Image description

আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্দিষ্ট তারিখসহ একটি নির্বাচনি রোডম্যাপ নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব ধীরে ধীরে রাজনৈতিক তিক্ততায় রূপ নিচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে। খবর বিবিসি বাংলার।

বিশেষ করে গত এক সপ্তাহে নির্বাচন নিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দলটির সিনিয়র নেতাদের শক্ত ভাষায় কথা বলার পরপরই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দিক থেকে যেভাবে জবাবে এসেছে, সেই প্রেক্ষাপটে উভয় পক্ষের মধ্যে দূরত্ব বাড়ার ইঙ্গিতই পাচ্ছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।

নির্বাচনি রোডম্যাপ না এলে সরকারের সঙ্গে সম্ভাব্য তিক্ততা বা বিরোধের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, তারা মনে করেন ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না হওয়ার কোনো কারণ নেই এবং সে কারণেই নির্বাচন ডিসেম্বরেই হতে হবে।

এর আগে গত ২২ মে প্রধান উপদেষ্টার কথিত পদত্যাগের ভাবনা নিয়ে গুঞ্জন ছড়ানোর পর ২৪ ও ২৫শে মে বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

তখন বিএনপি নির্বাচনি রোডম্যাপ ছাড়াও ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে সরকারে থাকা দুই উপদেষ্টা ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাকে বাদ দেওয়ার যে দাবি করেছিলো, সে দাবির ব্যাপারেও সরকার এখনো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

এমন পটভূমিতে সোমবার বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে বসার কথা রয়েছে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের। তার প্রেস উইং জানিয়েছে, দলগুলোর সঙ্গে সংস্কার ইস্যুতে কথা বলবেন প্রধান উপদেষ্টা।

সরকার ও বিএনপির সম্পর্ক কোন দিকে

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, সরকারের দুই উপদেষ্টা এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাকে বাদ দেওয়ার দাবি সামনে আনলেও বিএনপি মূলত তাদের সমমনা দলগুলোকে নিয়ে নির্বাচন ইস্যুতেই সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে যাচ্ছে।

বিশেষ করে গত এক সপ্তাহে দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব এবং সিনিয়র নেতারা যেভাবে দলের অবস্থান প্রকাশ করেছেন, তাতে ‘ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের তারিখ আদায়’ করাকেই দলটির আপাত লক্ষ্য বলে মনে হচ্ছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলছেন, বিএনপি নির্বাচনি রোডম্যাপ আদায়ে ধীরে ধীরে শক্ত অবস্থান নিচ্ছে। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে দলগুলোকে আস্থায় নিতে না পারলে সামনে দুই পক্ষের মধ্যে সম্পর্ক তিক্ততায় গড়ানোটাই হবে স্বাভাবিক।

আরেকজন বিশ্লেষক ও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. সাইফুল আলম চৌধুরী বলছেন, সরকারের তালিকায় নির্বাচন হলো সংস্কার ও বিচারের পর তৃতীয় স্থানে, অন্যদিকে বিএনপির কাছে এটিই অগ্রাধিকার। 

তিনি বলছেন, জাপানে সফরে প্রধান উপদেষ্টা বিএনপিকে ইঙ্গিত করে যেভাবে কথা বলেছেন, তাতে মনে হচ্ছে নির্বাচন ইস্যুতে তিনি দলটির সাথে টাগ অব ওয়ারে যেতে চাচ্ছেন। ফলে বিএনপিও হয়তো ভাবছে দাবি আদায়ে শক্ত অবস্থানই তাদের নিতে হবে।

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিএনপি দ্রুততম সময়ে নির্বাচন দাবি করে আসছিলো। কিন্তু সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানোর জন্য বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের সমর্থকদের কাকরাইলে অবস্থানের পর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে এনসিপি নেতা নাহিদ হোসেন ‘প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগের চিন্তা করছিলেন’ এমন বক্তব্য দিলে তা নিয়ে শোরগোল শুরু হয়।

পরে বিএনপিসহ দলগুলো প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে তার প্রতি সমর্থন জানায়। কিন্তু সেখানেই সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং দুই উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ও মাহফুজ আলমের অব্যাহতি ছাড়াও সুনির্দিষ্ট নির্বাচনি রোডম্যাপের লিখিত দাবি জানায় বিএনপি। কিন্তু পরে সরকারের দিক থেকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত না পেয়ে সংবাদ সম্মেলন করে হতাশা প্রকাশ করে দলটি।

এরপর ২৮ মে বুধবার ঢাকায় তিন সহযোগী সংগঠনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ‘তারুণ্যের সমাবেশে’ ভার্চুয়ালি দেওয়া বক্তৃতায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জাতীয় নির্বাচন নিয়ে টালবাহানার অভিযোগ করেন। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন হতে হবে, ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

এই বক্তব্যের কিছুক্ষণ পরেই তখন জাপান সফররত প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুস সেখানে এক কর্মসূচিতে ডিসেম্বর থেকে আগামী জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পুরোনো অবস্থান তুলে ধরেন।

পরদিন নিক্কেই ফোরামে ফিউচার অব এশিয়া শীর্ষক এক অনুষ্ঠানের প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি মন্তব্য করেন যে, দেশের সব দল নয়, একটি নির্দিষ্ট দল ডিসেম্বরে নির্বাচন চাইছে।

তার এ বক্তব্য ঘিরে তুমুল প্রতিক্রিয়া হয় বিএনপির মধ্যে। জবাব আসে বিএনপির সমমনা দলগুলো থেকেও। বিজেপি, এলডিপি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, নাগরিক ঐক্যসহ ৩৪টি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে বলা হয় তারাও ডিসেম্বরেই নির্বাচন চাইছে।

এরপর শুক্রবার বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে এক অনুষ্ঠানে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে বলেন, টালবাহানা করে নির্বাচনকে পেছানোর চেষ্টা করবেন না। আমরা খুব ভালো জানি, ডিসেম্বরে নির্বাচন না হলে এ দেশে আর কখনো নির্বাচন হবে না।

শনিবার ঢাকাতেই এক অনুষ্ঠানে স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ডিসেম্বরের আগেই নির্বাচন দিতে হবে। এটা বাংলাদেশের মানুষের দাবি।

অর্থাৎ জাপান থেকে প্রধান উপদেষ্টার দিক থেকে বিএনপিকে ইঙ্গিত করে বক্তব্য আসার পরপরই দলটির নেতারা আরও শক্ত ভাষায় নির্বাচনের দাবি জানাতে শুরু করেছেন। এসব কারণেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন নির্বাচনি রোডম্যাপ সরকার দ্রুত না জানালে বিএনপির সঙ্গে তাদের তিক্ততা তৈরি হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

যদিও সালাউদ্দিন আহমেদ বলছেন, তারা তিক্ততা বা দূরত্ব -এভাবে বিষয়টিকে দেখতে চাইছেন না। আমাদের অবস্থান পরিষ্কার যে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হতে হবে। সরকারকে আমরা সেটিই বলছি।

বিশ্লেষকরা যা বলছেন

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গত বছর অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চাইলেও এ সময়ের আরেক বড় দল জামায়াতে ইসলামী আগে সংস্কারকে গুরুত্ব দিচ্ছিলো। কিন্তু এখন জামায়াতও বলছে যে, ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগে বা পরে নির্বাচন আয়োজন করলে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হবে না।

অনেকেই মনে করছেন দলটি এতদিন সরকারকে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিলো মূলত তাদের নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের মুক্তি এবং দলের নিবন্ধন ফিরে পাওয়া নিশ্চিত করার জন্য।

শেষ পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আজহারুল ইসলাম ছাড়া পেয়ে গেছেন এবং জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া হাইকোর্টের রায় বাতিল করে আপিল বিভাগ দলটির নিবন্ধন ফিরিয়ে দিতে নির্বাচন কমিশন বা ইসিকে নির্দেশ দিয়েছে ।

বিশ্লেষক সাইফুল আলম চৌধুরী বলছেন, আমার মনে হয় এখন শুধু বিএনপি নয়, জামায়াতও দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠবে। ফলে সরকার দ্রুত বিএনপির সঙ্গেই নয় বরং কার্যত বিএনপি-জামায়াতসহ অনেক দলের সঙ্গেই তিক্ত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়বে।

তার মতে, শুরু থেকেই নির্বাচন সরকারের তালিকায় প্রথম বা দ্বিতীয় স্থানে ছিলো না এবং এখনো অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন না দেওয়া বা বিলম্ব করার জন্য একটা রাজনৈতিক প্লট তৈরির ওয়ার্ম আপ করছে বলে তার কাছে মনে হচ্ছে।

এ বিশ্লেষকের মতে, তারা আসলে প্যারানয়েড স্টেট অব পলিটিক্স তৈরি করতে চান নির্বাচন না দেওয়ার জন্য। তারা সংস্কার ও বিচার শেষ করে নির্বাচন করতে চাইলে সেটি ডিসেম্বরে অসম্ভব। আবার ফেব্রুয়ারির পর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা, রোজা, জুনে বিশ্বকাপ ফুটবল এবং জুন থেকেই কয়েক মাস প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা। সব মিলিয়ে নির্বাচনকে বিলম্বিত করার এ চেষ্টা বিএনপির না বোঝার তো কারণ নেই।

বিশ্লেষক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলছেন, রাজনৈতিক দল নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে চাইবে সেটা স্বাভাবিক এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকারকে বিএনপি দশ মাস ধরে সহযোগিতা করে আসছে।

তিনি বলছেন, কিন্তু সরকারই মনে হয় গো ধরছে। হয়তো কোনো কোনো দল নির্বাচন চায় না বা সরকারের ঘনিষ্ঠ কোন দল নির্বাচন না দিতে চাপ দিচ্ছে। সরকার যদি দেশ পরিচালনায় যোগ্যতা দক্ষতার পরিচয় দিতে পারতো তাহলে হয়তো নির্বাচনের চাপ জোরালো হতো। সে কারণেই নির্বাচনে দাবি প্রকট হয়ে উঠছে।

মজিবুর রহমান বলছেন, নির্বাচন নিয়ে যে অনিশ্চয়তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, তাকে বিবেচনায় নিয়েই হয়তো দল হিসেবে বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের দাবিতে ক্রমশ সুসংহত ও শক্ত অবস্থান নিচ্ছে।

তিনি বলছেন, মনে রাখতে হবে সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া আর বিচার দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। এ নিয়ে নির্বাচনকে আরও বিলম্বিত করার চেষ্টা বিএনপির দিক থেকে মেনে নেওয়া কঠিন। ফলে নির্বাচনের তারিখসহ রোডম্যাপ না দিলে তিক্ততা অনিবার্য হয়ে উঠবে।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এক সংবাদ সম্মেলনে এ সম্পর্কে আবারো জানিয়েছেন যে, নির্বাচন আগামী ৩০ জুনের আগেই যে কোনো সময়ে অনুষ্ঠিত হতে পারে।