতা সব সরকারই করে, ...হাসিনার সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিল বলে তার দোষ বেশি চোখে পড়ে। হাসিনা আক্ষরিক অর্থে ফ্যাসিস্ট নন। তাকে ফ্যাসিস্ট বললে ফ্যাসিজমের ভয়াবহতাকে ছোট করে দেখা হয়। ফ্যাসিজম ভয়ঙ্কর জিনিস। ফ্যাসিস্টের উদাহরণ হিটলার, মুসোলিনি। তাদের কারণে ৯ কোটি মানুষ নিহত হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল শুধু কিছু সাদা ত্বকের নীল রক্তের মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা, বাকি সব কালো হলুদ বাদামি মানুষকে  হত্যা করা। সব পঙ্গু, প্রতিবন্ধীকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া। সব কমিউনিস্টকে, সব জিপসিকে, সব ভিন্ন ধর্মের, ভিন্ন বর্ণের, ভিন্ন জাতের মানুষকে মেরে ফেলা।  ফ্যাসিস্ট বললে তাদের ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা মনে পড়ে। সত্যিকার ফ্যাসিস্টের  তুলনায় হাসিনা কিছুই নন, মন্দ কিছু যদি বলতেই হয়, তাহলে নিতান্তই স্মল টাইম থাগ।”


এই মুহূর্তেও বিশ্বের অন্য কোনো দেশের সংবাদমাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা ও তার সরকারকে ফ্যাসিস্ট বলা হচ্ছে না। ডিকটেটর, অটোক্র্যাট, অথরিটেরিয়ান, টোটালিটেরিয়ান প্রভৃতি বলা হচ্ছে। উল্লেখ করা যায়, ইরাকের সাদ্দাম হুসেনের সরকার ও তার বাথ পার্টির কার্যকলাপ শেখ হাসিনার চেয়ে অনেক বেশি ফ্যাসিবাদী ধরনের হলেও তাকে উৎখাতকারী আমেরিকাসহ পশ্চিমী দুনিয়া তাকে ফ্যাসিস্ট বলে না। ইতিহাসে বিশ শতকের প্রথম ভাগে ইতালির মুসোলিনি, জার্মানির হিটলার ও স্পেনের ফ্র্যাঙ্কোর ফ্যাসিবাদ এই শাসনপদ্ধতির সংজ্ঞা তৈরি করেছে। তারা নিজেদের পরিচয় এই নামেই দিয়েছেন। বর্তমান বিশ্বে গণতন্ত্রের স্খলন ও  স্বৈরশাসনের নানা ধরন আছে, মাত্রা আছে। সবই ফ্যাসিবাদ নয়, সবাই ফ্যাসিস্ট নন।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা আদিলুর রহমানের বিখ্যাত মানবাধিকার নজরদারি প্রতিষ্ঠান ‘অধিকার’ জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০২৪ প্রান্তিকের যে নিয়মিত দ্বিভাষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে শেখ হাসিনার সরকারকে ইংরেজি বয়ানে ‘অথরিটেরিয়ান অ্যান্ড রিপ্রেসিভ রেজিম’ এবং বাংলায় ‘কর্তৃত্ববাদী শাসন’ উল্লেখ করা হয়েছে। একবারও ফ্যাসিস্ট শব্দ ব্যবহার করা হয়নি। তিনিও তার প্রাতিষ্ঠানিক দলিলে না লিখলেও মুখে হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট বলছেন। 


বাংলায় ‘গণহত্যা’ আমরা ইংরেজির ‘ম্যাস্‌্‌ কিলিং’ ও ‘জেনোসাইড’ উভয় অর্থে ব্যবহার করি। আমাদের আলাদা শব্দ নেই। জুলাই-আগস্টে আন্দোলনের সময় যে বিপুল সংখ্যক হত্যা সংঘটিত হয়েছে তাকে ম্যাস্‌্‌ কিলিং অর্থে হত্যাযজ্ঞ বা বিপুল হত্যাযজ্ঞ বললে ঠিক আছে, কিন্তু এই নিহতের সংখ্যা বেশি হলেও এ ঘটনা কিছুতেই  ‘জেনোসাইড’ নয়। অধিকার-এর প্রতিবেদনে ইংরেজিতে ‘ম্যাসাকার’ ও বাংলায় ‘হত্যাযজ্ঞ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, ‘জেনোসাইড’ ও ‘গণহত্যা’ নয়। 
জেনোসাইড নিহত মানুষের সংখ্যা দ্বারা নিরূপিত হয় না। হয় হত্যাকাণ্ডের লক্ষ্য ও চরিত্র অনুযায়ী। অল্প সংখ্যক মানুষের হত্যাও  জেনোসাইড যদি তা জাতি, ধর্ম, গোত্র, লিঙ্গ প্রভৃতি কোনো না কোনো বিশেষ মানবগোষ্ঠীকে নির্মূল করার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। মাত্র কয়েক ডজন মানুষের একটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে মেরে নিঃশেষ  করলে বা করতে চাইলেও জেনোসাইড। হিটলার যখন ইহুদিদের নির্মূলের জন্য পদ্ধতিগত হত্যাযজ্ঞ চালান তখন তা জেনোসাইড। পাকিস্তানি বাহিনী জাতি হিসেবে বাঙালিদের লক্ষ্য করে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। পরে হিন্দুদের শুধু ধর্ম পরিচয়েই হত্যা করতো। এটা জেনোসাইড। এখনো এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি। রুয়ান্ডায় টুটসি জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল করার জন্য জেনোসাইড হয়েছিল। এটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। 
শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট, আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিবাদী দল বলে তাকে নিষিদ্ধ করা বা নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার দাবি তুলে প্রকৃত ফ্যাসিবাদকে না বুঝে এই বিভ্রান্তির আড়ালে আওয়ামী লীগকে ঠেকিয়ে অন্য নামের প্রকৃত ফ্যাসিবাদীদের পথ পরিষ্কার করা হয় কি-না সেটা দুশ্চিন্তার বিষয়। 
তবে শেখ হাসিনার শাসনামলে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যার যেসব ঘটনা ঘটেছে সেগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধ। এর বিচার অবশ্যই হতে হবে। সুনির্দিষ্ট অপরাধীদের, হুকুমদাতাদের যথাযথ বিচার করেই তা হতে হবে।  


কোনো বিপ্লবী লক্ষ্য, বিপ্লবী দল বা কর্মসূচি ও তাতে জনগণকে প্রস্তুত না করে বিক্ষুব্ধ মানুষের অভ্যুত্থানে একটি সরকার বদলকে ‘বিপ্লব’ ‘বিপ্লব’ বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলা হচ্ছে। এবং আগে যেসব দাবি ছিল না সেগুলোকে সামনে এনে সরকার পতনের পরে ‘শহীদদের আকাঙ্ক্ষা’, ‘বিপ্লবের অভিপ্রায়’ ইত্যাদি বলে চালানো হচ্ছে। বিশিষ্ট বামপন্থি তাত্ত্বিক, গবেষক, রাজনীতিক ও লেখক বদরুদ্দীন উমর গত ২৬শে অক্টোবর ২০২৪-এ ‘জনতার চোখ’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে বলেন, “একটি বড়... এই পরিবর্তন কোনো সামাজিক বিপ্লব নয়। এখানকার উৎপাদন সম্পর্ক, বণ্টন সম্পর্ক এই আন্দোলন পরিবর্তন করে দিয়েছে এমন সমাজবিপ্লব এটি নয়।” তবে এই পরিবর্তন ভবিষ্যতে ক্ষমতায় আসা রাজনৈতিক দলগুলোকে সাবধান করবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। 
সামাজিক বিপ্লব দূরের কথা- পুরানা রাষ্ট্রপতির কাছে সংবিধানের অধীনে শপথ নিয়ে সরকার গঠন কোনো রাজনৈতিক বিপ্লবও নয়। তা এখন প্রতিদিন প্রমাণিত হচ্ছে। সরকারের নিয়োজিত সংবিধান বিষয়ে সংস্কার কমিশনের প্রধান মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলী রিয়াজ গত ১৪ই সেপ্টেম্বর ‘দি ডেইলি স্টার’-এ প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করে বলেছিলেন, “এটি গণঅভ্যুত্থান, গণমানুষের অভ্যুত্থান।...বিপ্লব বলবো না এ কারণে যে, বিপ্লবের পর নেতৃত্বদানকারীরা সরকার গঠন করে। এক্ষেত্রে তা হয়নি।” ঘোরতর হাসিনা-বিরোধী ইউটিউবযোদ্ধাদের অন্যতম জনপ্রিয় বিশ্লেষক জাহেদুর রহমানও তার ‘জাহেদস টেক’ চ্যানেলে বিপ্লব না বলে গণঅভ্যুত্থান বলেছেন যুক্তি দিয়ে। 


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ইতিহাসের উঁচু আসন থেকে টেনে নামাতে ‘মুজিববাদ’ শব্দটি কোথা থেকে টেনে বের করেছেন। দাবি করেছেন ‘১৯৭২-এর মুজিববাদী সংবিধান’ বাতিলের। রাজনীতিক ও সুলেখক খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের এই নামের একটি বই ১৯৭২ সালে বেরিয়েছিল। ‘মুজিববাদ’ অভিধা কখনো স্থায়ী হয়নি, শেখ হাসিনা তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এই অভিধাটি ব্যবহার করেননি, আওয়ামী লীগের দলিলেও নেই। 


আর কোনো দেশের স্বাধীনতা দুইবার হয় না। দ্বিতীয়বার পরজাতির অধীন হলে প্রয়োজন হতে পারে। ইতিহাসে তার নজির কৈ? ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে খাটো করে দেখার বালখিল্য আবিষ্কার ‘বাংলাদেশ ২.০’ বা ‘প্রোক্লেমেশন অফ রিপাবলিক’  নিয়ে আলোচনা তাই অবান্তর।