Image description

সংবিধান বাতিল, জুলাই সনদ, সেকেন্ড রিপাবলিক, গণভোট, রাষ্ট্রপতি, সংস্কার, গণহত্যার বিচার, নির্বাচনসহ নানা ইস্যুতে রাজনীতির মাঠ উতপ্ত হয়ে উঠেছে। নানা কৌশলে একে অপরকে চাপে রাখার চেষ্টার পর প্রকাশ্যে এসেছে বিএনপি ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দ্বন্দ্ব। বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়রের পদে শপথ ও দায়িত্ব বুঝে চাওয়ার দাবিতে এই দ্বন্দ্বের শুরু। ইতোমধ্যে উপদেষ্টা পরিষদ থেকে দুই ছাত্র প্রতিনিধির পদত্যাগের দাবি জানিয়েছে ইশরাক ও তার সমর্থকরা। অন্যদিকে ‘বিএনপিপন্থী’ আখ্যা দিয়ে তিন উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবি করেছে এনসিপি। পাশাপাশি বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি) বিএনপি কার্যালয়ে পরিণত হয়েছে মন্তব্য করে পুনর্গঠনের দাবিতে করেছে নতুন এই দলটি। সেই সাথে রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে দাবি দাওয়ার আন্দোলনে জনমনে উদ্বেগ দেখা গেছে।

 
 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ছাত্ররা নতুন বাংলাদেশ বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখছে। তাদের সঙ্গে আমাদের দ্বন্দ্ব হবে কেন? তাদের শত্রু ভাববো কেন? বিএনপির বয়স ৪৭ বছর, কিন্তু ওদের (ছাত্র) দল এনসিপির বয়স ৪৭ দিনও হয়নি। আমরা রাজনীতিতে ছাত্রদের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করি না। তাহলে দ্বন্দের প্রশ্ন আসবে কেন? সরকারের সঙ্গে বিএনপির দ্বন্দ্ব হতে পারে। কারণ সরকারই সব চাওয়া পূরণ করবে।

 

২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে কারচুপি অভিযোগ এনে উঠে। বিএনপির ইশরাক হোসেনকে পৌনে ২ লাখ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে আওয়ামী লীগের শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়র হন। নির্বাচনের ফল বাতিল চেয়ে ওই বছরের ৩ এপ্রিল মামলা করেন ধানের শীষের প্রার্থী ইশরাক। গত ২৭ মার্চ এ মামলায় নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করেন। ২৭ এপ্রিল রাতে গেজেট প্রকাশ করে ইসি। কিন্তু মেয়র হিসেবে তাঁর শপথ আটকে থাকে। ইশরাক হোসেনকে মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়ার দাবিতে গত ১৪ মে থেকে নগর ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে তার সমর্থকরা। শুরুতে এ আন্দোলন থেকে দূরে থাকলেও গত সোমবার থেকে ইশরাককে দলীয়ভাবেই সমর্থন দিচ্ছে বিএনপি। ইশরাকের কর্মসূচিতে সরকারের দুই উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এবং তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের পদত্যাগ দাবি করা হয়েছে।

 
 

এনসিপি গত বুধবার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছে, বর্তমান ইসি ও প্রশাসন বিএনপির পক্ষে কাজ করছে। নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মামলায় ইশরাকের বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করে ইসি আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতের আগেই গেজেট প্রকাশ করায় সাংবিধানিক এই সংস্থাকে বিএনপির অনুগত আখ্যা দিয়ে বুধবার থেকে আন্দোলনে নামে এনসিপি। ইসির পুনর্গঠন ছাড়া নির্বাচন হবে না বলেও হুঁশিয়ারি দেয় দলটি। ইসি ভবনের সামনের সমাবেশ থেকে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ও আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল- এই তিন উপদেষ্টাকে ‘বিএনপিপন্থি’ হিসেবে অ্যাখায়িত করে তাদের পদত্যাগ দাবি করেছে এনসিপি।

 
 

ইশরাকের শপথে বাধা নেই, রিট খারিজ

ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রজ্ঞাপন স্থগিত চেয়ে করা রিট খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। ফলে ইশরাকের মেয়র হিসেবে শপথ নিতে বাধা নেই। বৃহস্পতিবার বিচারপতি আকরাম হোসেন চৌধুরী ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। ইশরাকের আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন জানান, এ আদেশের ফলে মেয়র পদে ইশরাকের শপথে বাধা নেই। এ সময় আগামী ২৬ মে’র মধ্যে ইশরাককে শপথ না পড়ালে আদালত অবমাননা হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

রায়ের পর বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন বলেন, হাইকোর্টের আদেশ শোনার পর আমাদের দল থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আমরা আন্দোলন আপাতত স্থগিত রাখবো। সরকারকে আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণে রাখবো। এ সময়ে তাদের যে কর্মকাণ্ড, তার ওপর ভিত্তি করে আমরা পরবর্তী আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেবো। দুই উপদেষ্টার পদত্যাগ চেয়ে তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের ভেতরে যে দুজন ছাত্র প্রতিনিধি রয়েছেন তারা একটি নতুন রাজনৈতিক দলের সরাসরি সমর্থক। সংগঠক হিসেবে কাজ করছেন। তাদের পদত্যাগ না হওয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন শেষ হবে না। আমরা সরকারকে পুনর্ব্যক্ত করতে চাই, আমাদের দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন শেষ হবে না।

রিট খারিজের পর ফেসবুকে এক পোস্টে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম বলেন, মব তৈরি করে যদি হাইকোর্টের রায় নেওয়া যায় তাহলে এই হাইকোর্টের দরকার কি?

উচ্চ আদালতের রায়ে জনগণের বিজয় হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ব্যাংককে চিকিৎসাধীন বিএনপি মহাসচিব এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এই রায়ে জনগণের বিজয় হয়েছে। এটাতে নিঃসন্দেহে গণতন্ত্রের আরেকটা বিজয় হয়েছে। আমরা জানি যে, যখন মেয়র নির্বাচন হয় তখন সেটা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার জবরদস্তি জোর করে এই ফলাফল কেড়ে নিয়ে গিয়েছিল। জনতার মেয়র হিসেবে ঢাকাবাসীসহ দেশের জনগণ ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করেছিল।

এদিকে, আজ নয়াপল্টন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড খলিলুর রহমানের পদত্যাগ দাবি করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, 'ইতোমধ্যেই কথিত মানবিক করিডোর ইস্যু নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিশেষ করে ড. খলিলের ভূমিকা নিয়ে দেশের স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণের মনে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। মানবিক করিডোর নিয়ে গত একমাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একেকজনের একেকরকম বক্তব্য মনে হয় এই সরকার পথ হারিয়ে ফেলেছে'।

তিনি বলেন, আমাদের কথা পরিষ্কার, এসব করার দায়িত্ব অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নয়। এসব বিষয় বিবেচনার দায়িত্ব জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক নির্বাচিত সরকারের। এই সরকারের নিরপেক্ষতা এবং সরকার পরিচালনার সক্ষমতা নিয়ে জনমনে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। অবিলম্বে এই সরকারের যাদের সম্পর্কে জনমনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে, তাদের সম্পর্কে জনসম্মুখে বিস্তারিত তথ্য জনগণের সামনে উপস্থাপন করুন। তারেক রহমানকে নিয়ে ড. খলিলের বক্তব্য গণতন্ত্রের স্থায়ী নিরাপত্তা ও ঐতিহাসিক স্বার্থকতার প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ।

আজ বিকেলে বিএনপির চেয়ারপারসনের গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড মোশাররফ হোসেন বলেন, নির্বাচন পূর্ব সময় পর্যন্ত সরকার ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে , প্রত্যাশা বিএনপির।

সংস্কার কমিশনে দেয়া বিএনপির প্রস্তাব ও পরামর্শের মত উপেক্ষিত হলে তা হবে দুর্ভাগ্যজনক এবং সেক্ষেত্রে অনিবার্যভাবেই বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগীতা অব্যাহত রাখবে কিনা তা পূনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হবে'।

অভিযোগ করে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের যে সকল উপদেষ্টা একটি নুতন রাজনৈতিক দলের সাথে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত বলে সবাই জানে ও বুঝে; উপদেষ্টা পরিষদে তাদের উপস্থিতি সরকারের র্নিদলীয় নিরপেক্ষ পরিচিতিকে ক্রমাগত প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছে বলেই সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে তাদেরকে অব্যাহতি প্রদান করা প্রয়োজন। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার গতকালকের বক্তব্য আবারও নতুন বির্তকের জন্ম দিয়েছে, সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে তাকে অব্যাহতি প্রদান করতে হবে। ফ্যাসিবাদের দোসর কয়েকজন উপদেষ্টাকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি আমরা ইতোপূর্বে অনেক বার উত্থাপন করেছি। একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করাই এই সরকারের প্রধান কাজ, তাই মাথাভারি উপদেষ্টা পরিষদ না রেখে শুধুমাত্র রুটিন ওয়ার্ক (দৈনন্দিন কার্যক্রম) পরিচালনার জন্য একটি ছোট আকারের উপদেষ্টা পরিষদ রাখাই বাঞ্ছনীয়।

''জুলাই-ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের আকাংখাকে ধারণ করে মানুষের হারানো গণতান্ত্রিক অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার, মানবাধিকারসহ ভোটাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যথাশীঘ্রসম্ভব জনআকাংখা অনুযায়ী একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা করাই এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। তাই, আমরা একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে একটি জাতীয় সংসদ গঠনের জন্য অবিলম্বে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানাচ্ছি। এই সর্বোচ্চ জনআকাঙ্খাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া বর্তামান অন্তরবর্তী সরকারের প্রধানতম এজেন্ডা হওয়া উচিত বলে জনগণ মনে করে। এর অন্যথা হলে জনগণের দল হিসাবে বিএনপি’র পক্ষে এই সরকারের প্রতি সহযোগিতা অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে" বলে স্থায়ী কমিটি এই সংবাদ সম্মেলন থেকে জানানো হয়।

আজ ঢাকার পরিবাগ মোড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যার বিচারের দাবিতে আয়োজিত ব্লকেড কর্মসূচিতে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির বলেছেন, “সাম্য ও পারভেজের হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার না হলে কোনো নেতাকর্মী ঘরে বসে থাকবে না। আমরা যমুনা ঘেরাও কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য হবো।”

বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বেসরকারি চাকরিজীবী সোহেল আহমেদ বলেন, কিছু হলেই রাস্তায় বসে পড়ে সবাই। ব্যারিকেড দেয়া হয়। যানজটে পড়ে নগরবাসী। ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এখন যারা দেশে আছে সবাই ফ্যাসিস্ট বিরোধী শক্তি, জুলাই আন্দোলন আমিও করেছি, কিন্তু গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট পলায়ন করলেও কেন গণতন্ত্র ও জুলাইয়ের শক্তির মধ্যে বিভেদ? বুঝে আসে না। সবাই রাজনৈতিক শক্তি গুলো ঐক্যবদ্ধ হলেই তো এতো দাবির আন্দোলন হয় না। এটা সবাই বুঝতে হবে। যেহেতু, সাধারণ মানুষ নিয়ে তাদের রাজনীতি, অবশ্যই সাধারণ মানুষের ভাষা ও চাওয়া বুঝতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধী শক্তিগুলোর যেখানে ঐকমত্য দরকার ছিল সেখানে আজকে দ্বন্দ্ব দেখা যাচ্ছে। ‘আগে দেখা গেছে, এনসিপি যা চেয়েছে সরকারও তাই করেছে। এখন তারা স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও ইসি পুনর্গঠন চাইছে। আর বিএনপি দ্রুত জাতীয় নির্বাচন চাইছে। রাজনীতিকে দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকলে দেশে অরাজকতা তৈরি হবে। দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য ছাড়া এ সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।’