
দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে বার বার চাপ ও আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিচ্ছে বিএনপি। দলটির চাওয়া চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আদায় করা। অন্যদিকে ঈদুল আজহার আগের দিনে (৬ জুন) সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আগামী বছরের (২০২৬) এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধে যেকোনো দিন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এরপর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। রাতে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে দলের অবস্থান তুলে ধরা হয়।
ঈদুল আজহার রাতে (৭ জুন) বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে ঈদ শুভেচ্ছা জানাতে তার গুলশানের বাসা ফিরোজায় যান।একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ঈদ শুভেচ্ছা শেষে বেগম খালেদা জিয়া নেতাদের বলেন, ‘প্রকাশ্যে অন্তবর্তী সরকারের সাথে সংঘাতে গেলে বিএনপির কোনো লাভ নেই, বরং দাবি থাকলে তা আলোচনার টেবিলে বসে সমাধান করতে হবে।’সূত্রটি জানায়, সরকারকে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি ও সংঘাতপূর্ণ কথা বার্তায় অসন্তুষ্ট বেগম খালেদা জিয়া।চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পরামর্শের পরই সোমবার (৯ জুন) রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দলীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, ওই বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সম্ভাব্য বৈঠক এবং দলের বর্তমান রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে শুরুতে কঠোর থাকলেও সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নিজেদের অবস্থান কিছুটা নমনীয় দেখা যাচ্ছে বিএনপিতে। দলটির কয়েকটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার হস্তক্ষেপেই এই অবস্থান পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলছে।আজ মঙ্গলবার (১০ জুন) দুপুরে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, লন্ডনে অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আগামী ১৩ জুন সাক্ষাৎ করবেন।প্রধান উপদেষ্টা লন্ডনে যে হোটেলে থাকবেন সেখানে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ১৩ জুন স্থানীয় সময় সকাল ৯টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমরা তো বলেছি যে একজনের সাথে আরেকজনের কথার মিল নাও হতে পারে, ভিন্নমত পোষণ করতে পারে। তাই বলে তো সে আমার শত্রু নয়। এটাই তো গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। বিএনপি তো সংস্কারের বিষয়টি অভ্যুত্থানের আগেই দিয়েছে, ৩১ দফা। এটা তো আমি জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি মতো করে চাইব না। আমার দলের যা আদর্শ, তাই চাইব। আমরা সংস্কারের পক্ষে একমত, যেগুলো এখন হবে না, সেগুলো নির্বাচিত পার্লামেন্টে হবে।
এ বিষয়ে গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘বাংলাদেশের একটি বড় রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে তারেক রহমানের সাথে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক অনুষ্ঠিত হলে তা নিঃসন্দেহে দেশের জন্য একটি ইতিবাচক বার্তা বহন করবে।’ তবে বৈঠকটি আসলেই হবে কি না, সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। লন্ডনে পৌঁছানোর পর পরিস্থিতি পরিষ্কার হবে বলে জানান তিনি।গত শুক্রবার (৬ জুন) জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা জানান, জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী বছরের এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধের যেকোনো দিনে অনুষ্ঠিত হবে। এই ঘোষণার পরপরই রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক জরুরি বৈঠকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানানো হয়। বৈঠক শেষে বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, এপ্রিল মাসে নির্বাচন হলে, তা আবহাওয়াজনিত জটিলতা ও রমজান মাসের কারণে নির্বাচনী কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটাতে পারে। পাশাপাশি, কেন ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন সম্ভব নয়, এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা ছিল না।বিশ্লেষকদের মতে, এই বৈঠক দেশের রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হতে পারে। আলোচনা প্রসঙ্গে নির্বাচনের রোডম্যাপ, একটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের পরিবেশ নিশ্চিতকরণ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা নিয়ে মতবিনিময় হতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, চার দিনের সরকারি সফরে যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সোমবার (৯ জুন) সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তিনি যাত্রা শুরু করেন।নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত রাজনৈতিক ময়দানে প্রধান উপদেষ্টার সাথে প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতার সরাসরি আলোচনা একটি ইতিবাচক বার্তা দিচ্ছে। রাজনৈতিক সংঘাত নয়, সমঝোতার মধ্য দিয়ে আগামী নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে পারে- এমন আশার সঞ্চার ঘটছে দেশের অভ্যন্তরে ও আন্তর্জাতিক মহলেও। তবে সবকিছু নির্ভর করছে আসন্ন বৈঠকের ফলাফলের ওপর। আলোচনা যদি বিশ্বাসযোগ্য ও বাস্তবসম্মত সমাধানমুখী হয়, তবে তা শুধু বিএনপির নয়, বরং দেশের গণতন্ত্র ও রাজনীতির জন্যই ইতিবাচক দিকচিহ্ন হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন অনেকে।